logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
খবরওয়ালাদের লক্ষ্মণরেখা
ঢাকাটাইমস ডেস্ক
০৭ আগস্ট, ২০১৫ ১৭:১৪:১৮
image

ঢাকা: জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা৷ কেউ একটু পিছিয়ে গেলেই আর একজন ছাপিয়ে যাবে৷ অতএব যেনতেনপ্রকারেণ খবর চাই৷ কিন্তু খবরের দৌড়ে কতদূর যেতে পারেন খবরওয়ালারা? খবরের দুনিয়ায় এথিকসের আজ কি কোনও দাম আছে? গণমাধ্যমের বিপ্লবের মধ্যে বসে সে উত্তর খুঁজলেন বিশ্বদীপ দে।


আমাদের ছোটবেলায় একটা রচনা আসত। সমাজ গঠনে সংবাদপত্রের দায়িত্ব ও ভূমিকা। সহজ বিষয় ছেড়ে এই ধরনের বিষয়কে পরীক্ষায় কেউ হয়তো অ্যাটেন করতে চাইত না। কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতির কারণে অনেক সময়ই এগুলো পড়ে রাখতে হত। রচনা কমন না এলে যাতে ভরাডুবি থেকে রক্ষা হয়।


এখনকার ছাত্রছাত্রীদের এই ধরনের রচনা লিখতে হয় কি না জানি না। আজকাল তো সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের ধাঁচ অনেকটাই বদলে গেছে। কিন্তু যদি রচনা বা অনুচ্ছেদ ইত্যাদি লিখতে হয়, সেক্ষেত্রে তারা কী লিখবে? ‘সংবাদপত্র’ বা আরও বড় করে বললে সমগ্র মিডিয়ার ধরাচুড়ো যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে কেবল আগেকার কথাগুলো লিখে দিলে কি সেই ছাত্রছাত্রীকে খুব বেশি নম্বর দেওয়া যাবে?


মিডিয়ার কাছে আজকাল যেগুলো ‘খবর’ হয়ে উঠছে সেগুলির সবগুলি কি আদৌ ‘খবর’? সন্দেহ থেকে যায়। পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, ঠিক কতটা এবং কত দূর খবর প্রকাশ করা হবে। সোজা কথায় ‘লক্ষ্মণরেখা’ ঠিক কোনখানে টানা আছে সেটা খেয়াল রাখা। ইদানিং কিন্তু সেই লক্ষ্মণরেখার কথা আর কেউ মাথায় রাখতে চাইছে না।


এখানে ‘ইদানিং’ কথাটা নিয়ে অবশ্য তর্ক চলতেই পারে। সেই কবে লেডি ডায়নার মৃত্যুর সময়েও তো পাপারাৎজিদের বাড়াবাড়ি নিয়ে তুমুল তর্ক চলেছিল। বিভিন্ন সময়ে সেলেবদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দিয়ে ‘খবর’ তুলে আনা নিয়ে মিডিয়াকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বহুদিন আগে থেকেই। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূ সম্পাদিত ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়া মন্ত্রীকে টাইট দিতে তাঁর ছেলের স্ক্যান্ডালের খবর বিস্তারিত ভাবে ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে অব্যর্থ প্রমাণস্বরূপ প্রকাশিত হয়েছিল সেই কেলেঙ্কারির ‘এক্স’ রেটেড ছবিও! সেটা সেই সাতের দশকের কথা। কাজেই ‘লক্ষ্মণরেখা’ সেই কবে থেকেই অতিক্রম করা চলছে।


কিন্তু এগুলি নিতান্তই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। আমরা এখন যে যুগে বাস করছি, সেখানে চারপাশে গিজগিজ করছে ‘খবর’। ২৪ ঘণ্টার নানান নিউজ চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল… আর খবরের কাগজ তো আছেই। ফলে ‘খবর’-এর ম্যানুফ্যাকচার বেড়ে গেছে হইহই করে। মানে বাড়তেই হয়েছে তাকে। এত এত ‘খবর’ যদি আপনাকে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে কি অত কিছু মাথায় রাখলে চলে। সঙ্গে রয়েছে নতুন ‘খবর’ প্রকাশের অস্থির প্রতিযোগিতাও। সব মিলিয়ে ‘নিউজ’ ব্যাপারটাই এক আশ্চর্য মেক ওভার ঘটিয়ে ফেলেছে। ইনফরমেশনের গায়ে এসে জুড়ে গেছে এন্টারটেনমেন্ট। হার্ডকোর নিউজকে এন্টারটেনমেন্টের সোনালি তেলে ভেজে মুচমুচে করে পরিবেশন করা হচ্ছে। লোকে গপাগপ খাচ্ছে। আর সেই ‘খবর’ জোগাড় করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ‘লক্ষ্মণরেখা’র গণ্ডি।


