logo ২৫ এপ্রিল ২০২৫
বিএনপিতে দৈন্য দশা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১৭ জুন, ২০১৫ ১৩:৫৩:০৭
image


নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে তখন বিএনপি-জামায়াত জোট। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের সহিংসতার মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তার সঙ্গে সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের দিনক্ষণ সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ খালেদা জানালেন, জামায়াতের হরতালে নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রণবের সঙ্গে দেখা করবেন না তিনি। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া না জানালেও দেশটির শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গণমাধ্যম জানায়, খালেদার সিদ্ধান্তকে অসৌজন্যমূলক হিসেবেই দেখেছে দেশটি।  

ভারতের গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে লেখা হয়, প্রণব মুখার্জি ব্যক্তি হিসেবে নয়, তিনি এসেছিলেন ভারতের শতকোটি নাগরিকের প্রতিনিধি হয়ে। বিএনপি তার সঙ্গে সৌজন্যটুকু রাখেনি। পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে ভারতের মানুষকে অসম্মান করেছে।

মাত্র বছর দুয়েকের ব্যবধানে পট পাল্টেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে তার সাক্ষাৎ পেতে বলতে গেলে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেছিল বিএনপি। দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবারের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এখন কোনো সরকারি প্রটোকলে নেই। এমন কারও সঙ্গে মোদি কি দেখা করবেন? তিনি দেখা না করলে দুইবার আন্দোলনে নেমে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পিছুহটা বিএনপির জন্য আবারও কি ধাক্কা আসবেÑ এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো কথাবার্তা বা উদ্বেগ আদৌ ছিল কি না তা জানার চেষ্টা করেনি বিএনপি। তবে দলের নেতারা ছিল ভীষণ উদ্বিগ্ন। খালেদার সঙ্গে মোদির সাক্ষাৎ না হলে দেশের মানুষ তা মানবে নাÑবিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমানের এমন বক্তব্যের মানে কি, তাও জানা হয়নি আর। আবার ‘বিএনপি কখনো ভারতবিরোধী রাজনীতি করেনি, এখনো করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না’Ñদলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপনের হঠাৎ এমন বক্তব্য দেওয়ারই বা কারণ কি, তাও স্পষ্ট করেনি দলটি।

তবে এই দুই নেতার বৈঠকের অনিশ্চয়তার মধ্যে সফরের দুদিন আগে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় যে, খালেদা জিয়াকে সময় দেবেন মোদি, তখন বিএনপিতে রীতিমতো আনন্দের জোয়ার। বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টাও করেননি কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাস জানিয়েছেন খোদ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।

তবে মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার এবারের সাক্ষাৎটা কোনো বিদেশি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তার অতীতের সাক্ষাতের চেয়ে অন্যরকম অনেক দিক থেকেই। আবার বৈঠকে আসতে দেরি হয় কি না, এই আশঙ্কায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে খালেদা জিয়া চলে আসেন আগেভাগেই। বৈঠক কক্ষের সামনে অপেক্ষা করেন দীর্ঘ সময়।

খালেদা জিয়া যখন বসেছিলেন তখন তারই সামনে জাতীয় পার্টির নেত্রী এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মোদির সঙ্গে দেখা করেন। আলোচনার জন্য সময়ও পেয়েছিলেন। সবশেষে ডাকা হয় খালেদা জিয়াকে। তিনি সময়ও পেয়েছেন কম। মাত্র ১০ মিনিট সময় পেয়েছেন কথা বলার জন্য। এ নিয়ে খালেদা জিয়াকে কটাক্ষ করে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে ভারতের গণমাধ্যমে।

মোদির সফরে দুই দেশের মধ্যে ১৯টি চুক্তি এবং তিনটি প্রটোকল সই হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের পক্ষে কতটা ইতিবাচক, সে বিষয়ে মুখে রা নেই বিএনপির। অথচ এর আগে নানা সময় ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের যেকোনো আলোচনা, চুক্তি বা সমঝোতার তীব্র বিরোধিতা এবং সমালোচনা করে এসেছে বিএনপি। অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের চুক্তি সইকেও বাঁকা চোখে দেখেছে। এই চুক্তি সই ভারতের স্বার্থে হয়েছে এবং এ কারণে ফেনী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত এলাকা ভারতের হয়ে যাবেÑএমন দাবি করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লংমার্চ করে বিএনপি। অথচ ক্ষমতায় ফিরে এই চুক্তি বাতিল করেনি বিএনপি।

শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা-কলকাতা বাস চালু করার প্রতিবাদে টানা তিনদিন হরতাল করেছে বিএনপি। তখন তাদের যুক্তি ছিল, এই বাস চালু হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণœ হবে।

আবার আওয়ামী লীগ আগে থেকেই ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট দিতে আগ্রহী হলেও বিএনপির বিরোধিতায় বিষয়টি আগায়নি এতদিন। মোদির সফরের আগে বিএনপির এ বিষয়েও দীর্ঘদিনের অবস্থান পাল্টানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের নেতা আ স ম হান্নান শাহ। ৬ জুন মোদির সফরের আগের দিন রাজধানীতে এক আলোচনায় ভারতীয় নেতাকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা দাবি করে তিনি বলেন, ‘ট্রানজিট বা কানেকটিভিটি দিতে হলে ভারতকে আন্তর্জাতিক নিয়মে ট্যাক্স দিতে হবে।’

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি হয়ত অতীতে না বুঝে বিতর্ক করেছে। এখন হয়ত বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। এর বাইরে হয়ত রাজনৈতিক ব্যাপারও থাকতে পারে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বিধায় দলটি তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তবে যাই করা হোক দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে করতে হবে।’

ভারতকে কী বার্তা দিতে চেয়েছে বিএনপি?

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে ভারত ইস্যুতে বিএনপির বিমুখীতা সহজে ভোলার নয়। তাছাড়া সেদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি যে অসৌজন্যতা দেখিয়েছে তারপর থেকে বিএনপির ব্যাপারে দেশটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নেতিবাচক ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে। যে কারণে মোদি শুরু থেকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে নিমরাজি ছিলেন। কিন্তু বিএনপির নাছোড়বান্দা আচরণে পরে অগত্যা সময় দিয়েছেন ভারতের সরকারপ্রধান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রণবের সঙ্গে দেখা না দেওয়া এবং সম্প্রতি মোদির সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য বিএনপির দৌড়ঝাঁপই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে দারুণ দুঃসময় পার করছে বিএনপি। বলতে গেলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলটির অবস্থান যে তলানিতে ঠেকেছে তা দিন যত যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপির প্রতি ভারতের সরকারপ্রধানের আচরণও তারই প্রমাণ দিয়েছে।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণকেও বার্তা বলে মনে করেন কূটনীতিকরাও। তারা বলছেন, অতীতের ভারতবিরোধী মনোভাব এবং ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ায় বিএনপির প্রতি ভারতের যে সুনজর নেই সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন মোদি। ‘দেশে গণতন্ত্র নেই’Ñ খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পর ভারতের সরকারপ্রধান বলেন, ‘গণতন্ত্রের পক্ষে আছি। তবে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিপক্ষে।’ এ থেকেও বোঝা যায় জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে ভারত বিএনপির ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে না। তবে সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করারও পরামর্শ দেন নরেন্দ্র মোদি।

জবাবে খালেদা জিয়া অবশ্য বলেছেন, তারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নয়। মোদি তখন তাকে বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে অন্য কোনো পথে হাঁটার সুযোগ সংসদীয় ব্যবস্থায় নেই। আলোচনায় না বসলে কোনো সমস্যার সমাধানও মেলে না।

মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার এসব কথোপকথনের ভেতর দিয়ে যে বার্তা ফুটে ওঠে তা পরিষ্কার। বাংলাদেশের ব্যাপারে মনমোহন সরকারের দেখানো পথেই হাঁটছেন মোদি। মনে করা হয়েছিল, ভারতের মসনদে কংগ্রেস সরকারের পতন এবং বিজেপি সরকারের অধিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে। বিএনপির মধ্যে এই আলোচনা তো ছিলই যে, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অলিখিত সমঝোতা রয়েছে। কিন্তু বিজেপি যে কংগ্রেসের কূটনৈতিক নীতিকেই আঁকড়ে থাকবে সেটা ধারণা করতে পারেনি বিএনপি। যে কারণে আগের অবস্থান পাল্টে ভারত বিরোধিতার বদলে মুহূর্তের মধ্যে ভারত বন্দনায় মন দেয় দলটি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের দাবি, বিএনপির ‘ভারত বন্দনার’ পেছনে বড় স্বার্থ রয়েছে। সেটা হচ্ছে ক্ষমতা। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ভাবছে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা গণতন্ত্রের বাইরে কোনো পথে ক্ষমতায় যাওয়াকে সমর্থন করে না। তাই ক্ষমতায় যেতে হলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েই যেতে হবে।’

তবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘ভারত প্রসঙ্গে অতীতে বিএনপি যাই বলেছে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছে। এটা বিরোধিতা নয়। ভারতের বিরোধিতা করার কী আছে? আমরা বলেছি যাই করা হোক বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখনো এ থেকে আমরা পিছপা হয়নি।’



সরকারের বিরুদ্ধে মোদির কাছে ‘নালিশ’ অমর্যাদাকর

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে মোদির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। আবার তারই দলের নেতা হান্নান শাহ ৬ জুন মোদির ঢাকা সফরকালে প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘মোদি সাহেব এসেছেন, তিনি গণতন্ত্রের একজন প্রবক্তাও বটে। আমরা আশা করি গণতান্ত্রিক স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে বাংলাদেশে যাতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য ওনার (মোদির) শিষ্টাচারের মধ্যে যতটুকু পড়ে ততটুকু তিনি (মোদি) করবেন।’ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আরেকটি দেশের সরকারপ্রধানের কাছে নিজেদের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ‘নালিশ’ করাকে অমর্যাদাকর মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার পাশাপাশি অভিযোগকারী দলের অবস্থানও প্রশ্নের মুখে পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘নিজেদের সমস্যা নিজেদের মধ্যেই সমাধান করা ভালো। এ নিয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কামনা করা দেশের জন্য ভালো নয়। এতে দেশের নীতি-নির্ধারণী ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ চলে আসে, যা একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি এ ধরনের নালিশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে করে থাকলে তা মোটেও ঠিক হয়নি। এতে শুধু দেশের নয়, বিএনপির অবস্থানও দুর্বল হয়ে গেছে।’

মোদির কাছে মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, মনমোহন সরকারের প্রশ্রয়েই ভোটের ‘প্রহসন করে’ শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখল করেছেন। তিনি আশা করেন, মোদির সরকার এই নীতি পুনর্বিবেচনা করবে। জবাবে মোদি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, কেন তিনি হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় বসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছেন না? জবাবে খালেদা বলেন, তারা বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও সরকারের আচরণে পিছিয়ে আসেন। মোদি তখন তাকে বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে অন্য কোনো পথে হাঁটার সুযোগ সংসদীয় ব্যবস্থায় নেই। আলোচনায় না বসলে কোনো সমস্যার সমাধানও মেলে না।

কূটনীতিকদের মতে, এই কথা বলে আসলে খালেদা জিয়াকে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শই দিয়েছেন মোদি। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা যে ভারত মেনে নেবে না, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মনমোহন সরকারের বাংলাদেশ নীতি মেনেই মোদির সরকার চলছে। তাই আগের সরকারের বিরুদ্ধে তোলা খালেদার অভিযোগকেও আমল নেননি মোদি।

বিএনপিপন্থিরাও বলছেন মোদির সফর সফল হয়েছে

বিএনপি সার্বিকভাবে যে ভারতবিরোধী মনোভাব ঝেড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মুখেও শোনা গেছে ভারত বন্দনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের আহ্বায়ক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশ একেবারে কিছু পায়নি কথাটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, মোদিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর জন্য দরকার জনগণের সমর্থনপুষ্ট স্ট্রং গভর্নমেন্ট।’

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘মোদির সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলো না। তিস্তাকে প্রবাহিত করার কথাও সরকার তুলল না। সীমান্ত হত্যা নিয়ে সরকার ক্ষুদ্রতম দাবিও তোলেননি। তিনবিঘা করিডোর স¤পর্কে একটি কথাও হয়নি। এখন সীমান্ত চুক্তি কীভাবে বাস্তবায়ন হয় তা দেখার বিষয়। আমরা শুধু আশ্বাসের ওপর আছি।’



নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয়, আন্দোলনের স্বপ্ন ভঙ্গ

বিএনপির দৈন্যদশার চিত্র এখানেই শেষ নয়। সাংগঠনিকভাবেও বেশ বেকায়দায় আছে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়। না পারতে প্রকাশ্যে আসতে চান না তারা। এ বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার তিন মাসের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, দিনের পর দিন হরতাল ডাকা হলেও রাস্তায় একজন বিএনপি নেতা-কর্মীর দেখা মেলেনি। যানবাহনসহ মানুষের জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক ছিল। এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন এলে আন্দোলনে ক্ষ্যান্ত দিয়ে গুলশানের কার্যালয়ে তিন মাস কাটানোর পর ৫ এপ্রিল বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। এর পর নির্বাচনী প্রচারণাতে নেমে পর পর তিনদিন হামলার শিকার হন বিএনপি নেত্রী। দলীয়প্রধানের ওপর এমন হামলার শক্ত কোনো প্রতিবাদ করেনি বিএনপি। এ নিয়ে তাদের কোনো কর্মসূচিও ছিল না।

সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও এ নিয়ে পরে আর কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি বিএনপিকে। ৫ এপ্রিল আন্দোলন কর্মসূচি আপাতত স্থগিতের কথা বলা হলেও এর পর ভবিষ্যতের কর্মসূচি নিয়ে এখনো কোনো প্রস্তুতি নেই দলটিতে। বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রকাশ্য সভায় অকপটে স্বীকার করেছেন সেই কথা। স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মওদুদ আহমদ তো বলেই বসেছেন, বিএনপির রাজনীতি পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা চরমভাবে বাসা বেঁধেছে। সরকারের অনমনীয় আচরণে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করবে। যে কারণে সহসাই ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই নেতা-কর্মীরাও অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।’

বিএনপির এই নেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিরোধী দলে থাকলে যেকোনো সংগঠন শক্তিশালী হয়। নেতা-কর্মীদের ত্যাগী মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু বিএনপির দশা এখন এমন হয়েছে কোথাও কোথাও অভিভাবক ছাড়াই চলছে দল। কেন্দ্রে থেকে কর্মসূচি ঘোষণার আগে তৃণমূলে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই থাকে না। আবার কর্মসূচি ঘোষণার পর নেতৃত্ব কে দেবে সেই লোকটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।’

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সদস্য খাতা-কলমে আছেন ১৯ জন। এর মধ্যে দলের প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনও আছেন। বাকি ১৮ জনের মধ্যে বেশির ভাগই অসুস্থ। কারাগারে আছেন কেউ কেউ। আত্মগোপন ও চুপচুপ মিলিয়ে নিষ্ক্রিয় আছেন বাকিরা। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আছেন কারাগারে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন। সেখানে বসেই বিগত সময়ে রাজনীতিতে সরব দেখা গেছে তাকে। বিভূঁইয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও যোগ দিতেন। কিন্তু ইদানীং তার কোনো কর্মকা-ই সামনে আসছে না। অনেকটা চুপচাপই আছেন তিনি।  

