ঢাকা: রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার ও রায় ঘোষণা এক নজিরই স্থাপন করল বলা যায়। মাত্র চার মাসে ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে রায় দেয়া হলো রাজন হত্যা মামলার। তিন মাস পাঁচ দিনে মাত্র ১১ বিচারিক কার্যদিবসে রাকিব হত্যা মামলার রায় দিলেন আদালত।
রবিবার সিলেট ও খুলনার আদালতে রায় দুটি ঘোষিত হয়। রাজন হত্যা মামলায় কামরুলসহ চারজনের এবং রাকিব হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এই দুই শিশু হত্যা মামলা জনগণের সামনে আনা এবং আসামিদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার হওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধমের ভূমিকাকে অনেকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা বলছেন, এ দুই মাধ্যমে দেশজুড়ে এমনকি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় না হলে হয়তো রাজনরাকিব হত্যার ঘটনা চাপা পড়ে যেত; আর তাতে পার পেয়ে যেত খুনিরা।
সিলেটে রাজনের খুনিরা নিজেরাই নির্যাতনের দৃশ্য ধারণ করে এর ভিডিও ইন্টারনেটে ছাড়ে। সেটাই কাল হয় কামরুলদের।
গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে পূণ্যভূমি সিলেটে চুরির অপবাদ এনে রাজন নামের ১৩ বছরের এক শিশুকে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করেন কামরুল ও আরও কয়েকজন। পরে লাশ গুমের চেষ্টা করতে গিয়ে জনতার আটক হন কামরুলের এক ভাইসহ দুজন।
এর কদিন পরই খুলনায় এক ওয়ার্কশপে কাজ ছেড়ে দেয়ায় শিশু রাকিবকে মলদ্বার দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করে ওয়ার্কশপের মালিক। তাকেও জনগণ পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়।
দুই ঘটনাতেই দেশ-বিদেশে বিপুল তোলপাড় ওঠে ফেসবুকে। বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় মানুষ।
সিলেটে রাজনকে নির্যাতনের সময় করা ভিডিওটি ঘাতকরা নিজেরাই ছেড়ে দেয় ইউটিউবে। এরপর সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব পাড়ি দেন ঘটনার মূল হোতা কামরুল ইসলাম। কিন্তু পালিয়েও নিস্তার পায়নি ঘাতক। ফেসবুকে ছবি ও পরিচয়ের কল্যাণে সৌদি আরবে কামরুল ধরা পড়েন প্রবাসী বাংলাদেশির হাতে। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সৌদি আরব প্রতিনিধির কৌশলের জালে আটকা পড়েন তিনি। পরে সৌদি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
নির্যাতনের মাধ্যমে শিশু হত্যার ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে সরকারের টনক নড়ে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। একে একে ধরা হয় আসামিদের। রাজন হত্যায় তার বাবার মামলা না নেয়া ও আসামিদের পালানোর সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগে কয়েকজন পুলিশ সদ্স্যকে প্রত্যাহার করে নেয় প্রশাসন।
পরে রাজনের বাবার করা হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুলকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে সৌদি আরব থেকে দেশে আনা হয়।
বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হলো রবিবার। মাত্র চার মাসে ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে রায় দেয়া হলো। আদালত উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ১৩ আসামির মধ্যে কামরুলসহ চারজনের ফাঁসির দণ্ড দেন।
রায়ের আগে রাষ্ট্রপক্ষ এবং রাজনের পরিবার কামরুলসহ দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেছিল।
রাজন হত্যার মতো এমন বর্বর ঘটনায় সিলেটের সর্বস্তরের মানুষও দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার ছিল।
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা রাজন হত্যা মামলার দ্রুত বিচারের মাধ্যমে একটি নজিরই স্থাপন করলেন আদালত।
রাজন হত্যার পরপর খুলনায় মলদ্বার দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু রাকিব হাওলাদারকে হত্যার ঘটনায়ও তোলপাড় সৃষ্টিতে ভূমিকা আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের। ওই ভিডিওটিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
রাজন হত্যা মামলার রায়ের দিনই খুলনার আলোচিত রাকিব হত্যা মামলার রায়ও দেয়া হলো। রাজন হত্যার রায়ে চার মাস সময় লাগলেও রাকিব হত্যার রায়ে সময় লাগল তিন মাস পাঁচ দিন। এ ছাড়া মাত্র ১১ বিচারিক কার্যদিবসে আলোচিত এ হত্যার রায় দেয়া হয়, যাকে খুলনার আদালতে নজিরবিহীন ঘটনা বলেছেন আইনজীবীরা।
রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার এই দ্রুত বিচারের পেছনে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকার প্রশংসা করছেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.শাহ এহসান হাবীব ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবশ্যই এই ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ এমন অনেক ঘটনা ঘটলেও তা সেভাবে সামনে আসে না। তবে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিতে নজর দেয়ায় এটা আরো গতি পেয়েছে। যে কারণে দ্রুততম সময়ে রাজন হত্যা মামলার রায় হয়েছে।”
রাকিব হত্যার ঘটনায়ও অভিযুক্ত প্রধান আসামি শরীফ,তার মা বিউটি বেগম ও মিন্টুরও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি ছিল রাকিবের আইনজীবী ও পরিবারের। শরীফ ও মিন্টুকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার মা বিউটিকে খালাস দেন আদালত।
রবিবার দুপুরের দিকে খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিলরুবা সুলতানা চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় দেন।
এদিকে অল্প সময়ের মধ্যে দুটি আলোচিত শিশু হত্যা মামলার রায় হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যম যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। আশা করি এই রায়ের ফলে দেশে শিশু নির্যাতন কমবে। এই রায় বাংলাদেশে উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
(ঢাকাটাইমস/৮নভেম্বর/বিইউ/মোআ)