logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
আ.লীগ নেতাদের হাতে কর্মকর্তা লাঞ্ছনা দীর্ঘ হচ্ছে
আরিফ আজম, ফেনী থেকে
২১ মে, ২০১৬ ১৯:১৭:৫৮
image



 






ফেনী: পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম রকিব হায়দারের ওপর হামলার ঘটনায় মূল হোতা আওয়ামী লীগের নেতা খায়রুল বাশার তপন ও জসিম উদ্দিন বুইজ্জাসহ আট আসামির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। তারা বর্তমানে ফেনী জেলা কারাগারে রয়েছেন।






এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোনোটিরই বিচার না হওয়ায় এ তালিকা দীর্ঘ হয়েছে।






সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, সাধারণত টেন্ডার, টিআর, কাবিখাসহ সরকারি বরাদ্দ ও উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আবদার রক্ষা না হলে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি দলের নেতারা। আর সরকারদলীয় আসামিদের ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হন পুলিশের সদস্যরা।






সর্বশেষ ৬ মে শুক্রবার পরশুরামে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাস্থলের পাশে মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম রকিব হায়দার এক আওয়ামী লীগ নেতার ডাকে সাড়া না দেয়ায় তাকে মারধর করেন সরকারদলীয় নেতারা। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খায়রুল বাশার মজুমদার তপন এবং চিথলিয়া ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বুইজ্জাসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে পরশুরাম মডেল থানায় মামলা হয়। এজাহারভুক্ত ৫ ও সন্দেহভাজন ১ জন কারাগারে রয়েছেন। ঘটনার ৫ দিন পর আদালতে হাজির হয়ে খায়রুল বাশার মজুমদার তপন ও জসিম উদ্দিন বুইজ্জা জামিন আবেদন করলে বিচারক রাজেশ চৌধুরী তা নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে পাঠান।






ঘটনার প্রধান আসামি খায়রুল বাশার মজুমদার তপন ও জসিম উদ্দিন বুইজ্জাকে কারাগারে পাঠানোয় সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।






এর আগে গত পাঁচ বছরে এই উপজেলায় অর্ধডজনের মতো সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেন সরকারি দলের নেতারা। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি।






২০১৫ সালের মে মাসে লেমুয়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল আমিনকে লাঞ্ছিত করে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান তালুকদার।






২০১৩ সালের ১২ মার্চ উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক একরামুল হক পাটোয়ারীর দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলায় যুবলীগের কর্মী আবদুল হককে গ্রেপ্তার করলে ফুলগাজী বাজারে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে হ্যাতকড়াসহ তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবলীগের নেতা সেলিম, মহিউদ্দিন, মনছুর, সায়েম, শামীমসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা। তাদের হামলায় এসআই আক্তার আহত হন। এ ঘটনায় উল্লেখিতদের নামে মামলা হয়।






২০১২ সালের শেষের দিকে ঋণ বিতরণ অনুষ্ঠানে দাওয়াত না পাওয়ায় সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল আলমকে মারধর করে লাঞ্ছিত করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জেড এম কামরুল আনাম। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কর্মরত রয়েছেন।






২০১২ সালের অক্টোবরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মাদক ও আতশবাজি উদ্ধারে ফুলগাজীতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন ওসি সোলায়মান ও এসআই সালাহউদ্দিনের ওপর হামলা চালায় যুবলীগের কর্মী আবদুল হক ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হলেও আজও তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।






২০১২ সালে একাধিক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি যুবলীগের নেতা আরিফকে ধরতে গেলে হামলার শিকার হন এসআই রফিক। এ সময় আরিফ পুলিশ কর্মকর্তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেল পানিতে ফেলে যান। এ ঘটনায় মামলা হলেও হামলাকারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিনের ছেলে হওয়ায় বিষয়টি অনায়াসে ধামাচাপা পড়ে যায়।






২০১১ সালের ১১ এপ্রিল কাগজপত্র সত্যায়িত না করায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাহেদা আলম। এ ঘটনায় তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াছিন শরীফ মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক সফিকুল হোসেন মহিমসহ তাদের সহযোগীরা শিক্ষা অফিস ভাঙচুর করে। ঘটনাটি নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসিকে জানালে উল্টো ওই শিক্ষা কর্মকর্তাকে হুমকি-ধমকি দেয় তারা। তারা দুজন বর্তমানে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।






এসব ঘটনার মধ্যে কেবল সর্বশেষ ৫ মের ঘটনার কয়েকজন আসামি আটক হয়েছেন। অন্য ঘটনাগুলোর কয়েকটির ক্ষেত্রে মামলা হলেও সেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি, এমনকি আসামিও ধরা পড়েনি।






পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম রকিব হায়দারের ওপর আওয়ামী লীগের হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় প্রধান আসামি খায়রুল বাশার তপন ও জসিম উদ্দিন বুইজ্জা ১০ মে আদালতে আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, “পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম রকিব হায়দারের ওপর ঘৃণ্য হামলাকারী ১ নম্বর আসামি ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সন্ত্রাসী খায়রুল বাসার তপন এবং চিথলীয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন বুইজ্জা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। সব আসামিকে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ও কঠিন শাস্তি দাবি করছি।” প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায় সংগঠনটি।






এদিকে এইচ এম রকিব হায়দারের ওপর হামলায় গত ১১ মে বুধবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয়। ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন বক্তারা। তারা বলেণ, ভবিষ্যতে কেউ যাতে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করতে  সাহস না করে এ জন্য দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।






বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে চলছে এবং কর্মকর্তারাও এগিয়ে নেওয়ার পথে সর্বশক্তি নিয়োগ করছেন, সে মুহূর্তে এ ধরনের জঘন্য ঘটনা কর্মকর্তাদের মনোবলকে বাধাগ্রস্ত করছে।”






জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান বলেন, “সরকার ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি মামলার অভিযুক্ত অপর আসামিদেরও শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে।”






দুই অভিযুক্তের আত্মসমর্পণের দিন আদালত প্রাঙ্গণে নিজাম হাজারী এমপি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আলাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশে তাদের আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়েছি।”






(ঢাকাটাইমস/মোআ)