তবে বিএনপির এই নেতা মনে করেন, ‘বিএনপি শেষ হয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই’। দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘দীর্ঘদিন আন্দোলন চলেছে। সিটি নির্বাচনেও দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অনেক ধকল গেছে। শেষে অবশ্য জোর করে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব কারণে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা ক্লান্তিভাব আসতে পারে। তার মানে এই নয় যে, সবাই বসে আছে। অচিরেই আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন দিক-নির্দেশনা দেবেন।’

জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘বর্তমান সরকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। এখন তাদের সাঁতার কাটতে বলা হলে সম্ভব হবে কীভাবে? নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ সরকারের সময়ে যত মামলা হয়েছে অতীতে কোনো বিরোধী দলের ওপর এমন নিপীড়ন চালানো হয়নি।’

বিপরীতে আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপির এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের নিয়ে রাজনীতি করার কারণে তারা জনগণের কাছে ধিকৃত হয়েছে। এখন ক্ষমতায় যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘৫ জানুয়ারির পর টানা তিন মাস পেট্রল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে ক্ষমতায় আসার যে চেষ্টা বিএনপি-জামায়াত করেছিল তা ভেস্তে গেছে। পরে জনগণই বোমা হামলাকারীদের ধরে পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির নীল নকশা যখন কাজে আসেনি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছে। অথচ বেগম জিয়া এটা জানেন না ভারত ভালো করেই জানে কারা মৌলবাদ ও উগ্র জঙ্গিদের লালন করে আর কারা দমন করে। ভারতের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশ জেনেশুনে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা করবে না।’



নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা কে কোথায়

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটি ১৯ সদস্যের। এর মধ্যে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা গেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাগারে আছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। দুর্নীতির মামলায় কারাগারে আটক আছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কারাগারে আটক আছেন আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। আর এ গণি, শামসুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, সরোয়ারি রহমান অসুস্থ। মির্জা আব্বাস, রফিকুল ইসলাম মিয়া, তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে। অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করার সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন তরিকুল ইসলাম। এই নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে।

গত ৭ জুন আদালত রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ ২৮ নেতা-কর্মীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান ও মঈন খানকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায়। সিটি নির্বাচনের আগে সমন্বয়কের দায়িত্ব নিয়ে সক্রিয় ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ ও আ স ম হান্নান শাহ। নির্বাচনের পর থেকে তারাও অনেকটা নীরব। মাঝে মধ্যে তাদের দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যায়। জমির উদ্দিন সরকার ও নজরুল ইসলাম খান প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য তারেক রহমান লন্ডনে।

বিএনপির ১৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল নোমান ও সেলিমা রহমানকে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখা গেছে। বাকিদের মধ্যে শমসের মবিন চৌধুরী দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। দেশের বাইরে আছেন সাদেক হোসেন খোকা। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন আব্দুস সালাম পিন্টু।

দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৬ জানুয়ারি থেকে কারাগারে। দলটির সাত যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে দপ্তরের দায়িত্বে থাকা রুহুল কবির রিজভী কারাগারে, আর ভারতের শিলংয়ে জামিনে আছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। আর আমানউল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ ও মিজানুর রহমান মিনু আছেন আত্মগোপনে। এতদিন সক্রিয় ছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনিও এখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। মাহবুব উদ্দিনকে মামলা সংক্রান্ত কাজে দেখা যায়। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা মেলে না তার।

অবরোধ তুলতেও সিদ্ধান্তহীনতা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে পরদিন থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু কয়দিন যেতে না যেতেই শিথিল হয়ে যায় অবরোধ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবরোধ-হরতালে যাও সক্রিয় ছিলেন নেতা-কর্মীরা, এবার দেখা যায়নি তেমনটিও। তার ওপর গণপরিবহনে পেট্রল বোমা হামলায় মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি।

বিএনপির আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকারই তাদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এসব হামলা চালাচ্ছে এমন বক্তব্য দিয়ে চাপ কাটানোর চেষ্টা করেছে বিএনপি। কিন্তু এই বক্তব্য যে দলের নেতারাই বিশ্বাস করেন না, সেটা স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান এবং অন্য এক নেতার কথোপকথনেই স্পষ্ট।

