আমার জন্ম সাতক্ষীরার রসুলপুরে। কিন্তু আমার পিতৃভূমি নিজের বাস হাকিমপুর। রসুলপুর থেকে প্রায় ১১ মাইল দূরের একটি গ্রাম। তবে গ্রামটি আলোকিত ও বর্ধিষ্ণু। রসুলপুর গ্রামটি সাতক্ষীরার পৌর এলাকারই একটি গ্রাম। এখানে ক্লাস ফাইভ থেকে বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলা থেকে মা যতটা, ততটাই আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছেন খালা (জাতীয় অধ্যাপক এবং শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খানের মা)। চার খালাত ভাই। চারজনই ছিলেন মেধাবী। বেড়ে ওঠা তাঁদের সঙ্গে। আর ছিল চারপাশের পরিবেশ। বিশেষ করে আমার নিজের গ্রাম হাকিমপুরের পরিবেশ ছিল স্বদেশিকতার হাওয়া। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন আত্মীয়স্বজন। মাওলানা আকরাম খাঁ এঁদের অন্যতম। তিনি মাদ্রাসা করেছেন বিকল্প শিক্ষায় গ্রামবাসীকে শিক্ষিত করতে। তাঁর জামাতা রেজ্জাক খান, যিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মুজাফফর আহমেদ, ডাঙ্গেদের সমসাময়িক। তিনিও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন স্থানীয় মানুষদের শিক্ষিত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে। খেলাফত আন্দোলনের জন্য জেহাদিদের ট্রেনিং হতো তুরস্কে। যেতে হতো আফগানিস্তান হয়ে। পূর্ববাংলা থেকে সেখানে যাওয়ার ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল এই গ্রাম। খেলাফত আন্দোলনের কালটি অবশ্য আমার জন্মের আগেই। তবে প্রভাব তো থেকেই যায়।
লেখাপড়ার শুরু সাতক্ষীরার বিখ্যাত পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। দেশের এক প্রান্তে হলেও পিএন স্কুল ছিল যথার্থ অগ্রসর আর বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। শিক্ষকদের কথা আজও স্মরণ করতে পারি। শৈশব থেকে কৈশোরের উত্তরণ পর্বটা তাঁদের জন্যই যথাযথ হতে পেরেছে। যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয় এক প্রাণময় কিশোর। ডাক নাম ডিকেন। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার এবং বীরোত্তম মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, পরবর্তী সময়ে বিমান বাহিনী প্রধান। পড়াশোনা আর নানা কর্মচাঞ্চল্যে সবার মন জয় করে নিতে সময় লাগেনি তার। ওই সময়, দেশভাগ পরবর্তী পর্বে, হিন্দু শিক্ষকরা এ বঙ্গে থাকাটা নিরাপদ মনে করছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে পিএন স্কুলের সিংহভাগ হিন্দু শিক্ষকদের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন ডিকেনের নেতৃত্বে ছাত্ররা। তাঁকে নিয়ে রয়েছে আরো অনেক ঘটনা আছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তর। বাংলা ১৩৫০। আর ইংরেজি ১৯৪২। আমার বয়স তখন মাত্র ৮। মনে আছে তাঁর সেসব দিন। চারদিকে বুভুক্ষ মানুষের মিছিল। চরম দূর্বিষহ অবস্থা। প্রতিদিন মরছে মানুষ। সাতক্ষীরার পাকা রাস্তা দিয়ে লোহার চাকা লাগানো মড়া ফেলার গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ডোমেরা। ঘড়ঘড়ানি আওয়াজ শুনলেই বুঝে যেতাম, আরও এক হতভাগ্যের জীবনে যতি পড়ল।
পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল দেশ। তখন এমন কোন ছাত্র ছিল না যে আন্দোলনে যোগ দেয়নি। ঢাকায় এসে উঠেছিলাম মামার বাসায়। মামার বাসাটা আবার পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড আখড়া। মাঝে মধ্যেই ডাকসাইটে নেতারা আসতেন। থাকতেন আত্মগোপন করে। মনি সিং, খোকা রায়, নেপাল নাগ, সালাম ভাই ওরফে বারীন দত্ত, আলতাফ আলী। দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে। একটু দেরিতে হলেও অনিল মুখার্জী ও জ্ঞান চক্রবর্তীর ন্যায় বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এভাবেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। যৌবনের চৌকাঠে পা। অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যাচ্ছে জীবনের গতিপথ। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসছে বিপ্লবের নেশা।
বাহান্ন পরবর্তী সময়ে বাড়ি থেকে আর্থিক সমর্থন কিছুটা অনিয়মিত হতে থাকে। বিশেষত দু’দেশে অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা ব্যবস্থা চালু হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের বাড়ি থেকে টাকা পয়সা পাঠানো গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিল। তার সঙ্গে যোগ হয় বিপ্লবের নেশা। তিপান্ন সালে কেজি মুস্তাফা বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। সাপ্তাহিকটির প্রকাশক ছিলেন অ্যাডভোকেট দেওয়ান মাহবুব আলী। এককালের প্রখ্যাত ন্যাপ নেতা। তবে পত্রিকাটি বের হওয়ার আগেই বাতিল করে দেয়া হয় এর নিবন্ধন। তবে তার আগেই পত্রিকা ছেপে হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া গেল। এবভাবেই হাতেখড়ি হয়ে যায় সাংবাদিকতা জীবনে। সঙ্গে আরও ছিলেন আলী আকসাদ, হাসান হাফিজুর রহমান। আর ছিলেন সুলতান ভাই। এবং পুথিপত্র নামে তাঁর ছোট একটা বইয়ের দোকান ছিল বক্সীবাজারে। ছাপড়া ঘর। সেখানে গিয়ে পড়তাম নানা ধরনের বই। বিশেষত বাম চিন্তাধারার। মার্ক্সিজমের অ্যাসথেটিক্স জানতে ক্রিস্টোফার কডওয়েল যেমন পড়তাম, তেমনি অন্য সব বইও।
