logo ১৬ মে ২০২৫
ইসলামে মাজহাব অনুসরণের গুরুত্ব
লিয়াকত আমিনী
১৬ এপ্রিল, ২০১৬ ২৩:৪৭:৩৫
image



মাজহাব মানার অর্থ হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে কুরআন ও হাদিস মানা। মাজহাব নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও তাকলিদ তথা মাজহাব ছিল। প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরামই ছিলেন এক একজন মুজতাহিদ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম মাসলা-মাসাইলসহ যে কোনো সমস্যায় পড়লে রাসুল (সা.)এর কাছে যেতেন এবং সে ব্যাপারে রাসুলকে জিজ্ঞাসা করতেন। রাসুল (সা.) নিজেই হাদিসের মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান দিতেন।






পৃথিবীতে যত মাজহাব আছে, সব মাজহাবই সৃষ্টি হয়েছে কুরআন-সুন্নাহ থেকে। প্রসিদ্ধ মাজহাব চারটি। চারটি থেকে যে কোনো একটি পুরোপুরিভাবেই মানতে হবে। চারটি মাজহাবের মধ্যে চারটিই বিশুদ্ধ। যে কোনো একটি মানলেই মাজহাব মানা হয়ে যাবে। মাজহাব মানার মাঝেই রয়েছে সফলতা। না মানার মধ্যে রয়েছে পথভ্রষ্টতা।






মাজহাব পরিচিতি: মাজহাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ, মত, ধর্ম, বিশ্বাস ইত্যাদি। মাজহাব, ইজতিহাদ, তাকলিদ শব্দগুলো আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত। বিশেষ করে মাজহাব শব্দটিই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। ইজতিহাদ শব্দটি আরবি। অর্থ হলো চেষ্টা করা, উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা।






পরিভাষায় ইজতেহাদ বলা হয়, যেসব হুকুম-আহকাম কুরআন ও হাদিসের মধ্যে অস্পষ্ট রয়েছে। মুজতাহিদ স্বীয় মেধা ও গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো আহরণ করবেন। আর সে আহরণকারীকে বলা হয় মুজতাহিদ বা গবেষক। আর মুজতাহিদদের মত ও পথকেই বলা হয় মাজহাব। মুজতাহিদ গবেষণার মাধ্যমে যা অর্জন করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করেছেন, তার সেই আমল অনুসরণ করার নামই হলো মাজহাব। মাজহাব অনুসরণ কারার নাম হলো তাকলিদ। আর যিনি অনুসরণ করেন তিনি হলেন মুকাল্লিদ। নিম্নে তাকলিদ সর্ম্পকে আলোকপাত করা হলো-






তাকলিদ পরিচিতি: তাকলিদের আভিধানিক অর্থ হলো অনুসরণ। পারিভাষিক অর্থ হলো, যিনি কুরআন ও হাদিস গবেষণা করে তা থেকে হুকুম-আহকাম গ্রহণ করতে অক্ষম, তার জন্য এমন ব্যক্তি থেকে হুকুম-আহকাম জেনে নেয়া যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অধিক জ্ঞানী তথা পারঙ্গম। আর এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী হলেন ফুকাহায়ে কেরাম তথা মুজতাহিদ। উদ্দেশ্য হলো সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের হুকুম জেনে নিয়ে সঠিকভাবে দ্বীনের আনুগত্য করা তথা আমল করা।






তাকলিদ হচ্ছে, ধর্মীয় অনুসরণেরযোগ্য মুত্তাকি কোনো বুযুর্গ তথা প্রসিদ্ধ মুজতাহিদের কথা ও কাজকে এই অবস্থার ভিত্তিতে গ্রহণ করা যে, তিনি কথা বা কাজ অবশ্যই কুরআন ও হাদিসের আলোকেই বলেছেন। সেই মুজতাহিদদের কথা মেনে নেয়া তথা সে অনুযাযী আমল করাই হলো তাকলিদ। (শরহে হুসামী)।






কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে তাকলিদ: রাসুলের যুগেও তাকলিদ ছিল। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলের কাছ থেকে তাকলিদ গ্রহণ করেছেন। তারা একে অন্যের তাকলিদ করেছেন। সাহাবাদের তাকলিদ গ্রহণ করেছেন তাবেয়ীগণ। আর তাবেয়ীদের তাকলিদ গ্রহণ করেছেন তবে-তাবেয়িগণ। বর্তমানেও আমরা তবে-তাবেঈগণের তাকলিদ অনুসরণ করছি।