অনির্দিষ্টকালের অবরোধ দৃশ্যত এক সপ্তাহের মধ্যেই ভেঙে পড়ার পর কর্মসূচি জোরাল করতে অবরোধের পাশাপাশি হরতালও ডাকে বিএনপি। কিন্তু এক সময় অবরোধ আর হরতাল-দুই কর্মসূচিই হারায় কার্যকারিতা। আর আন্দোলনে থাকা বিএনপি অংশ নেয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ভোটে অংশ নেওয়ার সময় দুই মহানগরে অবরোধ শিথিল করার কথা জানিয়েছিল দলটি। কিন্তু এরপর আর কী হয়েছে, তা জানে না কেউ।

বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়, জোটের নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়া বসতে পারছেন না বলে অবরোধ প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে কারও সঙ্গে আলোচনা না করে যদি খালেদা জিয়া অবরোধ ডাকতে পারেন, তাহলে তা প্রত্যাহারে কেন আলোচনা করতে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি দলের নেতারা।

টানা তিন মাস অবরোধ কর্মসূচি পালনের পরও দাবি আদায়ে কোনো সুফল পায়নি বিএনপি। সিটি নির্বাচনের দোহাই দিয়ে সরে আসতে হয়েছে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি থেকে। মূলত লাগাতার এত বড় কর্মসূচি চালানো বিএনপির জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কর্মসূচি থাকলেও তাতে নেতা-কর্মীদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। হরতালে পিকেটিং তো দূরে থাক যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। তবে চোরাগোপ্তা পেট্রল বোমা হামলার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল মানুষের মধ্যে। এসব হামলায় শত মানুষের প্রাণহানিও ঘটেছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবি আদায়ের আগে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হওয়া এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয়ই বলা চলে। না বুঝে শুনে এভাবে কর্মসূচি ডাকলে সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক দলের নেতা-কর্মীরাই এতে সায় দেবে না। আগে পরিস্থিতি বুঝে তার পর কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল।

বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো যে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে সেটা স্বীকার করেছেন খালেদা জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি মারুফ কামাল খান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপি আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে দলটির ওপর দিয়ে রাষ্ট্রীয়, বিচারিক, প্রশাসনিক ও প্রচারিক হামলা চলে আসছে একটানা ও একতরফাভাবেই। এতে দলের কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।’

অবশ্য এতে খুব বেশি চিন্তিত নন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের এই কর্মকর্তা। তার মতে, বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো বরাবরই দুর্বল। আর জনসমর্থন তাদের পক্ষে আছে দাবি করে তিনি লিখেন, এর জোরে ক্ষমতায় আসতে বিএনপির তেমন বেগ পেতে হবে না।  

দলের ভেতরেই তিক্ত সমালোচনা

বিএনপি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল, এই দলে কোনো গণতন্ত্র নেইÑএতদিন এই অভিযোগগুলো উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। কিন্তু এখন অভিযোগগুলো উঠছে খোদ বিএনপির ভেতর থেকেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘বিএনপি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কলুষিত ও সব দিক দিয়ে রুগ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু এই দলের স্থপতি জিয়াউর রহমানের কাছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্বৃত্তায়নের জায়গা ছিল না।’

একই ধরনের অভিযোগ তুলেছেন চারদলীয় জোট সরকারের আমলের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদও। এই দুই নেতা স্পষ্টতই অভিযোগ তুলেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি। ফাঁস হওয়া টেলিফোন কথোপকথনে মাহবুবুর রহমান এমনও বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে মানুষকে যে কষ্ট দিয়েছেন খালেদা জিয়া তা আল্লাহ সহ্য করবেন না। এ কারণে বিএনপি আগামীতেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে মনে করেন না তিনি।

দলের নেতারাই বিএনপির এমন সমালোচনা যখন করেন, তখন এটি স্পষ্ট যে, বিএনপিতে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

সবশেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যুবদল নেতা রইসের এক ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি আলোড়ন তুলেছে দলের ভেতর। রইস-মাহবুবের ফোনালাপে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনা করা হয়। খালেদা জিয়ার জামায়াত সম্পৃক্ততা নিয়েও এতে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফর এবং হরতালের অজুহাত দেখিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে খালেদা জিয়ার না যাওয়ার বিষয়টিও তাদের কথাবার্তায় এসেছে। ওই ইস্যুতে খালেদার তীব্র সমালোচনা করা হয়।

২০১৯ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলেও একমত পোষণ করা হয় ফোনালাপে। সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে বিএনপি ক্ষমতায় আসা না আসা নিয়েও অল্প পরিসরে কথাবার্তা হয়। দলের অঙ্গ সংগঠনের এক নেতার সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান।

এ প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি খুবই নিম্নশ্রেণির কাজ। কখন কার সঙ্গে কি কথা হয়েছে এটা ফাঁস হওয়ায় বিষয়টিও উদ্বেগের।’ তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না। অনেকের সঙ্গেই প্রতিদিন কথা হয়, খোলা মন নিয়েই কথা বলি। কিন্তু কে কখন ফোন রেকর্ড করে প্রকাশ করছে, এসব নিম্নশ্রেণির আচরণ। ইদানীং তো চরিত্রহননে এসব করা হচ্ছে।’

যেকোনো ইস্যুতে আলোচনায় রাজি বিএনপি

২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব ‘এখন গ্রহণ করা সম্ভব নয়’ বলে কার্যত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা দুইবার তাকে ফোন করলেও হরতাল প্রত্যাহার করে আলোচনায় বসতে রাজি হননি বিএনপি নেত্রী। বরং তাদের সে সময়ের হরতাল শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ফোন করার মতো কথা বলেছিলেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপি নেতারা তখন এমনও বলেছেন, আলোচনা করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর বাসায় যাবেন না খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাকেই পায়ে হেঁটে আসতে হবে খালেদা জিয়ার বাসায়।

এরপর বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকার গঠন, এক বছরের মধ্যে বিএনপির আন্দোলনে যাওয়া আর ‘যৌক্তির পরিণতি’তে না পৌঁছার আগেই ঘরে ফেরার পর আগের সেই সুর আর নেই বিএনপি নেতাদের।

বিএনপি এখন বলছে, যেকোনো ইস্যুতে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়। মোদির পরামর্শের পর তারা ভালো করেই বুঝেছে সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে হলে যেকোনো মূল্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, আলোচনায় গিয়ে সরকারকে যদি মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাধ্য করা যায় সেটাই বিএনপির জন্য লাভজনক। এটা স্পষ্ট যে, আন্দোলন করে নির্বাচন দেওয়া কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে না। বিএনপিও বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। এখন সরকার যদি দেশের গণতন্ত্র নিয়ে আন্তরিক হয় তবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে।

বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘যে কোনো ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছে বিএনপি। বহির্বিশ্ব চায় বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসুক। আলোচনার মাধ্যমেই এই দুটি বড় রাজনৈতিক দল দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। তাই বহির্বিশ্বের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিএনপি বারবার সরকারকে আলোচনার জন্য আহ্বানও জানিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা বিএনপির সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।’ বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বিএনপি সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাস করে। সুতরাং বিএনপি এখনো যেকোনো ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি আছে।’

তবে আওয়ামী লীগ এখন স্পষ্টতই বলছে, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। আলোচনা করতে হলে বিএনপিকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন সরকার দলের নেতারা।

জামায়াতকে নিয়ে বিপাকে বিএনপি

পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বাইরের সব শক্তিকে টেনে আনার প্রক্রিয়ায় জামায়াত-মুসলিম লীগ চক্র সুযোগ পায়। এই সুযোগটি করে দিয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এখন জোটবন্ধু জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিপাকে আছে বিএনপি। বিশেষ করে মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে জোর আলোচনা চলছে। তারা বুঝে গেছে, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে ভারতের অনুকম্পা বা সহযোগিতা কিছুই মিলবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আছে কি না সেটাও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপি নেতাদের কাছে। তবে রাজনৈতিকভাবে শক্তি ফিরে পেতে প্রয়োজনে জামায়াতকে ছাড়ার ব্যাপারেও দলের অধিকাংশ নেতা একমত বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে যে বিএনপির একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট। জামায়াতের মতো ভারতবিদ্বেষী দলের সঙ্গে জোট বন্ধুত্বের কারণেও অনেক সময় বিএনপি ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এখন জামায়াতের সঙ্গে যে কারণেই হোক তাদের সম্পর্কে ভাটা পড়ায় ভারতবিদ্বেষী মনোভাব কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। যদিও জামায়াত মোদির সফর ও বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে করা চুক্তির বিরোধিতা করেছে। এবারই প্রথম দেখা গেছে, জামায়াত মোদির সফরে জনগণ হতাশ হয়েছে দাবি করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিক্ষোভ মিছিল করেনি বা কিছু করার চেষ্টাও করেনি। বিএনপি দলীয়ভাবে মোদির এই সফরের পক্ষে কথা বলেছে। এই প্রথম ভারতের সঙ্গে কোনো ইস্যুতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।

মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের সময় উপস্থিত এক বিএনপি নেতা বলেন, বৈঠকের পর বিজেপির সঙ্গে বিএনপির সখ্য বাড়বে। এতদিনের গুমোট পরিবেশ কাটতে সহায়তা করবে। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে যে শর্ত দিয়েছেন তা শতভাগ মানা কঠিন হবে। ভারত চায় বিএনপি জামায়াতকে পুরোপুরি ত্যাগ করুক। মোদি খালেদা জিয়াকে বলেছেন, জামায়াত, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিএনপির স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। ভারত গণতন্ত্রের সমর্থক এবং মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বিরোধী। বিএনপির এই নেতা জানান, বেগম জিয়া নরেন্দ্র মোদিকে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের (বিএনপির) কোনো আদর্শিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা জোটে আছে আন্দোলন এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক অংশীদার হিসেবে।



সমালোচনায় মুখর সরকারি দল

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ নিয়ে নানাভাবে হাস্যরস করছে। অনেক ‘অনুনয় বিনয় করে’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা মোদির দেখা পেয়েছেন, এমন কথাও বলছেন তারা। পাশাপাশি উপরে উপরে ভারত-প্রেম দেখালেও ভেতরে বিএনপি এখনো ভারতবিদ্বেষী রয়ে গেছে বলেও মন্তব্য তাদের।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ মন্তব্য করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিএনপি হতাশায় ভুগছে। তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতে যে আলোচনা হয়েছে তা থেকে বিএনপির নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন ২০১৯ সালের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ ‘পাকিস্তানি বন্ধুরা ক্ষমতায় বসাতে পারবে না’ বুঝতে পেরেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন ‘ভারত বন্দনায় মত্ত’ হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বিএনপির রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মোদি যে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ পছন্দ করেন না, সেটা তো অন্য কাউকে বলেননি, বলেছেন খালেদা জিয়াকে। এতেই প্রমাণিত হয়, বিএনপির রাজনীতি মোদির কাছে প্রত্যাখ্যান হয়েছে।’

দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, মোদির সফরকে বিএনপি অভিনন্দন জানালেও তিনি ভারতে ফিরে যাওয়ার পরপরই বিএনপি তাদের পুরনো রূপে ফিরে গেছে। বিএনপির সঙ্গী জামায়াত নরেন্দ্র মোদির সফরের বিপক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি এখনো ভারতবিরোধী রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।’

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ভারত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে এবং করবে। এ কথা শোনার পরই বিএনপি হতাশ হয়ে নরেন্দ্র মোদির সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পথ বেছে নিয়েছে। যে চুক্তিগুলো হয়েছে তার প্রশংসা না করে তিস্তা চুক্তিসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে।’-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।