১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে হামলা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আফগান গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে দীর্ঘ ১০ বছর। এই যুদ্ধে লাখো মানুষ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। দীর্ঘ এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ আফগান প্রাণ হারায়। যার সিংহভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারসহ তিনটি স্থানে হামলা চালায় আল-কায়েদা৷ এর এক মাস পরেই মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তানে অভিযান চালায় আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের খোঁজে৷ তখন অনেক আফগান নাগরিক আশ্রয় নেয় প্রতিবেশি পাকিস্তানে।
বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ আফগান নাগরিক পাকিস্তানের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছে। সম্প্রতি সেখানকার আফগান শরণার্থীদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।
রফিউল্লাহ হানিফ(২২) আফগান শরনার্থীদের একজন। এখানকার একটি শরণার্থী ক্যাম্পেই তার জন্ম। থাকেন মাটি ও ইটের তৈরি ঘরে। এখানকার প্রায় সব ঘরই একই রকম। রফিউল্লাহ’র ঘরে হঠাৎ একদিন মানুষের ভিড়। কারণ তার ঘরে সাংবাদিক এসেছে সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। এখানে সাংবাদিকদের আনাগোনা খুব কম। রফিউল্লাহ স্পষ্টভাষী তবে লাজুক। অনেক লোকের সামনে কথা বলতে একটু ইতস্ত করছিলেন। তবুও তিনি নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছুই বললেন।
রফিউল্লাহ হানিফ বলেন, ‘প্রচুর সংখ্যক আফগান এখানে বসবাস করে। তাই আমাদের কাছে মনে হয়, পাকিস্তান আমাদের ঘর। আমরা নিজের দেশেই বসবাস করছি।’
দক্ষিণ পেশোয়ারের ধুলোবালিময় পথলেড রোডের ২৫ কিলোমিটার অতিক্রম করলেই রাস্তার শেষ প্রান্তে শামসশাতো শরণার্থী শিবির। ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান-সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অনেকগুলো শরণার্থী শিবির নির্মিত হয়। এই শরণার্থী শিবিরটি তারই একটি। তখন বিপুল সংখ্যক আফগান নাগরিকের সঙ্গে রফিউল্লাহ’র মা-বাবাও সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে পাড়ি জামান এবং সেই থেকে চলছে তাদের শরণার্থী জীবন।
ইতিমধ্যেই অধিকাংশ আফগান নাগরিক শরণার্থী ক্যাম্প ছেড়ে শহরে চলে গেছেন। কিন্তু শামসশাতো ক্যাম্পে এখনো ১০ হাজার আফগান গরিব শরণার্থী বসবাস করে।
পাকিস্তান সরকারের তথ্য মতে, এখনো পাকিস্তানে প্রায় ৩০ লাখ আফগান নাগরিক বসবাস করে।
রফিউল্লাহ বলেন, ‘আমরা যখন এখানে আসি তখন ভেবেছিলাম পাকিস্তান আমাদের সেকেন্ড হোম। কিন্তু আমরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। পুলিশ আমাদের সঙ্গে খুবই বাজে আচরণ করে। গালাগাল দেয়, নির্যাতন করে এবং জোরপূর্বক টাকা আদায় করে।’
রফিউল্লাহ হানিফ বলেন, ‘বোমা হামলা বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলে আফগানদের ওপর দোষ চাপানো হয়। দাঁড়ি থাকলে মানুষ সন্ত্রাসী হয় না।’
ক্যাম্পের খুব কম সংখ্যক মানুষই উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তবে রফিউল্লাহ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছেন। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ব এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছেন তিনি। শরণার্থীদের চাকরির সুযোগ না থাকায় রফিউল্লাহ এখনো চাকরি পাননি।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের চাকরি তো দূরের কথা শিক্ষানবিস হিসেবে কোথাও কাজ করার সুযোগ নেই। তাই আমাদের চাকরি পেতে হলে আফগানিস্তানে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’
আফগানিস্তান এখনো সংঘাতময় দেশ। শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। শরণার্থীদের অনেকেরই আফগানিস্তানে বিষয়সম্পত্তি বলতে এখন আর কিছুই নেই।
রফিউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের আফগানিস্তানে একটি বাড়িও নেই। তাই সেখানে ফিরে যাওয়া আসলেই অসম্ভব।’
রফিউল্লাহর মতো এমন উভয়সঙ্কট পরিস্থিতি পাকিস্তানে থাকা অধিকাংশ আফগান নাগরিকের। তারা দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাদের যেকোনো সময় এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। কারণ পাকিস্তান সরকার ২০১৬ সালের পর উদ্বাস্তুদের নবায়নের বিষয়টি প্রত্যাখান করেছে। তার মানে হচ্ছে শরণার্থীদের গণ প্রত্যাবাসন।
পাকিস্তানের সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, শরণার্থীদের দীর্ঘমেয়াদে থাকা পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার পাকিস্তানের প্রতিনিধি ইনদ্রিকা রাতওয়াতে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে খুব কম পরিমাণ সাহায্য দেশটি পেয়ে থাকে।
ইন্দ্রিকা রাতওয়াতে আরও বলেন, ‘সিরিয়া, ইরাকে মানবিক সঙ্কট বাড়ছে। সেখানকার অধিবাসীরা এখন ইউরোপের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। পাকিস্তানের কয়েক দশক ধরে শরণার্থীদের আশ্রয় রেখেছে।’
কিছু শরণার্থীদের ইতিমধ্যে জোরপূর্বক সীমান্ত পাড় করে দেয়া হয়েছে। ত্রাণকর্মীরা বলেছেন, সেখানে শরণার্থীরা ভয়ংকর এবং প্রাণঘাতী পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
শামসশাতো ক্যাম্পের নেতারা তাদেরকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর আগেই নিজেরাই আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
রফিউল্লাহ এই ক্যাম্পেই জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার ইচ্ছা নিজ মার্তৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার।
রফিউল্লাহ বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। এবং প্রত্যাশা করি দুই দেশের মধ্যে শান্তি বজায় থাকুক।’