logo ০৩ মে ২০২৫
সাংবাদিকদের ওপর হামলায় সিইসির দায়সারা বক্তব্য
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
২৮ এপ্রিল, ২০১৫ ১৯:০৭:৪৬
image

সকালটা ছিল অন্যরকম। চির ব্যস্ত ঢাকা একেবারেই ফাঁকা! হাতে গোনা কয়েকটা মোটরবাইক মাঝেমধ্যে এসে শাঁ শাঁ করে পার হয়ে যাচ্ছে। রিকশা ছিল প্রচুর। ক্রিং ক্রিং শব্দ নতুন মাত্রা যোগ করেছিল ঢাকার রাজপথে। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরেই নগরীর এই চিত্র। উৎসব ছিল মানুষের মনে। ভোটকেন্দ্রগুলোতেও ছিল সেই ছোঁয়া। কিন্তু সব যেন মিলিয়ে যাচ্ছিলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে।


রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর সাংবাদিকদের তুলে আনা হল এক কাতারে। শুরুর দিকে কেন্দ্রগুলোতে সাংবাদিকদের ঢোকার সুযোগ দেয়া হলেও বেলা ১১টার পর পাল্টে যায় চিত্র। কেন্দ্রে জারি হলো অলিখিত আদেশ ‘সাংবাদিক ঢোকাবারণ!’ যেখানেই সাংবাদিক সেখানেই গড়ে তোলা হল প্রতিরোধ। শোনা যাচ্ছিল, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে এজেন্টদের বের করে দেয়া হচ্ছে কেন্দ্র থেকে। তাদের পর সেই খড়গ নেমেছে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর।


দুপুর সোয়া ১২টায় সংবাদ সংগ্রহ করতে তখন আমি রাজধানীর শাহজাহানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানেই পৌঁছতেই ভিন্ন একটা চিত্র চোখে পড়লো। বুঝতে বাকি রইলো না, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।’ সময় লাগলো না। কেন্দ্রের ঢোকার পথেই কঠিন বাধা। গায়ের জামা ধরে টেনেহেঁচড়ে কেউ একজন নিয়ে এল কেন্দ্রের বাইরে। ‘এইখানে আহেন, যা কওয়ার আমার লগে কন।’ বিব্রত আমি তখন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। ‘কী বলবো? আগে তো ভেতর থেকে ঘুরে আসি।’ পরিচয় দিলাম। কাজ হলো না। চল্লিশোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি বললেন, ‘তাতো বুঝলাম সাংবাদিক। ভোট শান্তিপূর্ণ হচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই, আপনি চলে যান।’  ‘কেন চলে যাবো? এসেছি তো সংবাদ সংগ্রহে। আপনারা আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন?’ ছুটে এলেন আরও জনা পাঁচেক।


কিছু বলার আগেই ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যান একপাশে। তার পর খিস্তি-খেউর। ‘সমস্যা কি মিয়া ভাগেন এইখান থেকে। নইলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।’ বলতে বলতে একজন তেড়ে এসে বুকে ফিতায় ঝোলানো কার্ডটি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিড়ে নেন। গোটা ২০ জন ঘিরে ধরে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছিলো। আমি তখনও তাদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি। ওমনি দৌড়ে এলেন একজন বৃদ্ধ। চুল-দাড়ি যার সাদায় মাখামাখি। এসেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে রোড ডিভাইডারের ওপর ফেলে দেন তিনি। বলেন, ‘ওই মিয়া সাংবাদিক তোমারে কইলাম দূর হও, তারপরও এইহানে কী।’


ভাষা হারিয়ে ফেললাম। কিছু না বলে নির্বাক তাকিয়ে রইলাম জনৈক বৃদ্ধের দিকে। এও কি সম্ভব? বুঝলাম, এ দেশে সবই সম্ভব। বলে লাভ নেই। পুলিশও তখন নির্লিপ্ত। ছুটে গিয়েও লাভ হয়নি। বরং সতর্ক করে দিলেন তিনিও। পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল বললেন, ‘বুঝতেছেন না কী হচ্ছে? এইটাও যদি না বোঝেন তাইলে কেমন হবে। এখন কারো যাওয়া বারণ। উপরের নির্দেশ।’ উপস্থিত একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘চারটার পর আইসেন। তখন যতখুশি দেইখ্যা যাইয়েন। এহন সরেন। কাজ করতে দেন।’


শাহজাদপুরের এই কেন্দ্রটি বাঁশতলা কেন্দ্র বলেও পরিচিত। এখানে ভোট দিতে এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু ভোট না দিয়েই ফিরে যেতে হলো তাকে। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ভোট দিতে এসেছিলাম। বলছে ভোট হয়ে গেছে। এখন আর যাওয়ার দরকার নেই। কেন্দ্রেই ঢুকতে দেয়া হলো না।’


কেন্দ্রের ভেতর থেকে ঘুরে আসা এক ভোটার জানান, জোর করে ভেতরে ঢুকেছিলেন। কিন্তু ভোট দিতে পারেননি। ভেতরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে জয়নুল আবেদিন নামের ওই ভোটার বলেন, ‘দরজা বন্ধ করে ব্যালট পেপারে সিল মারা হচ্ছে। কয়েকটি বুথেই এই অবস্থা দেখেছি জানালার ফাঁক দিয়ে।’


ভোটারদের কেন ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না? জানতে চাইলে সরকারি দলের আরেক সমর্থক বলেন, ‘ভোটাররা কী করবে ভেতরে গিয়ে। যা করার আমরাই করে দিচ্ছি। ভোট দেওয়া লাগবে না।’ এসব কথপোকথনের সময় পুলিশ কর্মকর্তা সোহেলসহ অন্যরাও উপস্থিত ছিলেন।   


স্থানীয় ভোটাররা জানান, সরকারি দলের লোকজন গতকাল রাত থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য বলেছেন তাদের। বলেছেন, ভোটকেন্দ্রের কাছে গেলে সমস্যা আছে। ঝামেলা হবে। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থকরা এই প্রতিবেদককে জানান, গুলশান, বাড্ডা এলাকায় তাদের প্রার্থীর পক্ষে কোনো এজেন্টকে কেন্দ্রের ভেতর থাকতে দেয়া হচ্ছে না। হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়া হচ্ছে।


সরকারি দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছেন আরও বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাও। কোনো বিচার তারা পাননি। পাবেন বলেও মনে হয় না। যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ পষ্টাপষ্টি বলে দেন, ‘আপনারা যদি সবাই একসঙ্গে যান তাহলে তো সমস্যা হবেই।’ এরপরও যখন মঙ্গলবার বিকালে সাংবাদিকরা নিজেদের ওপর হামলা ও অপ্রীতিকর ঘটনার চিত্র তুলে ধরলেন তখন বললেন, ‘কেন্দ্রের নাম, সময়, যে দুর্ব্যবহার করেছে ওই কর্মকর্তার নাম ও পদবী জমা দেন আমরা ব্যবস্থা নেবো।’ প্রিয় সিইসি সাহেব, আপনি নাম, পদবী চাইতে পারেন; আমরা দিতেও পারি। কিন্তু যা ঘটেছে তা কি ফিরিয়ে নিতে পারবেন? কেন দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়া হল? এত কিছু রেখে কেন গণমাধ্যমে ওপর হামলা বলতে পারেন? বলা হয় গণমাধ্যম শক্তিশালী, স্বাধীন। এই জন্যই কি এত আক্রমণ? ভেবে দেখুন, ভেবে বলুন মি. সিইসি। এভাবে দায় এড়ানো যায় না।


[email protected]