১৯৫৫ সালে সংবাদ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে একেবারেই ভগ্নদশার চরমে ছিল। আহমেদুল কবির সাহেব ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সেই সাথে আরো তিনজন ডিরেক্টর ছিলেনÑনাসির উদ্দীন সাহেব, উনি এক সময় সংবাদের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন; সৈয়দ নূরউদ্দীন সাহেব, উনি ছিলেন বার্তা সম্পাদক; আরেকজন ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, উনি ছিলেন সম্পাদক। কিন্তু পত্রিকার সত্যিকার অর্থে আর্থিক দিক এবং ব্যবসস্থাপনার পুরো দায়িত্বটাই ছিল আহমেদুল কবিরের ঘাড়ে। আহমেদুল কবির সাহেব ছিলেন করাচিতে ডেপুটি চিফ কন্ট্রোলার এক্সপার্ট-ইমপোর্ট। ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে তিনি এই দেশে প্রথম একটা পেন্সিল অর্থাৎ উড পেন্সিল যাকে বলে সেই শিল্প স্থাপন করলেন। নাম ছিল এসেনসিয়াল ইন্ডাষ্ট্রিজ। কোকাকোলা এ দেশে চালু হবার আগে ভিটাকোলা বলে একটা পানীয় চালু করেছিলেন আহমেদুল কবির।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয় হলো। এর ফলে নতুন একটা রাজনৈতিক অবস্থার উদ্ভব ঘটলো। নির্বাচনের আগে নুরুল আমিনের পত্রিকা ছিল সংবাদ। কিন্তু পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আর যেহেতু পত্রিকার অনেক সাংবাদিকেরা প্রগতিশীল ছিলেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গীও ওই রকমই ছিল। সুতরাং তারা এই পত্রিকাটিকে চালু রাখার এবং একে প্রগতিশীল ধারায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। সে প্রক্রিয়াতে এর মালিকানায় যুক্ত হলেন আহমেদুল কবির সাহেব। আহমেদুল কবির এবং তার বড় ভাই খায়রুল কবির সাহেবÑযিনি সংবাদের সম্পাদক ছিলেন, এরা ছিলেন নুরুল আমিনের ভাগ্নে। কাগজটা তারা চালু রাখলেন। কিন্তু বেতনে ঘাটতি পড়া শুরু হল। ’৫৫ সালে অনেক নামকরা সাংবাদিকরাই ওখানে কাজ করতেন। কবি হাবিবুর রহমান থেকে শুরু করে রাজ্জাক সাহেবÑযিনি একসময় দৈনিক বার্তা’র সম্পাদক হয়েছিলেন, এরপর আদমজী পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক ‘কন্যা-কুমারী’র লেখক, তাঁরা সবাই ওখানে কাজ করতেন। সানাউল্লাহ নূরীও সেখানে কাজ করতেন। রনেশদা তখনো জেলে। সবাই কাজ করেন। কিন্তু তখনো কাগজটা ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে, তারা সবাই চিন্তা করেন প্রগতিশীল ধারায় নিয়ে যাবার কিন্তু কাগজে রিফ্লেকশনটা ওভাবে হয় না। সেটা একটা রুটিন খবরের কাগজ হিসেবে আসে। তখন দুইজন রিপোর্টার ছিলেন, একজন ফয়েজ আহমেদ সাহেব, আরেকজন ছিলেন কুদ্দুস বলে একজন। কুদ্দুস সাহেব পরে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রথমে পাবলিক রিলেশান অফিসার, পরে ডিরেক্টর পর্যন্ত হয়েছিলেন। প্রথমে কুদ্দুস সাহেব চলে গেলেন। তখন ফয়েজ সাহেব একাই ছিলেন। তারপরে ফয়েজ সাহেবও ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। এ রকম একটা অবস্থা চলছিল। প্রত্যেকদিনই দেখা গেল কাজ বন্ধ হয়, বেতন নেই, এসব চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালের শুরুতে কেজি মুস্তাফা সাহেবকে নিয়ে আসা হল। তারপরেও যে আর্থিক দুর্গতি ছিল সেটা কোনোমতেই যায় না। ১৯৫৫ সালের দিকে আমি প্রথমে কিছুদিন অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করেছি। ১৯৫৬ সালের মার্চেও মাসের একটি ঘটনা। একদিন লোকজন কেউ নেই, কোনো শিফট ইন-চার্জ, রিপোর্টার, সাব-এডিটর কেউই অফিসে আসেননি। আমি তো জুনিয়র মোষ্ট অ্যাপ্রেন্টিস, আমি কাজ করছি। এটা ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চের ঘটনা। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, করাচীর এক পার্কে মুসলিম লীগের মিটিং। সেখানে প্রচন্ড বিক্ষোভ হয় এবং রেডিও পাকিস্তান সেটা রিলে করছিল। আমি এক মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। পরদিন নিজে সেটা নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। অফিসে পিয়ন যারা ছিল, তারা নূরউদ্দীন সাহেবকে খবর দিল। নূরউদ্দীন ভাই নিউজ এডিটর এবং ডিরেক্টরও। আমি কিছু কিছু কাজ করে রেখে দিয়েছি। নূরউদ্দীন সাহেব এসে বললেন, ‘আপনি একাই বসে বসে এসব কাজ করছেন, আপনি এটা কি করে করবেন।’ তারপর দেখলাম উনি আমার নিউজগুলো নিয়ে সব ছেড়ে দিলেন। আমাকে বললেন, ‘আপনি দেখা করবেন তো!’ আমি দেখা করার পর বললেন, ‘ঠিক আছে কাল থেকে এসে জয়েন করেন।’ কিন্তু আমি তো কাজ করছিলাম অনেকদিন যাবৎ। যাই হোক, তারপরে আর কোনো পাত্তা নেই। এই করে দিন চলে গেল। ’৫৮ সালে কেজি ভাই যখন আসলেন, কিছু পরিবর্তন এলো। যদিও আর্থিক দৈন্য প্রায় সমানই রয়ে গেলো। এই সংবাদের প্রথম দিককার অবস্থা।
এরপর কেজি ভাই সংবাদ ছেড়ে চলে গেলেন। কারণ প্রতিদিন ঝগড়া করতে হয়। আবার ওনার পার্টি লাইন হচ্ছে কাগজ চালানো। বেতন না পেলে লোকে কাজ করবে কী? তিনমাস-চারমাস করে বেতন বাকি থাকে। আমি যখন প্রথম এখানে ঢুকলাম তখন বেতন ছিল ষাট টাকা। তাও একমাস, দুমাস, তিনমাস পরে আজকে দশ টাকা, কালকে পনের টাকা, এভাবে চলছিল। দ্বিতীয় মাসে আমাকে বেতন বাড়িয়ে দেবার কথা বলল, ‘ও কাজ ভালো করে।’ তখন বেতন হলো আশি টাকা। যারা তখন সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করত তাদের সমান। বেতন বাড়ালে কি হবে? বেতন তো পাওয়া যায় না। সে কারণেই কেজি ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের গোলমাল শুরু হলো। গোলমালের পরে কেজি ভাই চলে গিয়ে অবজারভারে জয়েন করলেন। ১৯৫৬ সালেই একদিন আমরা কাজ করছি। মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের যেদিন সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলেন ওইদিন আলেকজেন্দ্রিয়াতে একটা মিটিং ছিল। তখন ঘোষণা এলো, “কায়রো রেডিও সেইড নাসের হ্যাজ ন্যাশনালাইজড দ্য সুয়েজ ক্যানেল।” নিউজটা ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। সারা পাকিস্তানে হইচই পড়ে গেল। হামিদুল হক চৌধুরী তখন ফরেন মিনিষ্টার। তারা বললেন, ‘না এটা আমরা সমর্থন করি না।’ কারণ তাদের লাইন ছিল ব্রিটিশ আর ফরাসি সরকারের তাঁবেদারির। পরে সুয়েজে অ্যাটাক করল বিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বলল, ২৪ ঘন্টার মধ্যে হামলা বন্ধ না করলে লন্ডনে রকেট হামলা করা হবে। তখন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। আবার ১৯৫৮ সালের সকালের শিফটে একদিন সকালে কাজ করছি, রেডিওতে ঘোষণা এলো, ইরাক রিপাবলিক হয়ে গেছে, রাজতন্ত্র উৎখাত করা হয়েছে। এরকম নানান ধরনের ঘটনা।
১৯৫৮ সালে মার্শাল ল হল। তখন হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলা, রাত প্রায় বারোটা। মার্শাল ল হবার আগে ইলেকশনের প্রস্তুতি চলছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইলেকশন করবেন। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী। সোহরাওয়ার্দী চলে যাবার পরে ফিরোজ খান নূন প্রধানমন্ত্রী হলেন। সোহরাওয়ার্দী আবার ল মিনিষ্টার হলেন। তখন ঢাকায় নাজাত বলে একটা কাগজ বের হয়েছিল। সানাউল্লাহ নূরী এডিটর হিসেবে চলে গেলেন। আমাদের মতন যারা তাদেরকে বলতেন, ‘আরে আশি টাকা বেতনের কি চাকরি করবা? আটশ টাকা বেতন দেব চলে আস।’ আর মার্শাল ল হবার পরে তো সংবাদের অবস্থা আরো খারাপ।
মেশিনারির দিক থেকে তখন ছিল ফ্ল্যাট বেড প্রিন্টিং প্রেস। ফ্ল্যাট বেড প্রিন্টিং প্রেস মানে ঘটাং ঘটাং করে ছাপে। কম্পোজ ছিল পুরো হাতে। পা দিয়ে চাপ দিয়ে প্রুফ তুলে দিত আর সেই প্রুফ দেখে দিতে হত। কাগজের রিপোর্টারের সংখ্যা এক কি বড় জোর দুজন। কোনো কাগজে যদি বেশী রিপোর্টার থাকে তাহলে তিনজন। যেমন ইত্তেফাকে রিপোর্টারের সংখ্যা বেশী ছিল। এম আর আখতার মুকুলসহ আরো দু-তিনিজন ছিলেন, খেলার রিপোর্টার আলাদা। অধিকাংশই খেলার রিপোর্টার পার্ট-টাইম করত। একজন হয়ত সাব-এডিটর, সে খেলার রিপোর্ট করত। যেমন সংবাদে আমাদের সঙ্গে আওয়াল খান চাকরি করত, ও খেলার রিপোর্ট করত। ম্যান পাওয়ার ছিল খুবই পুওর। আমার বই “আজ ও ফিরে দেখা কাল” সেটার মধ্যে আছে এ সমস্ত ঘটনা।
তখন তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে এত আদিম, ঢাকার টেলিফোন সিস্টেমটাই ছিল ’৫৮ এর মার্শাল ল এর আগে ম্যানুয়্যাল টেলিফোন। অর্থাৎ, টেলিফোন তুলে বলতে হবে, হ্যালো অপারেটর। তখন এক মহিলা অপারেটর বলবে, কত নম্বর চান? ধরুন বলা হলো, কৃষি সচিবকে লাগান। সেই কৃষি সচিবের নম্বর হয়তবা ৩০১। সেই ৩০১টা টেলিফোনের পর আরো ৫০০ টেলিফোন আছে ঢাকায়, এরকম। এই ছিল টেলিফোন সিস্টেম। টেলিফোন সিস্টেমটাই যেখানে এ রকম, সেখানে বুঝতে পারছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থাটা কোন পর্যায়ে ছিল। এখন মোবাইলে শুধু কথাই বলা যায় না, মেসেজও পাঠানো যায়। ইন্টারনেটও আছে। এটা তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
তখন শুধুমাত্র টেলিপ্রিন্টার। টেলিপ্রিন্টারের নিউজ, এটাই বসে বসে লোকে অনুবাদ করত। এবং ভালো সাংবাদিক তথা সাব-এডিটরের ক্রাইটেরিইয়া ছিল কে কত অনুবাদ করতে পারল। যে যত বেশি অনুবাদ করতে পারততো, সে তত বড় সাংবাদিক। বহু নিউজ অনুবাদ করে, এর মানেই হলো সবচেয়ে ভাল সাংবাদিক। তবে কেউ চিন্তা করে দেখত না, নিউজটা নিয়ে বাংলা ভাষায় নিজের মতো করে তৈরি করে দিই। যেভাবে থাকত ওভাবেই অনুবাদ করত। এমনকি ইন্ট্রো পর্যন্ত কেউ পরিবর্তন করত না। যখন মার্শাল ল আসল তখন তো আর প্রশ্নই আসে না। কারণ মার্শাল ল এমন ভীতির সঞ্চার করেছিল, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট পলিসি ডিক্লেয়ার্ড হচ্ছে তখন লিখতে হতো আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত নীতি ঘোষনা। সংক্রান্তটা আবার কোথা থেকে আসলো এখানে? এই অব্যয়ের ভাব তো এখানে দরকার নেই। পরবর্তীতে এটা চালু হয়ে গেছে আমদানি-রপ্তানি নীতি। এ রকমই ছিলো ভীতি। অর্থাৎ যা যা লেখা আছে তার এদিক ওদিক যাতে না হয়। ফলে সাংবাদিকতাও ওই পর্যায়ের ছিল তখন।
আমার বিয়ে হয়েছে ’৬২ সালে। একটা বাচ্চাও হয়েছে তখন। সব জায়গায় ওয়েজ বোর্ড হয়েছে কিন্ত সংবাদে হয়নি। ওয়েজবোর্ড হয় ’৬০ সালে। কিন্তু ’৬২ সালেও সেটা সংবাদে হয়নি। ওয়েজবোর্ডে প্রথমে নিয়ম ছিল ২৭৫ টাকা এ-ক্যাটাগরি কাগজের জন্য। ২৫০ টাকা বি-ক্যাটাগরি কাগজের জন্য। সংবাদ ছিল বি-ক্যাটাগরির। আমাকে দিত ২৫০, নিউজ এডিটরের বেতন। তাও আবার তিন মাস চারমাস পরপর। তারপরেও আজকে পাঁচ টাকা, দশ টাকা একভাবে নিতে নিতে তাতেও সম্ভব হত না। তখন চরম আর্থিক দৈন্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে, বাচ্চার দুধ কিনতে হয়, সে টাকা বাকি পড়েছে। সংসার চালানো তো আছেই। সকাল বেলা উঠেই অফিসে যেতাম। রিপোর্টার ছিল দুজন। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছেÑলাহোরে সেমিনার হয়েছে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এসেছে, নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছি, কাগজের রিপোর্টিং এবং মেকআপে পরিবর্তন এসেছে। আমরা দুজন রিপোর্টার নিলাম। তিনজন হলো। এরা হলেন- সলিমুল্লাহ, ডিএ রশীদ এবং শামসুল আরেফিন খান। তখন বেলা ২টার সময় এসেম্বলি মিটিং বসত। অ্যাসেম্বলিতে যেতাম কাভার করার জন্য। অ্যাসেম্বলি কাভার করার জন্য একজন রিপোর্টার থাকত। কিন্তু আমিও যেতাম। একজন তো আর কাভার করতে পারত না। তবে মূল আকর্ষণটা ছিল দশটা টাকা পাওয়া যেত। দশটা টাকা যাওয়ার জন্য দিত ম্যানেজমেন্ট। কারো গাড়িতে অথবা একজনের সাথে শেয়ারে রিকশায় যেতাম এক-দুই টাকা দিয়ে, বাকি টাকাটা বেঁচে যেত। ফিরে আসার পথে রেডিওতে অ্যাসেম্বলির নিউজটা লিখে দিয়ে আসতাম। এতে পাঁচ টাকা পাওয়া যেত। রেডিওর সে কাজ করে রাত্রি ৯টায় আবার অফিসে। কাজ শেষ করে রাত্রি ২টার সময় বাড়ি যেতাম। এভাবে চলেছে। দেখলাম, এটা খুবই অসম্ভব হয়ে দাড়াচ্ছে। সালাহউদ্দীন মোহাম্মদ ছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। সালাউদ্দীন মোহাম্মদকে এ দেশের উর্দূ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলা যায়। তিনি উর্দু ভাষার কবি। বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। পরে আইয়ুব খানের সময় থেকে তার পতন ঘটা শুরু হল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর রোল খুব একটা ভাল ছিল না। কিন্তু খুব বিরোধিতাও করেননি। পরে মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুই তাঁকে পার করে দিয়েছেন এখান থেকে। সালহউদ্দীন মোহাম্মদরা তখন পিকিংপন্থী। আমাকে বললেন, ‘আপনি আসেন, দৈনিক পাকিস্তান বেরুবে, জয়েন করেন।’ দৈনিক পাকিস্থানের নিউজ এডিটর ছিলেন মোজাম্মেল সাহেব। পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রেসট্রাষ্ট করেছিলেন আইয়ুব খান পাকিস্তানের ২০ সেরা ধনীকে নিয়ে। ওনারাই পত্রিকা বের করেছিলেন। উনি বললেন, ‘নিউজ এডিটর তো আপনাকে করার কথা হয়েছিল। কিন্তু আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব বললেন, আপনি আসবেন না। এজন্য মোজাম্মেল সাহেবকে করা হয়েছে।” বললাম, ‘আমাকে তো কেউ বলে নি। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর নিউজ এডিটরের কাজ করব না। কারণ ওই সংবাদের অভিজ্ঞতার কারণে আমি আর এর মধ্যে নেই।’ বললেন, ‘আচ্ছা জয়েন্ট নিউজ এডিটরই হোক বা চিফ সাব-এডিটর যে নামেই হোক আপনাকে জয়েন করতে হবে।’ জয়েন করলাম। শুরু হলো দৈনিক পাকিস্তান। ইত্তেফাকে সিরাজ ভাই একটা স্টোরি করেছিলেন ছেলে হারানো নিয়ে। সেটা নিয়ে খুব হৈ চৈ হলো। সংবাদে আমরা নিষিদ্ধ পল্লীর কাহিনী নিয়ে একটা স্টোরি করেছিলাম। খুবই সেনসেশনাল ছিল। কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না। দৈনিক পাকিস্তানে জয়েন করার পরে দৈনিক সংবাদে আমাদের যে এক্সপেরিমেন্টগুলো ছিলÑনতুন ধারার সাংবাদিকতা, তার মেকআপের ধারা, এগুলো আবার শুরু করলাম। এখানে তো বেশীরভাগই নতুন পাওয়া গেছে। প্রথমে ১০ জন রিপোর্টার নতুন নেয়া হলো। মানে দৈনিক পাকিস্তানে স্রেফ রিপোর্টিংয়ের কাজই করত ১০ জন। খেলার পাতায় কাজ করত তিনজন। ফিচার, হিউম্যান স্টোরি এগুলো বড় বড় করে ছাপা হলো। যখন নতুন নতুন রিপোর্টার নেওয়া হলো, তখন বলা হলো দৈনিক পাকিস্তান একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। দৈনিক পাকিস্তানে যখন জয়েন করলাম, সবাই খুব গালাগালি করত। বলত, আইয়ুব খানের দালাল, প্রেস ট্রাস্টের কাগজ, বাঙালীর শক্র এসব। ওয়াহিদুল হক, হাবিবুর রহমান মিলনের বড় ভাই, আমাদের বন্ধু আহমেদুর রহমান। আহমেদুর রহমান ইত্তেফাকে ভীমরুল ছদ্মনামে মিঠেকড়া কলাম লিখতেন। কায়রোর পিআইএর বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। আহমেদুর রহমান আমাদের বলতেন, ‘কি ১০ পয়সার পাকিন্তানের খবর কি?’ মানে তখন দৈনিক পাকিস্তান ১০ পয়সা করে বিক্রি হত, এজন্য বলত ১০ পয়সার পাকিস্তানের খবর কি? বলতাম, ‘দ্যাখো একসময় বুঝবা দৈনিক পাকিস্তানে আমরা যে অসাস্প্রদায়িকতার লাইন পার্সু করছি, তোমরা বলবে, এটাই সাংবাদিকতার একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করলো। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে দৈনিক পাকিস্তান বেরিয়েছে। ৬৪ সালের ফ্রেব্র“য়ারিতে ঢাকায় দাঙ্গা হয়েছিল। ফেব্র“য়ারিতে আইয়ুব বিরোধী বিক্ষাভের মোড়টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সবুর খান দাঙ্গাটা লাগালো একুশে ফেব্র“য়ারিরর কিছু আগে। ওখানে তো ’৬৪’র নভেম্বরে জয়েন করলাম। আমির হোসেন বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন। সাবেক আইজি পুলিশ এবং যৌন বিজ্ঞান বইয়ের বিখ্যাত লেখক আবুল হাসনাতের ছোট ভাই। এই আমির হোসেন থাকতেন গোপীবাগে রেললাইনের ধারেকাছে। বিহারীরা যখন হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল, আমির হোসেন বাধা দিয়েছিলেন। যার কারণে তাকে মেরে ফেলা হয়। রেললাইনের উপরেই তাঁকে খুন করে। এটা নিয়ে খুব হৈচৈ হয়েছিল। দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দাঙ্গা বন্ধ হবে না? আমরা গভর্নর হাউজ আক্রমণ করলে এক দিনেই দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যাবে।’ এ হুমকির পরদিনই দাঙ্গা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আমাদের বন্ধু Ñআলী আশরাফ চিফ রিপোর্টার, হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছে। আমি মোরশেদকে বললাম, ‘তুমি ওই ভদ্রলোকের (আমির হোসেন) বাড়ি যাবে। সে ভদ্রলোককে তো মেরে ফেলেছে। আমরা কেউ মনেও রাখিনি তাকে। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার জন্য একটা লোক মারা গেছে, তাঁর পরিবার এখন কি অবস্থায় আছে বের কর।’ সে এসে বলল, “কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। বাড়িতে কউ নেই। কি লিখব?” খুঁজতে খুঁজতে বের হলো যে উনি কিছু ফুল গাছ, কিছু রজনীগন্ধার গাছ লাগিয়েছিলেন। শুধু রাত্রিবেলা ওগুলো ফুটে। এটার উপর ভিত্তি করে সে রিপোর্টটা লিখল। রিপোর্টটা খুব হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। প্রথম দিকে দৈনিক পাকিস্তানের চেয়ারম্যান ছিলেন আখতার হোসেন। আইয়ুব খানের মার্শাল ল’র সময় আজিজ আহমেদ আর আখতার হোসেন দু’জন আইসিএস ছিলেন শীর্ষ স্থানীয় আমলা। তারাও ডেপুটি চিফ মার্শাল ল ছিলেন। আখতার হোসেন আমাদের বললেন, ‘তোমরা আইয়ুব খানের ইলেকশনের সময় স্ট্রিকলি নিউট্রাল থাকবে। যদি আইয়ুব খানের ডবল কলাম ছবি দাও তাহলে ফাতেমা জিন্নাহরও ডবল কলাম ছবি দেবে।’ একদিন, আইয়ুব খান বক্তৃতা দিচ্ছে এ রকম একটা ছবি আমরা ছোট করে ডাবল কলামে ছাপিয়েছিলাম। পাশে মিস জিন্নাহর সিঙ্গেল কলামের একটা ছবি। পরদিন কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল, কেন মিস জিন্নাহর সিঙ্গেল কলাম ছবি ছাপা হলো? মানে তারা দেখাতে চেয়েছিল, তারা খুব নিরপেক্ষ।
হ্যাঁ, তখন নিউজ এডিটর। আসলে মোজাম্মেল সাহেবরা একটু পুরনো ধাঁচের সাংবাদিক ছিলেন। লাহোরে একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। মোজাম্মেল সাহেবও ছিলেন। ওখান থেকেই পরিচয়। বানান ঠিক আছে কি না, ব্যাকরণ ঠিক আছে কি না, এসবের উপর উনি বেশী জোর দিতেন।
খবরের কগজের ক্ষেত্রে সৈয়দ নূরউদ্দীন সাহেব এদেশে একটা জিনিস চালু করেন সেটা হচ্ছে, ফলোআপ। যে জিনিসটা আমাদের দেশে আগে ছিল না অথবা নেগলেক্টেড ছিল। লাহোরে আমরা যে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফিরে এলে উনি বললেন, ‘একটা জিনিস কর, হেডিং থেকে শুরু করে নিউজ পর্যন্ত আজকে যেটা গেছে সেটা রিপিট করার তো মানে নেই। ফলোআপ ঘটনা কি দাঁড়াচ্ছে এটা দেখো।” তখন থেকে ফলোআপটা উনি জোরেশোরে শুরু করলেন। আমরাও সেটা পারসু করতে শুরু করলাম। শুরু হলো ফলোআপ নিউজ। এরকম ঘটনাও ঘটেছে যে, একটা গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়ে পাঁচজন মারা গেছে। এই পাঁচজনের পরিবারের কি অবস্থা সেটা কোনো খবরের কগজের লোকজন আগে ভুলেও চিন্তা করত না। অথবা ড্রাইভার পলাতক আছে তার পরিবারের কি অবস্থা, এগুলো আস্তে আস্তে ফলোআপ হিসেবে আসতে শুরু করল। তারপরে ভাষার দিক থেকে, সংবাদেও তখনো সাধু ভাষাই চালু ছিল। দৈনিক পাকিস্থানে যখন কাজ শুরু করি তখনো সাধু ভাষাই ছিল। আমরা নিউজে যারা ছিলাম তারা সবাই ছিলাম এনলাইটেন্ড চিন্তার লোক। আর এডিটোরিয়ালে যারা ছিলেন তারা সকলেই উল্টো চিন্তার লোক। মানে রক্ষনশীল আর কি। তখন কম্প্রোমাইজ হলো যে, রিপোর্ট চালু হবে কথ্য ভাষায় আর এডিটোরিয়াল হবে সাধু ভাষায়। যেমন, একটা হিউম্যান স্টোরি, এটা সাধু ভাষায় চালু করলে তো আর পড়া যাবে না। আমরা ওটাকে কথ্য ভাষায় চালু করলাম। তখন লোকে বলতে লাগল এটাই ভাল তো! আমার মনে আছে একদিন আতাউর রহমান সাহেব আমাকে বললেন, “তোমরা যে কি করছ! তোমরা বাংলা ভাষার তেরোটা বাজিয়ে দেবে।” আমি বললাম, কেন? উনি বললেন যে, “’কচ্ছি,’ ‘খাচ্ছি’, এগুলো কি আমাদের ভাষা? কোলকাতার ভাষা এখানে চালু করছ।” আমি বললাম বাড়িতে আপনি কি বলেন, ‘করিতেছি’ বলেন? উনি বললেন, “না ‘করতাছি’ বলি।” আমি বললাম যে, ‘করতাছি’ বলেন কেন, ‘করিতেছি’ বললেই পারেন। উনি চুপ করে গেলেন।
