অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক:পবিত্র মাহে রমজানের শেষের দিকে মানুষজন ক্রমাগত কর্মস্থল ও বর্তমান ঠিকানা ছেড়ে ছুটে যাবেন গ্রামগঞ্জে আপনজনদের কাছে। এ সময় আমাদের সকলের যাত্রা যেন শুভ, বরকত ও মঙ্গলময় হয়, সে প্রত্যাশায় আজ সফরের আদব সম্পর্কে কয়েকটি কথা। সাহাবী কাব ইবনে মালিক (রাদি) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (স) বৃহস্পতিবার তাবুক যুদ্ধে রওনা হয়েছিলেন আর তিনি বৃহস্পতিবার সফরে বের হওয়া পছন্দ করতেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম এ হাদিসটি রেওয়ায়েত করেছেন। বুখারী ও মুসলিমের এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (স) খুব কমই বৃহস্পতিবার দিন ছাড়া অন্য দিনে সফরে বের হতেন। আমাদের দেশেও বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়। হাদিসের সঙ্গে দেশীয় সাপ্তাহিক ছুটির একটি সুন্দর মিল আছে। আমরা চাইলে ঈদের সফরে এ সুন্নতের ওপর আমল করতে পারি।
সাহাবী সাখর ইবনে ওয়াদা’আহ আল গামেদী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে দিনের প্রথমাংশে বরকত দান কর আর তিনি যখনই কোন ছোট বা বড় সেনাদল রওনা করতেন, তাদের দিনের প্রথম ভাগে রওনা করতেন। (হাদিস বর্ণনাকারীর বক্তব্য হচ্ছে) সাখর ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি বরকত লাভের আশায় ব্যবসাতে দিনের প্রথমে অংশে পণ্য পাঠাতেন। ফলে তার ব্যবসা সমৃদ্ধ হয় এবং তার সম্পদ দিন দিন বৃদ্ধি পায়।’ আবু দাউদ ও তিরমিযী (রহ) হাদিসটি রেওয়ায়েত করেছেন আর ইমাম তিরমিযী এটিকে হাসান হাদিস আখ্যায়িত করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাদি) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, একাকী সফরের মধ্যে কী কী ক্ষতি আছে, সে সম্পর্কে আমি যা জানি লোকেরা যদি তা জানত, তাহলে কোন সাওয়ার রাতে, একাকী সফর করত না। ইমাম বুখারী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। মহানবীর ওপর লাখো দরূদ ও সালাম। তিনি কত অভিজ্ঞতালব্ধ কথাই না বলেছেন। আজ আমরা হারে হারে বুঝতে পারছি একাকী সফরে বা রাত্রিকালীন ভ্রমণে আমাদের পিছু লেগে আছে হাইজ্যাকিং, ডাকাতি, খুন-খারাবি ইত্যাদি।
সুন্নাত তরিকায় সফর বা ভ্রমণ করার নিয়ম বর্ণনা করতে গিয়ে বুজর্গানে দ্বীন বলেছেন, সফরের নিয়ত করলে কিংবা হজ জিহাদ ইত্যাদির জন্য একস্থান হতে অন্যস্থানে গমনের লক্ষ্যে প্রস্তুত হলে সর্বপ্রথম দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা। বৃহস্পতিবার কিংবা সোমবার দিন প্রত্যুষে সফরে রওয়ানা করা। বাহনে আরোহণ করত ঠিকমতো বসে দোয়া পাঠ করা।
সফরে যাত্রার পূর্বে সর্বাপেক্ষা যা জরুরী কাজ, তা হলো, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং সদ্ভাব স্থাপন করবে, তাছাড়া পিতা-মাতা এবং অন্যান্য মুরুব্বি অভিভাবকের নিকট হতে অনুমতি নিয়ে নেবে। সন্তান-সন্ততি সম্ভব হলে সঙ্গে নিয়ে যাবে। নচেৎ এমন কোন নির্ভরযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক বা রক্ষক নিযুক্ত করে যাবে, যে প্রবাসী ব্যক্তির অনুপস্থিতিকালে তাদের সকল বিষয় দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধান করবে।
সফরে সাথী বন্ধুদের সঙ্গে সব রকম সদাচরণ প্রদর্শন করবে। যেমন অসুস্থতা বা দুর্বলতাবশত কেউ পথের কোথাও যাত্রা বিরতি করলে তার সঙ্গে যাত্রা বিরতি করবে। তাকে ফেলে চলে যাবে না। সাথী পিপাসার্ত হলে তাকে পানি পান করাবে। সাথী কড়া ব্যবহার করলেও তার সঙ্গে নরম ব্যবহার করবে, কোন কারণে সাথী অসন্তুষ্ট হলে তাকে সাধ্য-সাধনা করে খুশি করবে। মাল সামানা রেখে সাথী ঘুমিনে পড়লে তা যাতে চুরি হয়ে না যায় বা খোয়া না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। যদি সাথীর কাছে পাথেয়ের অভাব দেখা দেয়, তবে নিজের পাথেয় হতে তা পূরণ করে দেবে। সাথী কোন ব্যাপারে সঙ্কটাপন্ন বা বিপদগ্রস্ত হলে তাকে সুপরামর্শ দেবে। তার বিপদ বা সঙ্কট দূরীকরণার্থে মনে-প্রাণে চেষ্টা করবে। ইসলাম ধর্মে মহানবী (স) ও পুণ্যাত্মা মনীষীগণ সফরকালের জন্য যে সুন্দর শিষ্টাচার বর্ণনা করেছেন, তা আজও যদি আমরা দেশের বড় ছুটি রমজান ও ঈদ-উল-ফিতরের সময় আমল করি তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের যাত্রা হবে আরামদায়ক ও নিরাপদ।