ঢাকা : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত এবং বিচারের রায়কে বিতর্কিত করতে ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সংগঠন পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। বিচারিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রক্রিয়া।এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সর্বশেষ একাত্তরে মানবতাবিরোধী সব অপরাধের মুল হোতা গোলাম আযমের কারাদন্ডের রায়কে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি বিবৃতি দেয়। তবে সরকার ও মানবাধিকার কমিশনসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা এ বিবৃতির নিন্দা জানিয়ে সমালোচনা করেছে।
১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্য পূরণে রাজাকার-আলবদরসহ দেশীয় কয়েকটি সংগঠন নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগসহ বাঙ্গালীর উপর নির্মম নির্যাতন চালায়। সে সময় কয়েকটি দেশও পাকিস্তান ও এসব সংগঠনকে সমর্থন দেয়। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও ওই সব দেশ, সংগঠন ও তাদের সহযোগিদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় আবার তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া এ দেশীয় দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া।
প্রায় চল্লিশ বছর পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলে আবার সক্রিয় হয় ওই সব দেশ ও সংগঠন। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালায়। এজন্য তারা জামায়াতের অর্থ ব্যবহার করে। এরপর রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী ছয় অপরাধীর সাজার রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে গোলাম আযমের আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে সংগঠনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে।
সংস্থাটির এমন বিবৃতির নিন্দা জানিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, প্রসিকিউটরদের প্রধান সমন্বয়ক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান ও প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ।
বিচার বানচালে কোটি ডলারে লবিস্ট নিয়োগ : নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য যখন ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, ঠিক তখন থেকেই বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশে-বিদেশে নানামুখী লবিং, গ্রুপিং ও অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এরই অংশ হিসেবে তারা উন্নত বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সরকার, বিরোধীদলীয় নেতা ও আইনজ্ঞদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করতে কোটি কোটি ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জামাতে ইসলামির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে মার্কিন সরকারের শীর্ষ নেতাদের প্রভাবিত করে বিচার ভ-ুল করতে ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ক্যাসেডিয়ান অ্যাসোসিয়েটসকে লবিস্ট নিয়োগের কথা বারবার আলোচনায় আসে। একই সঙ্গে এই অর্থের লেনদেনের মূলে জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী প্রধান ভূমিকা পালন করে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে তদন্তে পরে যুক্ত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন।
অপপ্রচারে যুক্ত ইত্তেহাদুল ওলামা : সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বিশ্বে লবিস্ট নিয়োগ করে বিচার ভ-ুলে জামায়াতের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পৃথিবীর ৬০ দেশের ইসলামিক স্কলারদের নামে গঠিত সংগঠন ‘ইত্তেহাদুল ওলামা’কে এই অপপ্রচারে যুক্ত করা হয়েছে। মাঠে নামানো হয়েছে এই সংগঠনকে। এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদর দপ্তর কাতারে অবস্থিত। সূত্রে আরো জানা যায়, জামায়াত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে নানা কৌশলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে লাগাতার নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এই প্রচারণা আরও জোরদার করেছে। বিভিন্নভাবে জামায়াতের এসব প্রচারণার সংগ্রহ করা অনেক তথ্য-প্রমাণ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। এই অপপ্রচার ও লবিংয়ের অংশ হিসেবেই গত বছর কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামী সংস্থা ইত্তেহাদুল ওলামার ব্যানারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের হুমকি দিয়ে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে, সেই বিবৃতির কপিও সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে রয়েছে।
জামায়াতের এই নতুন চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘ইত্তেহাদুল ওলামা’র প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারযাবী ও সেক্রেটারি জেনারেল ড. আলী আল কুররাহ দাগী গত বছরের শেষ দিকে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে কোনো প্রহসন করলে দেশটিকে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে কারাবন্দি সব ইসলামিক নেতাদের (অভিযুক্তরা) অবিলম্বে মুক্তি এবং বাক-স্বাধীনতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন ও গ্র্যান্ড মুফতির ছবি বিকৃত করে সংবাদ প্রকাশ : বাংলাদেশের দুটি পত্রিকা দৈনিক ‘আমার দেশ’ ও দৈনিক ‘সংগ্রাম’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মক্কার পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন ও গ্র্যান্ড মুফতির ছবি বিকৃত করে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা ছড়িয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা চালায়। পরে ‘আমার দেশে’র সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে তেজগাঁও থানা পলিশ। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর পত্রিকাটির ৭-এর পাতায় ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণেও সংবাদটি প্রচার করা হয়।
পরে ফেসবুক ও ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ওই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করা হয়। সামাজিক মাধ্যমগুলো সংবাদটি কেন মিথ্যা তার ব্যাখ্যা এবং ছবিও দেয়। সেখানে জানানো হয়, প্রতিবছর পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়, যা পবিত্র কাবা শরীফের দীর্ঘ দিনের রীতি। গিলাফ পরিবর্তন করা হয় কাবা শরীফের ইমামদের মাধ্যমে। বিশেষ আয়োজন আর অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। সেই গিলাফ পরিবর্তনের ছবিটিকেই ইমামদের ‘মানববন্ধন’ হিসেবে তুলে ধরে পত্রিকা দুটি।
বিচারপতির স্কাইফ কথোপকথন নিয়ে ষড়যন্ত্র : ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ব্রাসেলসভিত্তিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রধান বিচারক নিজামুল হকের কথিত স্কাইপ কথোপকথন বেআইনীভাবে হ্যাকিং করা হয়। এ নিয়ে ৯ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩টি প্রতিবেদনে প্রকাশ ও প্রচার করে দৈনিক আমার দেশ। পত্রিকাটি প্রায়ই ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করতে থাকে, যা বিচার কাজকে ব্যাহত ও প্রশ্নবিদ্ধ করছিল। এ সবই ষড়যন্ত্রের অংশ।
তুরস্কের প্রতিনিধি দলের বিতর্কিত ঢাকা সফর : জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিংয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর তুরস্কের ১৪ সদস্যের একটি ‘এনজিও’ প্রতিনিধি দল পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু তাদের এই বিতর্কিত সফরে দেশজুড়ে সমালোচনার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বলে তখন বিশিষ্টজনেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানায়, জামায়াতের অর্থে তুরস্কের প্রতিনিধিদলের সফরকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যবেক্ষণ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও বিরোধী দলের একজন শীর্ষ নেতাসহ ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ১৪ সদস্য বিশিষ্ট এ প্রতিনিধি দলের সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন এতো বড় একটি বিদেশী দল ঢাকায় আসবে।
গোলাম আযমের রায় নিয়ে এইচআরডব্লিউর উদ্বেগ : একই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে গোলাম আযামের বিচার প্রক্রিয়ায় পাঁচটি বিষয়কে ‘ত্রুটি’ হিসাবে তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে পক্ষপাতেরও অভিযোগ আনেন।