এটাও ছিল ওই সংবাদেরই জের। সংবাদেও আমরা এই মেকআপই করেছি। কিন্তু সংবাদে হতো কি, জহুর ভাই বলতেন, “আপনি তো ট্রেইনিং নিয়ে আসছেন কিছু ছবি দিয়ে নতুনভাবে মেকআপ করান।” আমিও সে অনুযায়ি ছবি-টবি করতাম। ছবি-টবি করে দিলাম কিন্ত পরে দ্যাখা গেল দুদিন পরে সেই ছবি সব শেষ। এর টাইপ ভেঙ্গে তচনছ হয়ে গেছে, কেউ আর মনে রাখে না। কিন্ত দৈনিক পাকিস্থানে এই জিনিসগুলো নতুনভাবে চালু হলো জন্য এই কাগজের নাম হয়ে গেল।
ফিচারের সবই ভাল ছিল। দৈনিক পাকিস্থানে আমরা তো ফিচার পাতাই চালু করলাম একটা। দৈনিক পাকিস্থান রিপোর্টিংয়ে কোনো সময় অবজেক্টিভিটি বাদ দিয়ে করেনি। সরকারে বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্ত সেটি অবজেক্টিভিটিতে হুবহু ছাপা হয়েছে। আসাদকে মেরেছে, যেদিন কাগজ জ্বালালো ২০ তারিখে, সেদিনের কাগজে যে রিপোর্ট বের হয়েছিল, আইয়ুব খান-মোনেম খা এর বিরুদ্ধে অন্য কোনো কাগজে এই রকম রিপোর্ট ছাপা হয় নি। তারপরেও মডেল হয়ে গিয়েছিল পোড়ানো। পরে ছাত্ররা এসে বলেছিল, “কি সর্বনাশ আপনারা ওই বিল্ডিংয়ে ছিলেন!” আমরা ১২’ই নভে¤॥^রের সাইক্লোন কাভার করার জন্য দৈনিক পাকিস্থানের অফিসে বসে রেডিও বিবিসি মনিটর করে, অল ইন্ডিয়া রেডিও কি বলছে, একজন পাইলট যাচ্ছিলেন ব্রিটিশ এয়ারের সে কি দেখছে- এই সব শুনে রাত্রি বেলা আমি নিজে রিপোর্টার মোবিলাইজ করতে গেলাম। তখন দেখলাম একমাত্র রিপোর্টার নজির আহমেদ আমাদের অফিসের কাছে থাকে, ওকে পাওয়া যায়, আর কেউ নেই। তখন মঞ্জুর আহমদ ডেস্কে কাজ করত। সে আবার রিপোর্টিংয়ে খুব উৎসাহী ছিল। এই মঞ্জুরকে আর নির্মল সেনকে পাঠালাম রিপোর্ট করার জন্য। নির্মল সেন তখন শিফট-ইন-চার্জ। নির্মল সেন বললেন, আমি যাব। আমি বললাম, ঠিক আছে যান। এরপর নোয়াখালি আর ওইসব অঞ্চল ঘুরে খবর ছাপা হলো। বিরাট একটা ছবি ছাপা হয়েছিল- একটা লাশ পড়ে আছে আর তার বুকের উপর একটা সাপ মরে আছে। আমাদের পত্রিকায় পাঁচলাখ মৃতের সংখ্যা ছাপা হলো। সেদিন রাত্রি তিনটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত পত্রিকা ছাপা হয়েছে। একেকটা কাগজ বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা করে। একদিনে বিক্রি হয়েছিল দশলক্ষ টাকার কাগজ।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে আমরা কগজটা করে রেখেছিলাম কিন্ত সেটা আর পরেরদিন বের করা যায় নি। কারন কারফিউ ছিল। প্রথমে শিরোনাম ছিল- সেনাবাহিনী শহরে ঢুকে পড়েছে। পরে সেটি পরিবর্তন করে করা হলো- ঢাকা আক্রান্ত। দুটো হেডিং ছিল কিন্ত কোনোটাই বের হয় নি। পরে ডামি ছাপা হয়েছিল একবার। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেখা যেত ঢাকার বাইরে কোথাও কাগজ যাচ্ছে না। এদিকে আরিচা ঘাট পর্যন্ত যায়, ওদিকে কাঁচপুর ঘাট, আর নরসিংদী, এর বাইরে কোথাও যায় না। এই কাগজ যে যায় না, আমরা কি ভাবে কাগজ চালাব। এখানে এই ঢাকা শহরে তো দশ পনের হাজার কপি চলে। আর পনের হাজার কপি তো বাইরে চলে। আমরা ঠিক করলাম এই কাগজ এমন ভাবে করতে হবে যাতে ঢাকাতেই লাখ খানেক লোক পড়ে। তখন অসহোযোগ আন্দোলন চলছে। দৈনিক পাকিস্থান সেই অসহোযোগ আন্দোলনের বস্তুত: মুখপত্র হয়ে গেল। আমদের কাগজে বিভিন্ন সি¤॥^ল ছিল, নির্দেশটা কি- সেটার জন্য একটা সিম্বল, এভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এসমস্ত করে পুরো ঢাকায় প্রায় একলাখ কপি চলত।
এখন যেটা হয়েছে, বলছে দশ থেকে বারোকোটি মানুষের হাতে মোবাইল রয়েছে। তাহলে ধরা যায় দশকোটি মোবাইলের আটকোটিরই ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্ত এত সুবিধা থাকা সত্বেও আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হলো, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একই জিনিস বার বার রিপিট করছে। একই জিনিস বার বার দর্শকদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। সকালে যে জিনিস ঘটেছে রাত্রি বারোটাতেও সেটাই দেখাচ্ছে। এর ফলে মনে হচ্ছে কেউ কেউ মহামানব হয়ে যাচ্ছে আর কেউ কেউ দৈত্য হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি এটা মহাঅপরাধ। কোনো নেতা-নেত্রী যদি সকালবেলা বলে থাকে একটা কথা এবং সন্ধ্যার সময় তিনি সেটা কার্যকর করবেন। দেখা গেল সেখানে ফাকা ময়দান তারপরও সন্ধ্যা পর্যন্ত সেটা চলছে। এটা তো একটা অপরাধ। অথচ পাশাপাশি একটা উদাহরণ আছে, এনডিটিভি(ভারত) একটি নিউজ চ্যানেল। সেই চ্যানেল কিন্ত কোনো জিনিস দুবার করে রিপিট করে না। সন্ধ্যার পর থেকে তারা নানান রকম ডিবেট দেখাচ্ছে, আলোচনা দেখাচ্ছে। আমদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে অনেক বেশি করে সেগুলো দেখান হয়। এবং সেখানে যাদের আনা হয় তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন বিষয়ে এক্সপার্ট। আমাদের দেশে কাদের নিয়ে আসে?
ইলেকট্রনিক মিডিয়ামের পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়াম এগুতে পারে নি। কারন প্রিন্টে যে জিনিসগুলো হওয়া উচিত ছিল- এখন তো মাত্র দুটো এডিশন বের করে। অথচ তিন থেকে চারটা এডিশন বের করা উচিত ছিল। এটা না করে একটা মফস্বলের জন্য আর একটা সিটির জন্য করা হয়। সাংবাদিকতার মানের কথা বলে লাভ নেই, এখন ডেসটোরটেড হচ্ছে। সত্যিকথা বলতে কি, অনেকে সাংবাদিকতার মানের দিকে নজর না দিয়ে নিজের যে উদ্দেশ্য আছে সেটাকে পারস্যু করার চেষ্টা করছে।
নুর উদ্দিন সাহেব ফলোআপ চালু করেছিলেন। ইদানীংকালে ডে ইভেন্ট আর স্পট নির্ভর হয়ে গেছে নিউজগুলো। অনুসন্ধানি প্রতিবেদন বলে যে একটা জিনিস ছিল সেটা তো এখন আমরা আর পাচ্ছি না। আমাদের কাগজে এখন আর হচ্ছেই না। এটা বলতে পারি। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তো হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে। সেটার নামে যেটা চালু আছে সেটা হল সংবাদভাষ্য।
আমি সরকারি চাকরির কাজে বিন্দুমাত্র যেতে চাই নি। আমাকে জোর করে এই কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি আমাদের চাকরি গেল- আমার এবং হাসান হাফিজুর রহমানের। দৈনিক বাংলা থেকে আমাদের ওএসডি করা হলো। ওএসডি করার পর জার্নালিষ্ট ইউনিয়ন বললো যে, জয়েন করেন এখানে। আমি তো জয়েন করব না। তবে শেষ পর্যন্ত করতে হলো। জয়েন করার পর তো কাজ কর্ম নেই। তারপর দু সপ্তাহ যাবার পর রিজাইন করার চিন্তা করলাম। তখন খালি প্রেসক্লাবে যাই আর আসি। আর দুপুর দুটো বেজে গেলে তানি আর এষাকে(দুই মেয়ে) নিয়ে বাড়ি চলে যাই। আমি চিন্তা করলাম এখান থেকে রিজাইন করে দিই। ইউনিয়নওয়ালারা বললেই কাজ করতে হবে না কি। ইউনিয়ন তো আমরা চালাই। আমি ইউনিয়নে বলে দিলাম যে, আমি রিজাইন করব। একদিন মিজান চৌধুরি (তথ্যমন্ত্রী) সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, “শোনেন ভাই আপনার চাকরি আমি খাই নি। আপনার রেজিগনেশন লেটারও আমি একসেপ্ট করতে পারব না। আপনার চকরি যিনি খেয়েছেন তার কাছে যান।” আমি বললাম, এতো সর্বনাশ! আমার এক বন্ধু ছিল আওয়াল, আব্দুল আওয়াল খান। সে ছিল বাংলার বাণীর নিউজ এডিটর। ববি ছিল তখন বাংলার বানীর ম্যানেজিং এডিটর। আওয়াল আর ববি শেখ মনির কাছ থেকে নিয়োগপত্র নিয়ে এসেছে- আমি বাংলার বানীর এক্সিকিউটিভ এডিটর। আমার বাসায় গিয়ে সেটা আমার হাতে দিল। আমি বললাম যে, এ তো সর্বনাশের কথা। তবে আমি দেখলাম একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলাম। মনে করলাম, মনির কাগজের কথা বলে রেজিগনেশনের ব্যাপারটা তো আগে কাটাই। তখন মার্চ মাস ইলেকশনের প্রস্তুতি চলছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, “দ্যাখ আমি যদি ভালো ভাবে জিতে আসি তাহলে আমি প্রধানমন্ত্রী থাকব। তখন তোর এখান থেকে যাওয়া হবে না তোকে আবার আসতে হবে। আর আমি যদি সিম্পল মেজরিটিতে জিতে আসি তাহলে আমি প্রধানমন্ত্রী থাকব না। পার্টির প্রেসিডেন্ট থাকব। মাঠে মাঠে ঘুড়ে বেড়াব। তখন তুই যেখানে ইচ্ছা যাস।” আমি বললাম, ঠিক আছে স্যার। এর পরের দিন দেখি যে আমার রেজিগনেশন লেটার অ্যাক্সেপ্টেড। বুঝলাম বাংলার বানী থেকে হয়েছে এসব। আমি পরে আর বাংলার বানীর ধারে কাছে যাই নি। এরপরে ইলেকশনও হয়ে গেছে। আর অন্য কোনো পত্রিকা আর চাকরি দেয় না। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো মালিক, বঙ্গবন্ধুর একটু উষ্মা দেখা যাবে এইটা অনুমান করেই আগেই আতঁকে উঠত।
বিদেশী অ্যাম্বেসিতে একজন জয়েন করার জন্য বলেছিলেন। বলেছিলেন মাঝে মাঝে পলেটিক্যাল রিপোর্ট করতে হবে। বেতন তাদের দেশের মুদ্রায় পাঁচ হাজার। বলল, আপনি অর্ধেক পাবেন ফরেন কারেন্সিতে, বাকিটা দেশি টাকায়। তখন ওদের দেশের টাকায় পাঁচহাজার নিলে রাজার হালে থাকা যেত। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি একটা কাগজের এডিটর ছিলাম। দেশের মান-মর্যাদা সব বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের পলিটিক্যাল ইনফরমার হিসেবে কাজ কেন করতে যাব? তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করলাম কেন? দেশের বিরোধিতা করতে পারবো না। আর যাইনি। আমি দেশের বিরুদ্ধে যাব এটা তো হবে না। তখন হঠাৎ একদিন দুপুর বেলায় বাসায় ফিরেছি। বাসায় এসেই, তখন দুটো-আড়াইটা বাজে, আসা মাত্রই তানিয়ার মা আমার স্ত্রী আমাকে বলল যে, ‘গনভবন থেকে তোমাকে তিনবার টেলিফোন করেছিল। এখনি যেতে বলেছে।’ বেরুবো তখনই দেখি রাজ্জাক সাহেবের টেলিফোন। বললেন, ‘এখুনি চলে আসেন খুব জরুরী দরকার।’ আমি তখন গেলাম গনভবনে। বঙ্গবন্ধু খেয়েদেয়ে রেষ্ট নিচ্ছেলেন যে ঘরে সেখানে নিয়ে গেল। তোফায়েল আহমদ আর আবদুর রাজ্জাক তখন ওই ঘরে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শোনো তোমাকে একটা কথা বলি। আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। এই কাজটা যত তাড়াতাড়ি তুমি করে দিতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তোমার ছুটি। আর যত দেরি করবা তত থাকতে হবে। আমার আত্মজীবনী লিখতে হবে।’ মানে উনি বলে যাবেন আর আমাকে ডিকটেশন নিয়ে করে যেতে হবে। উনি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে একজন থাকবে। অথবা তুমি যাকে ভাল মনে করো নিয়ে নাও।’ আমি দেখলাম যে এদিকে গেলেও বিপদ ওদিকে গেলেও বিপদ। উনি বললেন, ‘চিন্তা করার কিছু নেই। আজকে বাড়ি যাও কালকে সকালে এসে জয়েন করো।’ আমার তখন উদ্দেশ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এই কাজটা শেষ করা। সে কাজও তো সহজ কাজ নয়। নূরুল ইসলাম বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন রেডিওতে। উনি ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি ইত্যাদি জায়গাতে চাকরি করতেন। উনি ছিলেন আমার সঙ্গে। নূরুল ইসলাম সাহেব আর কি করবেন উনি তো আর এসব কাজ করেন নি। উনি আসেন আর যান। আবুল হাসেম সাহেব তখন ছিলেন পিআরও। অর্থাৎ জয়েন্ট সেক্রেটারি, যাকে বাবু হাসেমও বলা হত। উনি চাকরির তদবিরে ছিলেন লন্ডন অ্যাম্বেসিতে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেওয়ার। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু যাচ্ছিলেন বেলগ্রেড, যুগোøাভিয়া আর অটোয়ার কমনওয়েলথ কনফারেন্সে। যাওয়ার আগে হাসেম সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বললেন ওনার চাকরিটা ঠিক করে দিতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমার রিপ্লেসমেন্ট কোথায়? হাসেম ভাই বললেন, তোয়াব তো জয়েন করেছে। এভাবেই শুরু হয়ে গেল গণভবনের জীবন।
