বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
ঢাকা: জোট ছেড়ে কোনো দল চলে গেলেও বিএনপিতে টেনশন নেই। কারণ যারা চলে যায়, তাদেরই আরেক অংশ থেকে যায় জোটে। ফলে ২০ দলীয় জোটে শরিকদের সংখ্যা কমে না কখনো।
২০০১ সাল থেকে বিএনপি জোটে থাকা দলগুলোর যাওয়া-আসার এমন খেলা নিয়ে রীতিমতো বিব্রত অন্য শরিকরা। বিএনপিতেও আছে চাপা ক্ষোভ।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জোট ছাড়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি-জোটে ‘ভগ্নাংশের’ রেখে দেয়ার খেলা শুরু। সবশেষ উদাহরণ মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের বের হয়ে যাওয়া এবং অপর অংশকে রেখে দেয়া।
পেছনে ফিরলে দেখা যায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে ২০-দলীয় জোটে আসতে বহু দফা ভাঙন ঘটেছে। এর মধ্যে এগিয়ে আছে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট। এই কাতারে আরো আছে এনপিপি, এনডিপি, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামিক পার্টি।
তবে জোট ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক শরিকেরই কোনো না কোনো অংশকে রেখে দিয়ে সংখ্যা ঠিক রেখেছে জোট-প্রধান বিএনপি। জোট থেকে শরিক দলের বের হয়ে যাওয়া, আবার তাদের একটা অংশকে জোটে ধরে রাখার এ প্রবণতাকে সমাধান হিসেবে দেখতে রাজি নয় শরিকদের কেউ কেউ।
শরিক দলের নেতারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের উদাহরণ টেনে বলেন, এই জোট থেকেও আগে-পরে অনেক দল বের হয়ে গেছে। তাই বলে এ রকম ভগ্নাংশ রেখে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি সেখানে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে শরিক দলের চলে যাওয়া এবং ওই দলের এক অংশের থেকে যাওয়ার ধারাবাহিকতা চলে আসছে ১৯৯৯ সাল থেকে।
ওই বছরের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারকে হটাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ,জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে পাশে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে এরশাদ জোট ছাড়লে সাবেক মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ জোটে থেকে যায়।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ভাঙন ধরে ইসলামী ঐক্যজোটে। এই ভাঙনের পেছনে খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ আছে। দলটির প্রথম দফা ভাঙনের পর মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও আব্দুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্ব জোটে রয়ে যায় একটি অংশ। আর জোট থেকে বের হয়ে এই নামেই দল করেন শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক ও মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আবার ঐক্যজোটে ভাঙন ধরে। শায়খুল হাদিসকে বাদ দিয়ে একই নামে দল করেন মুফতি ইজহার ও মেজবাহুর রহমান চৌধুরী। পরে খেলাফত মজলিসের আমির হয়ে যান মাওলানা আজিজুল হক। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে চার দফা চুক্তি হয় শায়খুল হাদিসের। এর প্রতিবাদে ভাঙন ধরে খেলাফত মজলিসে।
পরে এই দলের হাল ধরেন মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মাওলানা আহমদ আব্দুল কাদের। তবে এই সময়ের মধ্যে একেক সময় একেক অংশ বিএনপির সঙ্গে থেকে জোটের সংখ্যা ঠিক রেখেছে। কখনো একই দলের দুই গ্রুপকেও বিএনপির সঙ্গে দেখা গেছে। তবে তাতে সংখ্যার পরিবর্তন হয়নি।
চারদলীয় জোটের ক্ষমতার শেষ দিকে জামায়াতকে নিয়ে সমালোচনা করে ইসলামী ঐক্যজোট নাম নিয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন মিজবাহুর রহমান ইসলামী। আর তখন থেকে রাজনীতি থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নেন মুফতি ইজহার।