পবিত্র কুরআনেও তাকলিদের কথা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসুলের এবং তোমাদের মধে যারা উলিল আমর তথা জ্ঞানী”। (সূরা নাহল, আয়াত-৪৩)।






এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন ও রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের সাথে উলিল আমর তথা জ্ঞানীদের আনুগত্য করার কথাও উল্লেখ করেছেন। ‘উলিল আমর’ শব্দটির দ্বারা কুরআন সুন্নাহর ইলমের অধিকারী, ফকিহ ও মুজতাহিদ ইমামদেরই বুঝানো হয়েছে। রইসুল মুফাসসিরীন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)সহ সবাই এ মতের স্বপক্ষে।






আল্লাহ তাআলা বলেন, “যদি তোমরা না জান, তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞাসা কর। (সুরা নাহল, আয়াত- ৪৩ এবং সূরা আম্বিয়া- ৭)।






এ আয়াতে জানা গেল, শরিয়তের বিধি-বিধান জানে না এমন ব্যক্তিদের উপর আলেমগণের অনুসরণ করা ওয়াজিব। আর এই অনুসরণ করাকেই তাকলিদ বলে। (তাফসিরে কুরতবী)।






হাদিসে তাকলিদ: হজরত হুযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন করেন, জানি না আর কত দিন আমি তোমাদের মাঝে থাকব; তবে আমার পরে তোমরা হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.) এ দুজনকে অনুসরণ করে যাবে। (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।






সাহাবি ও তাবেয়ীদের যুগে মাজহাব শব্দটির প্রচলন হলেও তারা মুজতাহিদ সাহাবিদের কাছ তাকলিদ করতেন এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে। (আহসানুল ফতওয়া- ১/৪১৫ পৃষ্ঠা)।






ইমাম দারেমী রচিত ‘সুনান’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হজরত উমর (রা.) এ আইন জারি করেন, যে মাসয়ালায় রাসুলুলাহ (সা.)-এর হাদিস পাওয়া যাবে না, সে ক্ষেত্রে হজরত আবু বকর (রা.)-এর ফতোয়ার ওপর আমল করতে হবে। যদি আবু বকর (রা.)-এর ফতোয়ায় না পাওয়া যায়, তাহলে আলেমদের পরামর্শের দ্বারা যে রায় গৃহীত হবে সে রায় কার্যকর করতে হবে। অথচ হজরত ওমর (রা.)ও ছিলেন একজন মুজতাহিদ এবং যাবতীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণ অধিকারী। তা সত্ত্বেও জীবনভর আবু বকর (রা.)-এর তাকলিদ করেছেন এবং তার ফতোয়া মোতাবেক রায় দিয়েছেন। এই উদহারণে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদি মাসয়ালা-মাসাইলের ক্ষেত্রে সমকালীন খলিফাদের মাজহাব মেনে চলতেন।






মাজহাবের সংখ্যা: দুনিয়াজুড়ে প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের অনুসারীদের অস্তিত্বই বেশি পাওয়া যায়। মাজহাবের মধ্যে প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মাজহাব হলো চারটি।






যথা-






১.   ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)এর মাজহাব। (মৃত্যু- ১৫০ হিজরি, বাগদাদ করাগারে)।






২. ইমাম মালিক (রাহ.)-এর মালেকী মাজহাব। (মৃত্যু- ১৭৯ হিজরি, মদিনায়)।






৩. ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর শাফেয়ী মাজহাব। (মৃত্যু- ২০৪ হিজরি, মিশরে)।






৪. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর হাম্বলী মাজহাব। (মৃত্যু- ২৪১ হিজরি, বাগদাদে)।






এই চার মাজহাবই উৎসারিত হয়েছে কুরআন-সুন্নাহ থেকে। কুরআন এবং হাদিসের মধ্যে যে মাসআলা-মাসায়িলগুলো সরাসরি উল্লেখ নেই, সেসব মাসআলা-মাসায়িলগুলোকে মূল উসুলের ওপর ভিত্তি করে কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন মাজহাবের ইমাম তথা মুজতাহিদগণ। যেহেতু এই চারটি মাজহাব-ই কুরআন এবং হাদিস থেকে উৎপত্তি হয়েছে, তাই চরটিকেই সঠিক ও হক মনে করতে হবে। চার মাজহাবের যে কোনো একটিকে অনুসরণ করলেই মাজহাব মানা হয়ে যাবে। চার মাজহাবকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা কুরআন এবং হাদিস অস্বীকারের-ই নামান্তর।






লেখক: আলেম ও সাংবাদিক