মানসিক অসুস্থতায় ভোগা পার্থ দে-র রহস্যময় দিনযাপনের গা ছমছমে ঘটনাগুলি জনমানসে কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ভাবুন। টানা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ওই একই খবর। নিউজ চ্যানেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আলোচনা। কিন্তু একই কথা তো আর বলা যায় না। তাই প্রতিদিন কেসটি থেকে নতুন নতুন ‘অ্যাঙ্গেল’ বের করার চেষ্টা চলতে লাগল। এভাবেই খবর তৈরির তাগিদে একজন মানুষের ডায়রির পাতায় লেখা ব্যক্তিগত অনুভূতিকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ করে প্রকাশ করা হল। তাঁর সঙ্গে চিকিৎসকদের কী কথা হল, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল ফলাও করে। এইভাবেই সেই মানুষটির ‘ব্যক্তিগত’ সব কিছুকেই একদম প্রকাশ্য করে তবে যেন শান্তি হল সবার! রিয়েল লাইফের এই ‘সাইকো’ মানুষটির অপরাধ কী, তিনি ঠিক কতটা অপরাধ করেছেন, তাঁর বাড়িতে ঘটে যাওয়া মৃত্যুগুলির মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে সেগুলি সামনে আসা অবশ্যই দরকার। কিন্তু তদন্ত চলার সঙ্গে সঙ্গে, সব কিছুকে জনসমক্ষে পেশ করাটা কি ‘লক্ষ্মণরেখা’ ডিঙিয়ে যাওয়া নয়? তিনি অপরাধী হতে পারেন, মানসিক রুগিও হতে পারেন। তা বলে তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ বলে কিচ্ছু থাকতে পারে না?


আবার ধরুন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা। এই তো ক’দিন আগে একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে তাঁর বছর কুড়ি আগের দুটি ছবি ছাপা হল। রুপোলি পর্দা থেকে সরে এসে যে মানুষটি নিজের চেহারাকে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে সকলের থেকে বহু দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, মুহূর্তে তাঁর সেই ইচ্ছেকে একেবারে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাতা জুড়ে ছাপা হল তাঁর পক্ককেশ, অশক্ত হতে থাকা শরীরের ছবি!


সপ্তাহখানেক আগের কথা। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের মৃত্যুতে সকলের ফেসবুকের দেওয়াল যখন ভরে উঠছে শোকজ্ঞাপনে, ঠিক তখনই এক কলেজ ছাত্রী লিখে ফেললেন একদম উলটো কথা। বর্ষীয়ান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে অকস্মাৎ ছুটি পাওয়ার আনন্দে করা সেই পোস্টটি মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে উঠল। চূড়ান্ত নিন্দনীয় সেই পোস্টটিকে কেন্দ্র করে ওঠা ঝড়ের দাপটে মেয়েটি নিজের অ্যাকাউন্টটিও ডিলিট করে দিতে বাধ্য হয়। এর পর খবরটি উঠে এল কাগজের পাতাতেও। এই ‘স্টেটাস’টি এভাবে জনসমক্ষে আনা কতটা ঠিক সেটা সত্যিই ভাববার বিষয়। বিশেষত মেয়েটির পরিচয় গোপন না রেখে। হ্যাঁ, খবরে তাঁকে ‘জনৈকা ইউজার’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও খবরের সঙ্গে দেওয়া পোস্টটির ছবিতে মেয়েটির নাম, প্রোফাইল পিকচার একদম স্পষ্ট!


এগুলি নেহাতই হিমশৈলের চূড়া। এরকম ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটছে। ঘটে চলেছে। বারংবার টপকে যাওয়া হচ্ছে ‘লক্ষ্মণরেখা’। আসলে টিভির পর্দায়, কাগজের পাতায়, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে খবর। আর তড়িঘড়ি সেই ‘খবর’ তৈরি করতে গিয়ে (পাশাপাশি ‘খবর’কে সেনসেশনালাইজ করার অভিপ্রায়েও) অত কিছু কেউ মাথায় রাখছে না। ধোঁয়া ওঠা ‘ব্রেকিং নিউজ’ পাতে পড়লে পাবলিকও খাচ্ছে চেটেপুটে। ওসব লক্ষ্মণরেখা-টেখা নিয়ে কে আর অত মাথা ঘামায়। বরং পড়া হয়ে গেলে জমিয়ে একটা বিদ্রোহী স্টেটাস আপডেট দিয়ে দিলেই হবে। খেল খতম।


(ঢাকাটাইমস/৭আগস্ট/জেবি)