ঢাকা: ইসলামে বরকতময় ও ঐতিহাসিক যে কয়েকটি দিবস রয়েছে তার মধ্যে পবিত্র আশুরা অন্যতম।আশুরা শব্দটি আরবি।এর আরবি মূলশব্দ ‘আশরুন’। বাংলা অর্থ দশ।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমের ১০ম তারিখকে পবিত্র আশুরা বলা হয়ে থাকে।ইসলামী সন গণনায় মুহররম একটি মর্যাদাবান মাস।
মুহররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এ মাসসহ আরও তিনটি মাসে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ।এরকম নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে মাসটি পাক-পবিত্র বলে ইহাকে মুহররম বা পাক পবিত্র মাস বলা হয়ে থাকে।
রাসূল সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসে কোনো ধর্মযুদ্ধও করেননি। এমনকি ইসলাম পূর্ব যুগেও এ মাসে শান্তি বিরাজ করতো।মুহররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ্ব- এ চারটি মাসকে আল্লাহ তায়ালা পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
আল কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা জেনে রেখ,এই চারটি মাস বড় ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের উপর জুলুম করো না।’
স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায়,এসব মাসে নেক আমল করলে সওয়াবও বেশি হবে।উল্লেখিত চার মাসের মধ্যে মুহররমের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন আরবরা মুহররমের ১০ তারিখ দর্শনার্থীদের জন্য কাবা ঘরের দরজা খোলা রাখত।
পবিত্র আশুরা মুসলিম ঐতিহ্যে বড়ই বরকতপূর্ণ ও নানাভাবে অবিস্মরণীয়।ইসলামপূর্ব যুগেও এ দিনকে খুব মর্যাদা সহকারে পালন করা হতো।সৃষ্টির শুরু থেকে এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
পবিত্র আশুরার দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা সাগর, পাহাড়, প্রাণীকুল, আসমান-জমিন ও লওহ-কলম সৃষ্টি করেছেন।এদিনেই তিনি আরশে আজিমে সমাসীন হয়েছেন।তামাম মাখলুকাত ধ্বংসও হবে মুহররমের দশ তারিখে।
আল্লাহ পরওয়ারদেগার এই দিনে আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার খলিফা নিযুক্ত করেছেন আর জান্নাতে দাখিল ও পৃথিবীতে নির্বাসনের পর আরাফাত ময়দানে হযরত মা হাওয়ার সঙ্গে পরিচিত করতো দীর্ঘ দিন ক্ষমা প্রার্থনা শেষে দু'জনের তাওবা কবুল করেন।
পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ড হাবিল কাবিলের ঘটনাও এদিনে সংঘটিত হয়।এ দিনে হযরত নূহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদলবলে মহাপ্লাবন শেষে যুদী পাহাড়ে অবতরণ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন।
হযরত ইব্রাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষমতাশালী মূর্তিপূজারী নমরুদের অগ্নিকাণ্ড থেকে উদ্ধার, হযরত আইয়ুব আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি, হযরত ইউনুছ আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ এবং ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুপুত্র মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ দিনই ফেরত পান।
আল্লাহপাক এ দিনে হযরত ইদ্রিস আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানোর পর গুনাহ-অপরাধের জন্য কান্নাকাটি করলে আবার তাকে জান্নাতে ফেরত নেন।
এ দিনেই হযরত দাউদ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুনাহ মাফ হয়,কুমারী মাতা বিবি মরিয়ম আলাইহি ওয়া সাল্লামের গর্ভ হতে হযরত ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমন ঘটে।
এ দিনই রহমতস্বরূপ আসমান হতে প্রথম বৃষ্টি নামে।হযরত সোলাইমান আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের আংটি হারিয়ে সাময়িকভাবে রাজ্য হারা হলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ তায়ালা তার রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পিতা ইয়াকুব আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর এ দিনে সাক্ষাৎ লাভ করেন।হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম তৎকালীন মিসরের বাদশাহ ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে এ দিনে তিনি বনী ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে নীল নদ পার হয়ে যান আর নদীর মাঝপথে পানি চাপা পড়ে ফেরাঊনের সলিল সমাধি ঘটে।
হযরত ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা'য়ালা নিজ অনুগ্রহে এ দিনে আসমানে তুলে নেন। হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতি বিজড়িত এ দিন ইহুদি-খৃষ্টানদের মাঝেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
আমাদের পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা এ দিনে রোযা রাখছে।তারা ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে আশুরা পালন করছে।মহানবী সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে পারলেন, তারা হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এ দিনকে বেছে নিয়েছে।
হুজুরে পাক সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলদ্ধি করলেন যে,হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আমাদেরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।তাই তিনি ওই দিনই রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদের রোযা রাখতে উপদেশ দিলেন।তবে ১০ মুহররমের আগে পরে একটি রোযা বাড়িয়ে দুটি রোযা রাখতে বললেন।
দ্বিতীয় হিজরীতে রমযান মাসের রোযা ফরজ হলে আশুরার রোযা নফল হয়ে যায়।তবে রমযানের রোযার পর আশুরার রোযার মর্যাদা এখনও সর্বাধিক।
আশুরার রোযা পালন সম্পর্কে হযরত সালমা আকওয়া রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,আসলাম গোত্রের এক লোককে মহানবী সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংবাদ ঘোষণার দায়িত্ব দিয়ে আশুরার দিন প্রেরণ করলেন যে,‘যারা আজ রোযা রাখেনি তারা যেন রোযা রেখে নেয়।আর যারা ইতিমধ্যে খাওয়া-দাওয়া করেছে তারা যেন রাত পর্যন্ত খাবার ও পানাহার হতে বিরত থাকে।’(মুসলিম)
আশুরার রোযাকে ইহুদিদের রোযা হতে পৃথক করার জন্য তিনি বলেছেন,‘তোমরা আশুরার দিন রোযা রাখ এবং ইহুদিদের থেকে ব্যতিক্রম কর।আশুরার একদিনের পূর্বে বা একদিন পরেও রোযা রাখ।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন ‘আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে নবম দিনেও রোযা রাখব।’ (মুসলিম,আবু দাউদ)।
আশুরার দিন রোযা রাখার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি একবছর পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন'। (মসনদেআহমদ)।
মহানবী সাল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের জামানায় ১০ মুহররম খুব তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ দিন হিসেবে পালিত হলেও ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে রাহমাতুল্লিল আলামিনের প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা জাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহার নয়নমণি ৪র্থ খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পুত্র ইমাম হোসাইন দামেস্ক অধিপতি কুখ্যাত ইয়াজিদের অসভ্য সেনাবাহিনীর হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করলে এদিন ঐতিহাসিক কারবালা দিবস হিসেবেও মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে নব উদ্দীপনায় উদযাপিত হয়ে আসছে।
নীতি, আদর্শ, সত্য, মানবতা ও মুক্তির জন্য নিঃসংকোচচিত্তে এ রকম প্রাণ দানের ঘটনা বিরল।কপটচারী ও অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত ফৌজের মুকাবিলায় ঈমানি জজবা ও অকুতোভয় মনে হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু যে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন তা কালজয়ী ইতিহাস হয়ে আছে।যুগ যুগ ধরে এটি মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে রয়েছে।
কবি বলেছেন ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায় কারবালা কে বাদ’ অর্থাৎ কারবালা যুদ্ধের পর ইসলাম সত্যিকার অর্থে পূনর্জীবিত হল।
হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অসাধারণ ঈমানি চরিত্রের অধিকারী।তিনি বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন।দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন মনোভাব পোষণ করতেন।খেলাফতে রাশেদার পুনর্জীবনের গভীর আবেগে তিনি অটুট সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন।
তিনি বলতেন,‘জিল্লতি বরদাশত করার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম।’ তাই তিনি অন্যায়, অসাম্য, কলুষতা ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সে কথার বাস্তব প্রমাণ দিয়ে গেলেন।তিনি অসভ্য শাসক ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলে কারবালা অধ্যায়ের সৃষ্টি হতো না এবং তাকে নবীজীর দৌহিত্র হিসেবে ধর্মীয় উচ্চাসনে বসানো হতো।
কিন্তু তিনি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ইসলামের সামষ্টিকরূপকে মসজিদের ভেতরে আটকে রেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বরং নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে ইসলামী আদর্শের মান মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দিয়ে গেছেন।
আজ মুসলিম উম্মাহ সেই গৌরবজনক অধ্যায় ভুলে গেছে। ত্যাগ, নিষ্ঠা ও কুরবানির শিক্ষা হারিয়ে নানা রকম শরিয়ত গর্হিত রসম-রেওয়াজে জড়িয়ে পড়েছে।
একশ্রেণীর মুসলমান হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি শোক করতে গিয়ে ‘হায় হোসাইন, হায় হোসাইন' শব্দে বুকে চপেটাঘাত করে মাতম তোলে।রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করে,অদ্ভূত মঞ্চ সজ্জা করে।শোক প্রকাশ করতে গিয়ে রাতের গভীরে হঠাৎ ব্যান্ড শো'র গানে বিকট শব্দ করে ঘুমন্ত মানুষকে হতবিহবল ও আতঙ্কিত করে তোলে।যা ইসলামী শরিয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আত্মবিস্মৃত ও ধর্মীয় আবেগ বিকৃত এসব মুসলমান দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে।একজন ইসলামী চিন্তাবিদ আফসোস করে বলেছেন,‘ইয়াজিদের উত্তরসূরিরা এখনও বহাল আছে, তবে হোসাইনের মতো আপোষহীন ঈমানদার বীরপুরুষ নেই।’
হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর দৃঢ় প্রত্যয় ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের দীক্ষা প্রতি আশুরায় আমাদেরকে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে কোনো আত্মত্যাগের প্রেরণায় উজ্জীবিত করলে মুহররম উদযাপন সার্থক হবে।এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
ফিরে এলো আজ মুহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
(ঢাকাটাইমস/৩নভেম্বর/এমআর)