logo ১৬ মে ২০২৫
মুসলিম সংস্কৃতি থেকেই বাংলা সনের উৎপত্তি
জহির উদ্দিন বাবর
১৩ এপ্রিল, ২০১৬ ১৫:৫৩:১৮
image



সংস্কৃতি মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে মন ও মননের বিকাশ ঘটে। ইসলাম মানুষের সহজাত ও প্রকৃতিগত একটি ধর্ম। ইসলাম সুস্থ ও শালীন ধারার সংস্কৃতিকে সযতনে লালন করে। যেকোনো ধরনের সুস্থ, সুন্দর, মননশীল সংস্কৃতির পক্ষে ইসলামের অবস্থান। সংস্কৃতির উৎস বা উপাদান বিভিন্ন হতে পারে। তবে সংস্কৃতির প্রধান উপাদান তিনটি এক. ভূখণ্ড, দুই. ভাষা এবং তিন. ধর্ম। সংস্কৃতির উৎপত্তি ও বিকাশের ধারায় ধর্মের অবস্থানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। যে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতির উৎপত্তি সেটা সে ধর্মেরই সংস্কৃতি। প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি থাকতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমেই সেই ধর্মের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধের প্রকাশ ঘটে। এর আবরণেই বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় পর্বটাও সম্পন্ন হয়ে যায়।






সে হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যারা বাংলায় কথা বলে এবং ইসলামি অনুশাসন মেনে চলে তাদের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলতে হবে। এটা শুধু মুসলমানদের সঙ্গেই বিশেষায়িত নয়। বাংলাদেশের হিন্দু বা বৌদ্ধ সংস্কৃতিও হতে পারে। সংস্কৃতি থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ বা মুসলিম বাদ দিয়ে শুধু বাঙালি বা বাংলাদেশি সংস্কৃতি বললে সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ধর্ম বাদ পড়ে যায়। এর দ্বারা সংস্কৃতিকে খাটো করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বাঙালি সংস্কৃতি নামে যে সংস্কৃতির চর্চা বা প্রচলন ঘটছে তাতে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির আধিক্যই বেশি। এটাকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া এক ধরনের অবিচার। পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিনটিকে তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে না ধরে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কেননা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রবর্তনের পেছনে অবদান মুসলমানদেরই। মুসলমানদের প্রয়োজনে মুসলিম সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই এর উৎপত্তি।






সন তারিখ গণনার শুরুর ইতিহাস সঠিকভাবে জানা না গেলেও একথা বলা যায় যে, এটা প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে। আর প্রয়োজনের তাগিদেই এর উৎপত্তি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ জাতীয় প্রয়োজনেই জন্ম হয়েছিল হিজরি সনের। সে যুগে অন্য কোনো সন গণনা না করে হিজরি সন গণনা করার পেছনে ছিল ধর্মীয় অনুভূতি। হজরত ওমর রা. এর সময় থেকে প্রবর্তিত হয় হিজরি সন। তখন খেজিস্তানের বাদশা হরমুজান তার থেকে হরমুজ সন গণনার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আলী রা. প্রস্তাব করেন হিজরতের দিন থেকে হিজরি সন গণনা করা হবে। আলী রা. এর প্রস্তাবই সবার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। পরবর্তী সময়ে তা গৃহীত হয় এবং হিজরি সন গণনা শুরু হয়। ১০০৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬০০ হিজরিতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয় করেন। তখন এদেশেও হিজরি সনের গণনা চলে। প্রায় ৩৬৩ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে এ তারিখের প্রচলন বহাল থাকে।






তদানীন্তর সময়ে এ অঞ্চলটি ছিল কৃষিনির্ভর। সেকালে জমিতে ফসল উৎপাদনের সময়কালকে ভিত্তি করে জমির খাজনা আদায় করা হতো। এ ক্ষেত্রে হিসাব করা হতো হিজরি সনের। কিন্তু হিজরি সন চন্দ্রমাসভিত্তিক হওয়ায় তা কোনো ফসলি মৌসুম মেনে চলতো না। তাই খাজনা আদায়ের হিসাব নিকাশ সংরক্ষণে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়। তখন ছিল মোঘল বাদশা সম্রাট আকবরের শাসনামল। তার শাসনামলের ২৯ বছর পেরিয়ে যাবার পর এ সমস্যা সমাধানের পন্থা নিয়ে কথা ওঠে। এর আশু সমাধান বের করতে আকবর তার রাজসভার রাজজ্যোতিষ বিজ্ঞ পণ্ডিত ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। ফতেহউল্লাহ সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী সৌরমাসভিত্তিক ফসলি সন প্রণয়ন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ৯৬৩ হিজরি ২৮ রবিউস সানী। সম্রাটের সিংহাসনে আরোহনের এ স্মৃতিকে চিরভাস্বর করে রাখতে ফতেহউল্লাহ ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ ধরে ৯৬৩ সনকে মূল ধরে ফসলি সন গণনা শুরু করেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই ফসলি সন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ নাম ধারণ করে। এখানে বঙ্গাব্দের সঙ্গে হিজরি সনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ৯৬৩ হিজরিতে জন্মলাভ করে ৯৬৩ বছর ধরে গণনা শুরু অর্থাৎ জন্ম থেকেই বাংলা সালের বয়স ৯৬৩ বছর। তাই হিজরি সনকে বাংলা সনের ভিত্তি বলা চলে। যেহেতু চন্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১ দিনের পার্থক্য রয়েছে এজন্য এ দুটির মধ্যে সমতা রাখা সম্ভব হয়নি।






এ থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, বাংলা সন মুসলিম সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। সুতরাং পয়লা বৈশাখ উদযাপনও মুসলিম সংস্কৃতি অনুযায়ী হওয়াই বাঞ্চনীয়। বর্তমানে আমাদের দেশে পয়লা বৈশাখ নামে যে সংস্কৃতি চালু আছে তা ইসলামের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পয়লা বৈশাখ পালন করতে হলে ইসলামি সংস্কৃতি ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ীই করতে হবে।