বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি শিমুল বিশ্বাস সম্প্রতি একটা কলাম লিখেছেন জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তে। লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো। লেখাটির একটা অংশে তিনি আমার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাঁর রাজনীতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে নাগরিক হিসেবে আমার অবস্থান হলেও ক্ষুদ্র এ লেখকের বইয়ের উদ্ধৃতি দেয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতা হওয়ায় শিমুল বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, গণমাধ্যম নিপীড়ন সম্পর্কে তাঁর ভয়াবহ একপেশে লেখার জবাব দেয়ার চেষ্টা এ লেখায় করছি না। আজকের শাসক দল আওয়ামী লীগসহ গণমাধ্যম নিপীড়নের 'কৃতিত্ব' এদেশের সব সরকার কম-বেশি অর্জন করেছে। শিমুল বিশ্বাস লেখাটির জন্য সব মতের পাঠকের ধন্যবাদ পেতেন, যদি আমার বইটিতেই উল্লেখিত চশমাপ্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের এক প্রতিমন্ত্রীর ঠুককো মামলায় শ্রদ্ধেয় এক সম্পাদককে গ্রেপ্তার করাসহ তখনকার সরকারের গণমাধ্যম নির্যাতনের ঘটনাগুলো আলোচনা করতেন। বা খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার কিংবা দ্বিতীয় সরকারের বেলায় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যযুগীয় কায়দায় গ্রেপ্তার এবং গণমাধ্যম বন্ধের ঘটনাগুলো সামান্য আকারে উপস্থাপন করলেও তাঁর লেখাটি হয়তো দলীয় বিজ্ঞপ্তি না হয়ে একটা কলাম হয়ে উঠতে পারত!
এটাও সত্য, শিমুল বিশ্বাস রাজনীতি করেন। তাঁর কাছ থেকে এক ধরনের নিরপেক্ষ আলোচনাও আশা করা যায় না। এদেশের ছোট-বড় সব দলের রাজনীতিবিদকে নিজের দলের 'অঘোষিত ব্লাসফেমি' আইন মেনে চলতে হয়! এ আইন না মানলে দল থেকে বহিষ্কার!
আমার বই থেকে নেয়া বাক্যটির শেষে শিমুল বিশ্বাস লিখেছেন 'গণমাধ্যম নিপীড়ন, হাসান শান্তনু, পৃষ্ঠা-১২'। হয়তো অসাবধানশত তিনি বইয়ের নামটি অসম্পূর্ণ লিখেছেন। বইটির পুরো নাম- 'গণমাধ্যম নিপীড়ন ১৯৭২-২০১২'। আমার লেখা প্রথম এ বই প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার বিভাস প্রকাশনী থেকে। শিমুল বিশ্বাসের লেখাটির শিরোনাম- 'একদলীয় নৈরাজ্যের পদধ্বনি'। যা গত ২০ মার্চে নয়া দিগন্তের অনলাইন সংস্করণে প্রচারিত হয়।
বলা হয়ে থাকে, রোগ থেকে থেকে মুক্তি, মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পর রোগী, মক্কেল নাকি চিকিৎসক, উকিলকে পারতপক্ষে ধন্যবাদ জানাতেও আর দেখা করতে আসেন না। এটাই নাকি চিকিৎসক, উকিলের পেশাগত জীবনের করুণ দিক! গবেষণাধর্মী বইগুলোর বেলায় করুণতম দিক হচ্ছে, বইটি থেকে যার যতোটুকু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তথ্য নেয়া প্রয়োজন, তিনি ততোটুকুই নেন। তাতে অনেক সময় পাঠকের কাছে কোনো কোনো বই সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বার্তা পৌঁছায়!
যেমন, আমার বইটা থেকে (সেটা গবেষণাধর্মী বলে দাবি করছি না) শিমুল বিশ্বাস এমন একটা বাক্য নিয়েছেন, তা পড়ে কম বয়েসী অনেক পাঠকের মনে হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের পর মওলানা ভাসানী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য কী 'মহান' ভূমিকা রেখে গেছেন! শিমুল বিশ্বাসের ব্যবহার করা বাক্যটা আমার বইটির যে অধ্যায় থেকে নেয়া হয়েছে, সেই অধ্যায়েই আছে- মুক্তিযুদ্ধের পর মওলানা ভাসানীর মালিকানার পত্রিকাগুলো 'সাংবাদিকতার' নামে কীভাবে তখন ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম দেয়! মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর মালিকানার বেশিরভাগ পত্রিকার শীর্ষ পদের দায়িত্ব পান একাত্তরের ঘাতক, নারীঘাতী, দালাল, যুদ্ধাপরাধীরা। ভাসানীর মালিকানার 'হক কথা'র তথাকথিত সম্পাদক ইরফানুল বারী দালাল আইনে গ্রেপ্তার হলেও তা ছিল ভাসানীর বিবেচনায় গণমাধ্যম নিপীড়ন!
মুক্তিযুদ্ধের আগের অধ্যায়গুলোতে জনগণের মুক্তির জন্য লড়াইরত যে ভাসানীকে দেখা যায়, বিজয় লাভের পর মালিক, সম্পাদক ভাসানীকে দেখা যায় ঠিক এর উল্টো ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে যে ভাসানী পত্রিকা প্রকাশ করতেন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, সেই ভাসানীই বিজয়ের পর পত্রিকা প্রকাশ করেন ধর্মপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে পুর্নবাসনের জন্য। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য, গণমাধ্যমের ইতিহাস তাই বলে।
আমার প্রথম এবং দ্বিতীয় বইয়ে (৪৩ বছরে গণমাধ্যমের অর্জন-বিসর্জন, প্লাটফর্ম প্রকাশনী) যে বাক্যগুলো ভাসানীর গণমাধ্যমে অবদান সম্পর্কে লিখেছি, সেগুলো হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের পর তথাকথিত 'রাজনৈতিক সাংবাদিকতা' বাদ দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের জন্য তখন দরকার ছিল 'উন্নয়ন ও গঠনমূলক সাংবাদিকতা।' এ দায়িত্ব পালন করতে পারতেন মজলুম জননেতা ভাসানী। জাতির দুভার্গ্য, তা হয়নি। এরপর এক পর্যায়ে ঘাতক মোশতাক, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া বা এরশাদের আমলে 'উন্নয়ন সাংবাদিকতা' এমনভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, আজও তা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এ রাষ্ট্রে এখন যে সরকারই উন্নয়ন করুক, তা টিভি চ্যানেল, পত্রিকার সংবাদে যথাযথভাবে আসবে না। কারণ, 'উন্নয়ন সাংবাদিকতা'র ধারণাকে এদেশে বিতর্কিত করে গেছেন মোশতাক, জিয়া, এরশাদ!
লেখক: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক