ঈদ এবং গতিশীল বাজার অর্থনীতি
রিয়াজুল হক
০৫ জুলাই, ২০১৬ ১৫:৩৭:০৮

ঈদ মূলত মুসলমানের উৎসব হলেও আমাদের দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার মাঝে এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। উৎসবে যোগ দেয় সবাই। ঈদ এখন সবার জন্য। প্রতি বছরই বড় হচ্ছে দেশের ঈদের অর্থনীতি। ঈদের বাজার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পূর্বে পোশাক, কসমেটিকস কিংবা জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন মানুষ ঘরের আসবাবপত্র, ফার্নিচার সামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য, গাড়ি পর্যন্ত কিনছে। অনলাইন লেনদেনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এবার ঈদের অনলাইন বাজারও বেশ জমে উঠেছে। এ বছরের ঈদে দিনে প্রায় ২০ হাজার কেনাবেচা হচ্ছে ই-কমার্স মার্কেটগুলোতে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার। দেশে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় এর ওপর নির্ভর করে বর্তমানে প্রায় পাঁচশ ই-কমার্স সাইট এবং প্রায় তিন হাজারেরও বেশি ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায়ী অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির চেয়ারম্যানের মতে, দেশে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ২৫ লাখ দোকান রয়েছে। ঈদের সময় ৮০ শতাংশের অধিক দোকান বেচাকেনায় জমজমাট থাকে। এর সঙ্গে ফুটপাথসহ ঈদ উপলক্ষে আরও প্রায় পাঁচ লাখের বেশি ছোট ছোট দোকান বসে। এই ঈদে শুধু পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল তৈরি এবং আমদানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ পত্রিকায় এফবিসিসিআই এর পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিনের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বার্ষিক অর্থনীতির আকার প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা। এ বছর ঈদ অর্থনীতির আকার হবে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। গত বছর শেষ পর্যন্ত দেশে ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
প্রায় প্রতিবছর ঈদের বন্ধের পূর্বে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেশি থাকার কারণে মূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে। এ বছর শেয়ারবাজার ঈদ বন্ধের শেষ সপ্তাহে সূচকের উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।
চলতি বছরের মে মাস শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, গত বছরের জুন মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে যা সহায়ক। এছাড়া এ বছর দেশের সরকারি চাকুরেদের বোনাসের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, দোকান কর্মচারীর বোনাস চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস দুই হাজার ৫৫০ কোটি টাকা এবারের ঈদ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এফবিসিসিআই এর হিসাব মতে, প্রতি বছর জাকাত-ফিতরা বাবদ রমজান এবং ঈদের মাসের অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে বাড়তি ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যদিও এই টাকার একটি বড় অংশই চলে যায় গ্রাম এবং মফস্বল শহরে। তবে এ অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ধনীরা যদি সঠিকভাবে হিসেব করে জাকাত দিত, তবে সমাজে অনাহারী মানুষ আদৌ থাকত না। জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীদের মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৭৯ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এছাড়া, ঈদের ছুটির আগে বেশ চাঙ্গা অবস্থায় চলেছে পুঁজিবাজারের লেনদেন, যা পূর্বের বছরগুলো থেকে ব্যতিক্রম। সব দিক থেকেই এবারের ঈদ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করছে।
মানি মার্কেট বলতে যা বোