মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য পবিত্র একটি মাস। রোজা মানুষের খাবারের অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিবর্তিত করে। তিন বেলা আহারের পরিবর্তে দুই বেলা খাবার গ্রহণের কারণে মানুষের পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায়, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা অনুসারে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু অনেকেই সেহেরি এবং ইফতারের সময় অতিরিক্ত আহার করেন, যা শরীরের জন্য উপযোগী নয়। স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার রমজানের সময় রক্তের লিপিড পরিমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে, অতিরিক্ত ওজন কমায়, শরীর থেকে বিষাক্ত জিনিস বের করে দেয় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, যা আমরা অনেকেই জানি না। সারা দিন রোজা রাখার পর আমরা তেলেভাজা খাবারগুলোর ওপর একেবারে হামলে পড়ি যা আমাদের ক্ষতিই করে বেশি। হার্ট ও কিডনির নানারকম রোগের কারণ হতে পারে এসব তেলেভাজা খাবার। যেহেতু আমরা ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকি তাই শরীরে সব থেকে বড় ঘাটতি হয় পানির। এই পানি কিংবা পানীয়ই গ্রহণ করা হয় কম পরিমাণে যা একেবারেই উচিত নয়।
রমজানের সময় খাবারের পাঁচ বিভাগের সব বিভাগ থেকে খাবার গ্রহণ করা উচিত। এমন পরিমিতভাবে খাবার গ্রহণ করা উচিত যাতে ওজন না বাড়ে বা না কমে। সেহেরির সময় থেকেই খাবারটা ভালোভাবে পরিকল্পনা করে নিতে হবে। আপনার লেখাপড়া, সংসার বা অফিসের কাজ ও প্রাত্যহিক কাজের জন্য দরকার শক্তি, যা সুষম খাবার থেকে আসে। অনেকেই সেহেরি ছাড়া রোজা রাখেন। এটা ঠিক নয়। এরকম করলে হ্যালিটোসিস (অস্বাভাবিক দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস), মাথা ধরা, মাংসপেশির যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, কেননা তখন চর্বি কণাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার কাজে বিঘœ সৃষ্টি হয়। অনেকেই ক্ষুধা থাকে না বলে সেহেরি খেতে চায় না। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, সেহেরির আয়োজন ও খাবারের টেবিল সাজানোর কাজ ক্ষুধার সৃষ্টি করে।
সেহেরির সময় বেশি খাবার গ্রহণ করা যাবে না। কেননা অতিভোজন কোনোভাবেই ক্ষুধা মোকাবেলা করতে পারে না। অনেকেই মনে করেন অতিরিক্ত খাবার খেলে শেষ বেলায় কষ্ট লাগবে না, এই ধারণা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। বেশি খাবার পেটের জন্য একটি অপকারী বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। এর ফলে বদহজম হওয়া, বুকজ্বালা করা ও পেট ফেঁপে যেতে পারে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়া এবং সেহেরির জন্য ওঠা এই প্রক্রিয়া হজমের জন্য বেশ ফলদায়ক। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, দুধ জাতীয় খাবার, গোশত, ফলের সঙ্গে সবজি, দুধ, ফলের রস, হালকা কয়েক কাপ চা গ্রহণ করলে দিনের বেলায় পিপাসা কমে। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য এই খাবার বেশি উপকারী। ইফতার এবং সেহেরির মধ্যে কমপক্ষে ৬ গ্লাস পানি বা হালকা চা পান করলেও একজন ব্যক্তির পানির প্রয়োজনীয়তা থাকে না। হালকা লিকারের চা বা সামান্য লেবুর রস মেশানো চা এক্ষেত্রে উপকার দেয় বেশি। সেহেরির সময় বেশি বেশি পানি পান করলে তা পেটের খাবারকে তরলায়িত করে, ফলে পেট ফেঁপে যাওয়া এবং বদহজম দেখা দেয়। খাবার সময় অল্প অল্প করে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করতে হবে। ঢক ঢক করে পানি পান করা ঠিক নয়।
জটিল কার্বোহাইড্রেড খাবার যেমন রুটি, ভাত, আলু, হোল গ্রেন ব্রেড এসব সেহেরির সময় গ্রহণ করা যায়। ক্যান্ডি ও চকোলেট তাড়াতাড়ি শক্তি নির্গত করে তাই এগুলো গ্রহণ করা ঠিক নয়। রোজার কারণে শর্করা কমে যায়, এক্ষেত্রে উচ্চ কার্বোহাইড্রেড খাবার গ্রহণ করা যায়। এসময় লবণের ব্যবহার কমানো উচিত। কেননা এতে শরীর থেকে জলীয় অংশ নির্গত হয়, পিপাসা বাড়ে। পরিমিত লবণ ছাড়া বাড়তি লবণ যেন ব্যবহার করা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ইফতারের সময় চর্বি জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করলে সেহেরির সময় ক্ষুধা কমে যায়। অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার অবসাদও ডেকে আনে। কেননা এই জাতীয় খাবার হজমে প্রচুর সময় প্রয়োজন হয়। তাই হালকা খাবার গ্রহণ করতে হবে। স্যুপ এবং তরি-তরকারির ঝোল সঙ্গে খেজুর, দুধ এবং হালকা চা ইফতারের সময় খুবই ভালো। এতে রাতের খাবার গ্রহণের জন্য শরীর উপযোগী হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, ইফতারের সময় বেশি পানি পান করলে অনেক সময় অবসাদ ও পেটের যন্ত্রণা দেখা দেয়। ইফতারের সময় কখনোই বেশি খাওয়া যাবে না। সারা দিন অভুক্ত থাকার পর হঠাৎ করে বেশি খাবার পাকস্থলীর ওপর চাপ দেয়। ইফতারের পর অনেকে রাতের খাবার খেতে চান, তারা ইফতারের দু ঘণ্টা পর হালকা খাবার গ্রহণ করতে পারেন। ইফতারের পর ফল এবং বাদাম জাতীয় খাবার গ্রহণ খুবই উপযোগী। আধা গ্লাস ফলের রস ফলের পরিবর্তে গ্রহণ করা যায়। মিষ্টি জাতীয় খাবার উপেক্ষা করাই বাঞ্ছনীয়।
রোজার সময় কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, পেট ফাঁপা, অবসাদ, রুক্ষতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ঝিমুনি, রক্তচাপ কমা, মাথাধরা, মনোযোগ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীর ক¤পন, পেশি সংকোচন এসব বেশি দেখা দিতে পারে। এসব রমজানের খাবারের অসতর্কতা থেকে উৎপন্ন। ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার কমিয়ে ফেলা, সে সঙ্গে বেশি মশলাদার ও তেলেভাজা খাবার কমিয়ে আনা, কার্বোনেটেট সোডা কমানো এবং পানীয় জল জাতীয় খাবার কিছুটা বাড়িয়ে দিলে উপরের নানা খারাপ উপসর্গ চলে যায়।
যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, পায়ু পথের অসুবিধাজনিত রোগ রয়েছে তারা রোজা রাখার পূর্বে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন। যাদের পেপটিক ও ডিউডিনাল আলসার রয়েছে তাদের রোজা না রাখাই উচিত। কেননা এতে আলসারের ক্ষত বেড়ে যায় এবং পেটে রক্তপাতসহ খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। রোজা রেখে অতিরিক্ত ব্যায়াম বা কঠোর কোনো কায়িক শ্রমের কাজ করা ঠিক হবে না। এতে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। যাদের নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস আছে তারা যেন রোজার মাসে জোরে জোরে না হাঁটেন।
যদি কোনো রাজাদার ইফতারের পর শক্ত কোনো খেলাধুলায় অংশ নিতে চান, তবে তাকে ইফতারে গোশত, ডিমের কুসুম বা মাছ খেতে হবে। খেলোয়াড়দের বেশি বেশি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেড ও ভিটামিন দরকার। সেহেরির সময়ও তাদের বেশি পানি পান করা দরকার। খেজুর, স্যুপ, সবজি, দুধ এসব একজন খেলোয়াড়ের জন্য ইফতারে জরুরি খাবার। তবে ইফতারের তিন ঘণ্টা পর খেলা বা ব্যায়ামে অংশগ্রহণ করা উচিত কেননা এসব খাবার এই সময়ের মধ্যে হজম হয়ে যায়। ইফতার এবং খেলাধুলার মাঝের সময়টি মাংসপেশিতে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহের উপযুক্ত সময়।