১৪ আগস্ট ফরাস উদ্দিন, মশিউর রহমান, মনোয়ারুল ইসলামের ফেয়ারওয়েল ছিল। আমরা খাওয়া-দাওয়া খরচ বাবদ ১০ টাকা করে চাঁদা দিলাম। অনুষ্ঠানের মধ্যেই খবর এল, একটা ইন্ডিয়ান হেলিকাপ্টার আগরতলা থেকে যাচ্ছিল কলকাতায় যেটা পথিমধ্যে নোয়াখালিতে ক্রাশ করেছে। প্রচার হচ্ছে হেলিকাপ্টার গুলি করে নামানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বললেন, সত্য ঘটনাটা বের করে টিভিতে-রেডিওতে দাও। আমার বন্ধু বাসার বলল, কি হয়েছিল। এর মধ্যে নিউজটা রেডি করা হলো। সেদিনই সন্ধ্যায় আমি, মোকাম্মেল সাহেব, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী এই তিনজন মিলে পরের দিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা বক্তব্য দিবেন সেটার পয়েন্ট নোট করছি। রিসার্চ স্কলারশিপ, সায়েন্টিস্টদের নিয়ে কি কি থাকবে এসব তুলছি। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান হাই কমিশন থেকে ফোন এল, বললো, “আপনারা কি নিউজটা দিচ্ছেন?” আমি বললাম, “হ্যাঁ দিচ্ছি।” আবার সেখান থেকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “এটা কি রকম লেভেলের ডিসিশন?” বললাম, “কি রকমের লেভেলের ডিসিশন মানে সর্বোচ্চ লেভেলের ডিসিশন।” তখন বললো, “ও আচ্ছা।” এরইমধ্যে রহিম সাহেব, ডা: সাত্তার, তাহের উদ্দিন ঠাকুর- এক সঙ্গে এই তিনজনের সাথে দেখা হলো। রহিম সাহেবকে জিজ্ঞাস করলাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? আপনারা ফরাসদের ডিনারে নেই? উনি বললেন, “গুলশানে একটা পার্টির দাওয়াত আছে ওখানে যাচ্ছি।” পরে শুনি আসলে চাষী মাহবুবল আলমের বাসায় সেই পার্টির দাওয়াত ছিল। এরা প্রত্যেকে কুমিল্লার লোক। তারও দুদিন আগে পাসিং আউট প্যারেড হয়েছিল আর্মির হাউজ গার্ডদের। এখন যেরকম প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট আছে তখন সে রকম ছিল না। তখন হাউজ গার্ড থাকত। কয়েকটা কোম্পানীর জন্য তিন চারশ আর্মি থাকত। প্রত্যেক পনের দিন পরপর এক জায়গার আর্মিরা নতুন জায়গায় চলে যেত। এ সময় তাদের নিয়ে পাসিং আউট প্যারড করা হত।
সেবার গণভবন খুব সাজানো-গোছান হয়েছিল, যেটা আগে কখনো হয় নি। মিলিটারি সেক্রেটারি মসরুরুল হক সাহেব আমাকে বললেন, “ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ছবি তুলে টিভিতে দেখানোর ব্যবস্থা করেন।” আমি বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে সেই কথা বললাম। উনি বললেন, “রাখো তো এটা আবার দেখানোর কি আছ।” এ সময় দেখলাম বঙ্গবন্ধু এক তরুণ অফিসারকে (কর্ণেল ফারুক)- বেশ স্মার্ট আর লম্বা চওড়া, বলছিছেন, “প্রেসিডেন্টর গার্ড রেজিমেন্টে করছি। গার্ড রেজিমেন্টর তুই দায়িত্ব নিবি।” অফিসারটি বললেন, “আমাকে যদি দায়িত্ব দেন তাহলে কিন্তু পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির নিচে লোক নেব না।” বঙ্গবন্ধু বললেন, “নাহ বাঙালীরা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি সাধারনত হয় না পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হয়। আমরা এতবার ফাইট করে এসেছি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। তুমি বললেই হবে?” মিলিটারি সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাস করলাম, এই অফিসারটি কে? জবাব এলো- একে চেনেন না, অর্থমন্ত্রী ড. মল্লিকের শালীর ছেলে। নাম ফারুক। পরবর্তিকালে বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে দেশে সর্বোচ্চ আদালতে এই ফারুকের ফাঁসি হয়।
এরপর সে রাতেই বারোটার দিকে বঙ্গবন্ধু ফোন দিলেন, বললেন,“বক্তৃতার পয়েন্টগুলো মোটামোটা করে লেখা হয়েছে তো? অনেক এক্সটেমম্পার বক্তব্য হতে হবে। পয়েন্টগুলো লিখে দিবা। সকালে তাড়াতাড়ি আসবা। এসে আমাকে বুঝিয়ে দিও। তোমাদের বক্তৃতা আমার দরকার নেই আমিই বলব।” এই লাস্ট আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের রাতের ভয়াবহ ঘটনার পরদিন সকালে আমি আর আমার ছোট ভাই বাচ্চু বের হয়েছি কি হয়েছে দ্যাখার জন্য। মোহাম্মেদপুরের মোদাব্বের সাহেবের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখন বিহারিরা বলছে, ভাগ রাহা হ্যায়......। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।
শুরু থেকে একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। কী চাই, সেটা নির্দিষ্ট করে ফেলতে হবে। কী করবো, কেন করবো, কিভাবে করবোÑপরিকল্পনা স্পষ্ট থাকতে হবে। তাতে জীবনটা সহজ হয়ে যায়। সবকিছু সহজভাবে নিলে কোনোকিছুই আর কঠিন মনে হয় না। জীবন উপভোগ্য হয়। মনে হয় ভেসে ভেসেই পেরিয়ে গেল জীবন। তবে আমি ম্যানেজমেন্টটা তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তাঁর। শুরু থেকেই বেতনকড়ি যা পেয়েছি, তাঁর হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছি। বাড়ি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর। ওখানে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করিনি। যে বাড়িতে এখন থাকি এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর। ওখানে আমি কোনোদিন মাথা গলাতে যাইনি।’