বিএনপি-জোটের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টির পরবর্তী ভাঙন আরো করুণ। ২০০১ সালে জোট ক্ষমতায় আসার পর মঞ্জুর জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নামে এক অংশের নেতৃত্ব দেন নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও কাজী ফিরোজ রশীদ। আর অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ডা.আব্দুল মতিন এবং এ বি এম গোলাম মোস্তফা। পরে ফিরোজ রশীদ এরশাদের জাপায় ফিরলে মঞ্জুর গ্রুপের মহাসচিব হন শামীম আল মামুন। আর গোলাম মোস্তফা আওয়ামী লীগে গেলে তার জায়গা দখল করেন নূর মোহাম্মদ খান।
এখানেই শেষ নয়,ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি হয়ে নূর মোহাম্মদ খান বিএনপিতে এলে তার জায়গা পূরণ করেন আবু নাসের মো. রহমাতুল্লাহ। তিনিও এখন বিএনপিতে।
আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর মারা যাওয়ার পর থেকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ।। আর শামীম আল মামুন মারা যাওয়ার পর এখনো খালি মহাসচিবের পদটি।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে ১৮-দলীয় জোট হয়। শরিক দলগুলো হলো- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ।
পরে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল এই জোটে যোগ দিলে তা ২০-দলীয় জোটে পরিণত হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর শেখ আনোয়ারুল হক ও হাসরত খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ ভাসানী জোট থেকে বের হয়ে যায়। তবে তাতে জোটের সংখ্যায় কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ কল্যাণ পার্টির গাইবান্ধা জেলার সহসভাপতি ও ২০০৮ সালে কল্যাণ পার্টি থেকে এমপি নির্বাচনকারী অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম চেয়ারম্যান ও গোলাম মোস্তফাকে মহাসচিব করে গঠিত ন্যাপ ভাসানী বিএনপি-জোটে যোগ দেয়।
এরপর জোট ছাড়েন শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন এনপিপি। একই পথ ধরেন এনডিপির মহাসচিব আলমগীর মজুমদার, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির মহাসচিব এম এ রশীদ প্রধান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব আতিকুল ইসলাম। পরে সবাই যুক্ত হন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামের জোটে। তাতে কল্যাণ পার্টির সাবেক মহাসচিব আবদুল মালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে জাগদলও জোগ দেয়।
তবে কোনো কিছুই জোটের সংখ্যা কমাতে পারেনি। কারণ নিলু চলে গেলে তার দলের মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে এক অংশ এনপিপি হিসেবেই জোটে থেকে যায়। খন্দকার গোলাম মর্তুজার এনডিপি মূল অংশ মঞ্জুর হোসেন ঈসাকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করে জোটে রয়েছে।
সবশেষ দীর্ঘদিন জোটে থাকা ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দল ছেড়ে যায় গত বৃহস্পতিবার। সেদিন দুপুরে আব্দুল লতিফ নেজামী ও মুফতি ফয়জুল্লাহর নেতৃত্বাধীন দলটি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু এর দুই ঘণ্টা পরই একই দলের সাবেক সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রাকিব ও অধ্যাপক আব্দুর করিম নিজেদের ইসলামী ঐক্যজোটের দাবিদার উল্লেখ করে বিএনপির সঙ্গে থাকার ঘোষণা দেন।
আপাতত জোটের ভাঙাগড়া শেষ বলে মনে হলেও গুঞ্জন আছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কেউ কেউ জোট ছাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রেও ওই সব দলের বিকল্প ঠিক করা আছে বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে শরিকদের কারো কারো চলে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত নন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, জোটে থাকা-না থাকার স্বাধীনতা সবার আছে। কেউ লোভ-লালসায় পড়ে জোট ছাড়লেও তাতে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তাদের অভিযোগ, সরকার জোটে ভাঙন ধরাতে ষড়যন্ত্র করছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে আওয়ামী লীগ এখন ২০ দলে ভাঙনের চেষ্টা করছে।”
আর স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“এরা হলো বালুর বস্তার মতো। তবে জোটে থাকাটা তাদের জন্যই ভালো।”
(ঢাকাটাইমস/৯জানুয়ারি/বিইউ/মোআ)