logo ২৩ এপ্রিল ২০২৫
এত বেপরোয়া কেন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ?

ইব্রাহিম খলিল, ঢাকাটাইমস
০৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:২২:১২
image


চট্টগ্রাম: মহানগর, উত্তর-দক্ষিণ জেলা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নানা অভিযোগ চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তাদের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষ সময়ে সময়ে আলোচনার ঝড় তুললেও সাম্প্রতিক সময়ে যেন একেবারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গসংগঠনটি।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলি সংঘটিত হয়েছে। সংঘর্ষে বন্ধ হয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল অ্যান্ড প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। মহানগরীর সিআরবিতে দখলবাজি নিয়ে সংঘর্ষ ঘটেছে। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটে লেগে থাকছে হামলা। উত্তর ও দক্ষিণ জেলা, এমনকি উপজেলার প্রতিটি পর্যায়ে একে অপরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। সবখানেই একটি নাম সামনে আসছে্- ছাত্রলীগ।

রাজনীতির মাঠে একসময়ের প্রতিপক্ষ বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির না থাকাটা যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সংগঠনটির জন্য। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে।

অবস্থা এমন দাড়িয়েছে,  এদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও যেন কারো নেই। বিষয়টি নজরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী একটু  ক্ষোভ প্রকাশ করলে সাময়িক বিরত থাকে তারা, পরে পুরোদমে আবার নেমে পড়ে নিজেদের কাজে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই নেতাকর্মীদের বেপরোয়া হওয়ার পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতা এমনকি মন্ত্রী-সাংসদরা।

আলাপকালে নেতাকর্মীরা জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা চার-পাঁচ দিন সংঘর্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে চসিক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন ও সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে।

এক দশকের  বেশি সময় ধরে দফায় দফায় এমন ঘটনা ঘটে আসছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দুই নেতার শিষ্যরা অতীতে সংঘর্ষের সময় শাটল ট্রেনে হামলা, আগুন, ক্যাম্পাস ভাঙচুর চালিয়ে ক্ষতিসাধন করেছে। কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে মেরেছে বহু মেধাবী ছাত্রকে।

নেতাকর্মীরা আরো জানান, একসময় বেশি প্রভাব ছিল এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিষ্যদের। সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বাড়তি শক্তি নিয়ে মাঠে নামে আ জ ম নাছির উদ্দিনের শিষ্যরা। তাদের আধিপত্য জানান দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতারা এখন বেপরোয়া।

আর নিজেদের ‘ঐতিহ্য’ ধরে রাখতে পিছু হটতে নারাজ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিষ্যরাও। তবে মেয়র নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে রাগে-ক্ষোভে সাংগঠনিক তৎপরতা থেকে নিজেকে একটু দূরে  রাখলেও সময়ে সময়ে রাজনৈতিক মাঠে ঠিকই উচ্চকিত হন এই সাবেক মেয়র।

নেতাকর্মীদের দাবি, চট্টগ্রামজুড়ে ছাত্রলীগের অশান্তির মূলে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দিনের নীরব দ্বন্দ্ব। দুই প্রভাবশালী নেতার  এই নীরব দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু বেপরোয়া  নেতাকর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

সংঘাত-সংঘর্ষ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে উপরের  চাপের মুখে কখনো অভিযান চালায় পুলিশ। তাও অনেকটা আই ওয়াশ হয়ে দাঁড়ায় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দিনের পাল্টা চাপে।

হাটহাজারী থানার ওসি মো. ইসমাইল যেমন বলেন, ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব ছাত্রনেতা দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এসব কাজে আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা পরস্পরে সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চসিক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, “অনুসারী হলেও সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। বরং দলের সুনাম ও মঙ্গলের জন্য আমরা তাদের সুপথে আনার চেষ্টা করি।” এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিকে দায়ী করেছেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, “কমিটি ঘোষণার সময় তারা এমন অনেক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেয় যে, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় রাখে না।”

এ ছাড়া অঙ্গসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন নগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে কমিটির মেয়াদ যত দিন ইচ্ছ বাড়ানো যায়। নগর ও জেলায় বিরোধ লেগে থাকলে কেন্দ্রীয় নেতাদের লাভ্।  তার সঙ্গে চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতাদের বিভাজনও এসবের জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগ কমিটির মেয়াদ পার হয়েছে অনেক আগেই। এখনো উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ওয়ার্ড, ইউনিট এবং কলেজ পর্যায়ে সম্মেলন করে কমিটি গঠন করতে পারেনি তারা। যেসব থানা ও পৌরসভায় কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানেই মারামারির ঘটনা ঘটেছে।

দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবদুল মালেক জনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর সেখানে ছাত্রলীগ আর সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত হতে পারেনি। সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি দিলেই লাশ পড়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে একাধিকবার কমিটি ঘোষণার তৎপরতা চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি।

নগর ছাত্রলীগের অবস্থাও তথৈবচ। এই কমিটিতে কতজন সদস্য রয়েছেন তা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও জানেন না। কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হতে চললেও আজ পর্যন্ত সব সদস্য পরস্পর পরিচিত হতে পারেননি। কমিটিতে এত বেশি লোক স্থান পেয়েছে যে, এদের কেউ কাউকে চেনেন না। যে কারণে কলেজ, ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে সম্মেলন করে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে পারছে না।

(ঢাকাটাইমস/০৯নভেম্বর/আইখ/মোআ)