logo ০৯ মে ২০২৫
প্রথম আলোর ট্যাবু
প্রভাষ আমিন
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১০:৩২:০৩
image

অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও প্রথম আলোই আমার প্রিয় পত্রিকা। প্রথম আলো ছাড়া আমার দিন শুরু হয় না। প্রকাশের পর থেকে প্রথম আলো পড়িনি, এমন একটি দিনও নেই। প্রথম আলো এখন আর নিছক একটি দৈনিক পত্রিকা নয়। অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, নিজেদের পরিধি অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে। নিজেদের দায়িত্ব তারা নিজেরাই বাড়িয়ে নিয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য খুব নিরবে প্রথম আলো খুব বড় একটি কাজ করে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালারা বিশ্ববিদ্যালয় চেনে না, ইউনিভার্সিটি চেনে। বিদেশি ভাষার এই আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে প্রথম আলো সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোনো ইংরেজি শব্দ ছাপবে না। এই সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয়, তখন আমি প্রথম আলোর প্রধান প্রতিবেদক ছিলাম। এই সিদ্ধান্তে খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। কারণ প্রথম ধকলটা যেতো আমার ওপর দিয়েই। রিপোর্টাররা প্রচলিত ভাষায় লিখে দিতো। আর আমাকে সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে হতো। মানে রিপোর্টাররা বাংলায়ই লিখতেন। কিন্তু তাতে লুকিয়ে থাকা ইংরেজি শব্দগুলো অভিধান ধরে ধরে বাংলা করতে হতো। এখন বুঝি প্রথম আলো আমাদের কত বড় উপকার করেছে এবং করছে। আগে আমরা আইসিইউ না বললে বুঝতাম না, এখন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও বুঝি। মুঠোফোন, খুদেবার্তা- এমন অনেক অপ্রচলিত বাংলা শব্দকে চালু করার কৃতিত্ব প্রথম আলোরই। এফএম রেডিওর বাংলিশ’এর বিপরীত স্রোতে সাঁতার কেটে যাচ্ছে প্রথম আলো। তবে প্রথম আলো মাঝে মধ্যে এমন অপ্রচলিত বাংলা ব্যবহার করে যে অভিধান খুজেঁ তার মানে বের করতে হয়। তারপরও আমি এর পক্ষে। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন দিতে পারলে, আমরা একটু কষ্ট করে অভিধান দেখতে পারবো না কেন?


গত ২৫ সেপ্টেম্বর এই প্রথম আলোর ‘বিনোদন’ পাতায় ‘দীপিকা বনাম টাইমস অব ইন্ডিয়া’ শিরোনামের সংবাদটি পড়ে একটু অবাকই হলাম। সংবাদটিতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি শিরোনাম উদ্ধৃত করা হয়েছে ‘ওএমজি, দীপিকা পাডুকোন’স ক্লিভেজ শো’। এ ব্যাপারে টুইটারের দীপিকার প্রতিক্রিয়াটিও উদ্ধৃত করেছে প্রথম আলো ‘হ্যাঁ! আমি নারী। আই হ্যাভ ব্রেস্টস অ্যান্ড এ ক্লিভেজ! ইউ গট এ প্রবলেম!?’ পড়তে পড়তে আমার বিশ্বাসই হয়নি। প্রথম আলোতে এত লম্বা ইংরেজি বাক্য অবিশ্বাস্যই বটে। আমার ধারণা প্রথম আলো অনেক আধুনিক হলেও ট্যাবুটা এখনও ভাঙতে পারেনি। এই বাক্যগুলো ইংরেজিতে লেখা যতটা সহজ, বাংলায় লেখা ততটা সহজ নয়। এটা আমাদের সমাজের ট্যাবু। প্রথম আলো এই ট্যাবুটা ভাঙতে পারেনি। অথচ ভাঙা উচিত ছিল। আমি বুঝি ইংরেজিতে ‘ব্রেস্ট’ লেখা যত সহজ, বাংলায় ‘স্তন’ লেখা তত সহজ নয়। ইংরেজিতে অবলীলায় আমরা এমন সব শব্দ বলে ফেলি, যা বাংলায় উচ্চারণ করতে পারি না। আমাদের সংস্কার আমাদের জিহবায় লাগাম পরায়।


এইডস নিয়ে বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত স্লোগান হলো ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। কী জানতে হবে? এইডস ছড়ানোর কারণ এবং প্রতিকারের উপায় জানতে হবে। আর জানতে হলে আমাদের কিছু ট্যাবু ভাঙতেই হবে। এখন বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছেন, সন্তানের বন্ধু হতে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীকে যেন বাবা-মাই প্রয়োজনীয় যৌন শিক্ষাটা দেন, শরীর ও মনের বদলে যাওয়া সম্পর্কে যেন তাদের সচেতন করা হয়। কৌতুহলটা ভেঙ্গে দিলেই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে শিশু; হয়ে উঠবে সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক মানুষ। কোনো জরিপ আছে কিনা জানি না, তবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি যৌন বিকৃতিতে ভোগে, নিজেরাও বিকৃতির শিকার হয়। আর যে স্কুলে সহশিক্ষা আছে, সেখানকার ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠে স্বাভাবিকভাবে। একজন মাদ্রাসা ছাত্র যে সাধারণভাবে নারীদের দেখতে পায় না, নারী সবসময় তার কাছে কৌতুহলের বিষয়। আল্লামা শফি হয়তো এদের কথাই বলেছেন, যারা নারীকে তেতুল মনে করে। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে ছেলে মেয়ে একসাথে পড়াশো্না করা ছেলের কাছে নারীরা আলাদা কৌতুহলের বিষয় থাকে না।


এত কথা লিখছি বটে, কিন্তু ট্যাবুটা কি আমরা ভাঙতে পেরেছি? আমার ছেলে এখন টিনএজার। আমি সবসময় চেষ্টা করি তার ভালো বন্ধু হওয়ার। তারপরও তাকেও আমি সবকিছু বলতে পারি না। কিছু সংস্কার, কিছু পুরোনো শিক্ষা, কিছু ট্যাবু আমার জিহবা জড় করে দেয়ে, মুখে কুলুপ আটে। কিন্তু আমরা তো পথ চেয়ে বসে থাকি, প্রথম আলো আমাদের পথ দেখাবে। শালীনতার সীমাটা বজায় রেখেই প্রথম আলো আমাদের নিয়ে যাবে আলোর পথে।


লেখক: এসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