বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিজামী ও মুজাহিদকে কথিত রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বনানী ও উত্তরায় দুটি প্লট দেওয়া হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু, রায় প্রকাশ আর দ- কার্যকরের অপেক্ষায় থাকাকালেও সেই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বাতিল করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মানুষরা। লিখেছেন আল ফারুক ও মহিউদ্দিন মাহী
১৯৭১ সাল। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে অস্ত্রের জোরে মেরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চলছে গণহত্যা, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ, বেপরোয়া ধর্ষণ। এর মধ্যে রুখে দাঁড়িয়েছে কিছু মানুষ। এরা মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্রের শক্তিতে দুই পক্ষে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও মনোবল আর ন্যায়ের পক্ষে থাকার কারণে পুঁচকে ছেলেদের কাছে পদে পদে নাজেহাল হচ্ছে পেশাদার পাকিস্তানি বাহিনী।
২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণ শুরুর পর পরই শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার। গঠন হয় মুক্তিবাহিনী। শুরু হয় গেরিলা হামলা। একই সময়ে আবার এক কলঙ্কের ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশেরই কিছু রাজনৈতিক দল আর তাদের কর্মী-সমর্থকরা। দেশবাসী আক্রান্ত আর এই সময়ে নিজের দেশের মানুষকে হত্যা, গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক দল এবং চীনপন্থি বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী।
মার্চ পেরিয়ে সময়ের খাতায় এপ্রিল, মে, জুন, দিনে দিনে বাড়ে বাঙালির প্রতিরোধ-যুদ্ধ। পাশাপাশি লোকবল বাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় দালালরা। রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটি, আলশামস বাহিনী গঠন করে এরাও শুরু করে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট অগ্নিসংযোগ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে গঠিত হয় আরেক খুনি বাহিনী আলবদর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছাত্র-যুবাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এমন প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠে এই বাহিনী। আর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সে সময় এই খুনি বাহিনীকে সংগঠিত করা, লোক সংগ্রহ, দিক নির্দেশনা দেওয়াসহ হত্যা, গণহত্যায় লিপ্ত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর পর পালিয়ে যাওয়া এই দুই আলবদর কমান্ডার প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফেরেন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে কেবল রাজনীতি নয়, আর্থিকভাবেও ফুলেফেঁপে ওঠে জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদও পায় দলটি। যে দেশের জন্মের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে এক সময় অস্ত্র ধরেছিলেন নিজামী-মুজাহিদ তাদের গাড়িতেই উঠে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা। ক্ষুব্ধ হয় দেশবাসী। ক্ষমতায় বসে ধরাকে সরাজ্ঞান করা জামায়াত নেতা মুজাহিদ দম্ভোক্তি করে বলেন, দেশে স্বাধীনতাবিরোধী দল বলতে কিছু নেই, কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। ২০০৭ সালে প্রকাশ্যে এই দম্ভোক্তির আট বছরের ব্যবধানে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায় হয়েছে তার বিরুদ্ধে। আলবদর বাহিনীর সংগঠক হিসেবে একাত্তরে ত্রাস চালানোর আরও অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে। পেয়েছে ফাঁসি ছাড়াও অন্য সাজা।
মুজাহিদের ফাঁসির অপেক্ষায় একাত্তরে স্বজনহারা আর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মানুষরা। তার শাস্তি কার্যকর হলে একাত্তরের ক্ষতের কিছুটা হয়ত উপশম হবে, কিন্তু পুরোপুরি হবে কি? এই আলবদর নেতাকে রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যে পুরস্কার দিয়ে রেখেছে সরকার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিজামী ও মুজাহিদকে কথিত রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বনানী ও উত্তরায় দুটি প্লট দেওয়া হয়। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, লুটপাট, ধর্মান্তরিত করা, কোটি মানুষকে দেশান্তরিত করা ছাড়া আর কী রাষ্ট্রীয় অবদান রেখেছেন এই দুই আলবদর নেতা, তা অবশ্য স্পষ্ট করেনি জোট সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু, রায় প্রকাশ আর দ- কার্যকরের অপেক্ষায় থাকাকালেও সেই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বাতিল করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মানুষরা।
বহুতল বাড়ি উঠেছে নিজামী-মুজাহিদের সরকারি প্লটে
জোট সরকারের শেষ বছরে এসে ২০০৫ সালে এসে রাজধানীর দুই অভিজাত এলাকায় প্লট বাগিয়ে নেন নিজামী ও মুজাহিদ। রাজউক জানায়, ঢাকায় নিজের নামে কোনো জায়গা নেই এমন যুক্তি দেখিয়ে প্লট বরাদ্দ দিতে রাজউকের কাছে আবেদন করেন সে সময়ের মন্ত্রী দুই আলবদর নেতা।
২০০৫ সালের ২৫ অক্টোবর রাজউকের ১৬২তম বোর্ড সভায় তাদের নামে পাঁচ কাঠার করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৬ সালের ১৬ মার্চ দুজনকেই বরাদ্দপত্র বুঝিয়ে দেয় রাজউক। এর মধ্যে নিজামীকে দেওয়া হয় বনানীর জে ব্লকের ১৮ নম্বর রোডের ৬০ নম্বর প্লট। আর মুজাহিদ পেয়েছেন উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের ৫ নম্বর প্লটটি। দুটির পরিধিই পাঁচ কাঠার।
রাজউক জানিয়েছে, ভূমি বরাদ্দ বিধিমালার ১৯৬৯ (সংশোধিত) ১৩/ক ধারাবলে তাদের প্লট দেওয়া হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশিষ্ট ব্যক্তি যার রাজধানীতে থাকার জায়গা নেই, তাকেই প্লট বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এ ধারায় রাজউকের প্লট পাওয়ার যোগ্য। বরাদ্দ পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে বনানী লেকে নিজামীর প্লটে সাততলা ভবন উঠে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিশন নাহার’। প্রতিটি তলায় আছে ১৮১০ বর্গফুটের দুটি করে ফ্ল্যাট। এই ভবনের ছয়তলায় থাকেন নিজামীর পরিবার। মিশন ডেভেলপার নামে জামায়াতপন্থি একটি কোম্পানির তৈরি বাড়িতে আছে ১২টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ছয়টি পেয়েছেন নিজামী, ছয়টি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য কম করে হলেও দুই কোটি টাকা। এভাবে মন্ত্রী থেকে কমপক্ষে ১২ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন নিজামী।
উত্তরায় মুজাহিদের ছয়তলা ভবনটির নাম ‘মিশন তামান্না’। অর্ধেক ভাগাভাগির শর্তে সেই মিশন ডেভেলপার গড়ে তুলেছে প্লটটি। এই বাড়ির পাঁচটি ফ্ল্যাটের মালিক মুজাহিদ। এই ভবনের তৃতীয় তলায় থাকেন মুজাহিদের পরিবার। মিশন ডেভেলপারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিচতলায় গাড়ি পার্কিংসহ অন্য পাঁচটি ফ্লোরে রয়েছে দুটি করে মোট ১০টি ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ১৪৬২ বর্গফুট। এই এলাকায় প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম দেড় কোটি টাকার বেশি।
যোগাযোগ করা হলে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে ধারায় তাদের প্লট দেওয়া হয়েছে, তাতে ধারাটির অপব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্লট দুটির বরাদ্দ বাতিল করা সম্ভব নয়। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা এলে বাতিল করতে পারব। এর আগেও এভাবে বরাদ্দ দেওয়া প্লট বাতিলের নজির আছে এবং সেটা সরকারই করেছে।’
রাজউকের কর্মকর্তারা জানান, দুই আলবদর নেতাকে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আলোচনা ওঠার পর সে সময় প্রতিক্রিয়া হয় রাজউকে। কিন্তু সরকারের বিশেষ নির্দেশনা থাকায় সংস্থাটির কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এর বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি।
যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের পরও প্লট বাতিল না হওয়ায় ক্ষোভ
চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে প্রশাসন এবং সরকারের ভেতরে প্রশ্ন ওঠলেও জোট সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়ার আগে বিষয়টি গোপন থাকে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বিষয়টি। এরপর নানা সমালোচনা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ হলেও নিজামী-মুজাহিদের প্লট বাতিলে সিদ্ধান্তহীন থাকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামী-মুজাহিদের বিচার শুরু হলে আবারও দাবি ওঠে আলবদর নেতার প্লট বাতিলে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির আদেশ হয়েছে নিজামীর। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করায় আইনের চোখে তাকে এখনো দ-িত হয়ত বলা যায় না। কিন্তু মুজাহিদকে বলা যায় নিশ্চিতভাবেই। ট্রাইব্যুনালের পর আপিল বিভাগও মুজাহিদের প্রাণদ- বহাল রেখেছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় প্রাণদ-প্রাপ্ত আলবদর নেতা রাষ্ট্রীয় অবদানের জন্য প্লট পাবেন সেটা মানতে পারেন না শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর মেয়ে চিকিৎসক নুজহাত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের অপরাধীদের রাষ্ট্র কোনোভাবেই পুরস্কৃত করতে পারে না। তারা কী অবদান রেখেছে, উল্টো তো এই রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের ধ্বংসের জন্য কাজ করেছে।’ আলবদর নেতারা প্লট পেয়েছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারকে কি সরকার তা দিয়েছে? নুজহাত চৌধুরী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু চাই না। আমার অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা নেই। কিন্তু আমি মনে করি, যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সময় মতো সহায়তা না পাওয়ায় ওঠে দাঁড়াতে পারেনি তাদের জন্য রাষ্ট্রের অনেক করণীয় আছে।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর মেয়ে বলেন, ‘নিজামী-মুজাহিদকে দেওয়া প্লট বাজেয়াপ্ত করতে হবে। কেবল এই দুজনের নয়, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সবার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সে টাকা দিয়ে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসিত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার কেবল সাজা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। যুদ্ধাপরাধীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে আর যারা এ দেশের জন্য লড়াই করেছেন তাদের পরিবার ধুঁকে ধুঁকে মরবে এটা হতে পারে না।’
নিজামী-মুজাহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের প্লট বাতিলের বিষয়ে সে সময়ের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান বলেছিলেন, চূড়ান্ত রায় হলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ গণহত্যা, হত্যা ছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে। তবে আগের প্রতিমন্ত্রীর কথার সঙ্গে বর্তমান গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বক্তব্যের অমিল পাওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রী এখন বলছেন, আদালতের রায়ের সঙ্গে মুজাহিদের প্লট বরাদ্দের কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সময়কে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, ‘মুজাহিদের মামলার রায় এবং প্লট বরাদ্দ আলাদা বিষয়। বরাদ্দে যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ অবশ্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে দ-িত নেতাকে রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া কতটা নৈতিক সে প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলেন, ‘মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি নিয়ে যদি কেউ মুজাহিদের প্লট বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
ট্রাইব্যুনালে প্রথমে মুজাহিদ ও পরে নিজামীর ফাঁসির রায়ের পর থেকেই তাদের সরকারি প্লট বরাদ্দ বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সরকারি সম্পত্তি দেওয়া এটা তো আমি মনে করি একটি অপরাধ। নিজামী-মুজাহিদকে যদি রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জমি দিতে হয়, তাহলে তো বলতে হবে একাত্তরে তাদের অপরাধের পক্ষে এই রাষ্ট্র। তাহলে তো এও বলতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এই রাষ্ট্র।’ শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘যারা প্লটের বরাদ্দ বাতিল করছে না তারা তো মনে হচ্ছে জামায়াতের লোক। তা না হলে কেন তা বাতিল হবে না এতদিনেও?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি এতদিন ভাবিনি। তবে আইনি দিক খতিয়ে দেখব। তবে এটা তো বলাই যায় যে, এ ধরনের লোকদের সরকার পুরস্কৃত করলে তা মুক্তিযুদ্ধকেই অপমান করার শামিল।’
আলবদর নেতা মুজাহিদের যেসব অপরাধ প্রমাণ হলো
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের শক্তিকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধে মুজাহিদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে আপিল বিভাগে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের আগে আগে স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এ দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আলবদর বাহিনী। এই বাহিনী গঠনের শুরুতে মুজাহিদ ছিলেন দ্বিতীয় প্রধান। পরে নিজামী জামায়াতে যোগ দিলে মুজাহিদই হন বাহিনীটির প্রধান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিম পাকিস্তানে যে গোপন প্রতিবেদন পাঠাত তাতে আলবদর বাহিনীর পক্ষে নিজামী-মুজাহিদের তৎপরতার কথা বিস্তারিত লেখা আছে। এতে দেখা আছে, আলবদর বাহিনী সংগঠনে আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নির্মূল করে দিতে দেশজুড়ে এই দুই নেতা চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। ঢাকার মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং আলবদরের ক্যাম্পেও নিয়মিত যাতায়াত করতেন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে সেখানে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে মুজাহিদ তার কর্মীদের আত্মগোপনে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি এও বলেন, সময় ভালো হলে আবারও ফিরে আসবেন তারা। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও স্বাধীনতাকামীদের গণহত্যা, নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ- দেয় ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, অপহরণ করে আটক রাখা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, এসব অপরাধে সহযোগিতা, প্ররোচনা, উসকানি দেওয়ার সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ এনেছিলেন প্রসিকিউশন। যার পাঁচটিই প্রমাণ হয়েছে। আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেন, আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এই বাহিনীর যত নৃশংসতা আছে তার দায় মুজাহিদের উপরও পড়ে। আর এই বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েই ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।
এছাড়া ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে আটক ও নির্যাতন, ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগও প্রমাণ হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদ- এবং দ্বিতীয় অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে জামায়াত নেতার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার ঘটনার অভিযোগও প্রমাণ হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে। তবে ট্রাইব্যুনাল তাকে এই অভিযোগে প্রাণদ- দিলেও আপিল বিভাগ দেয় যাবজ্জীবন কারাদ-।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।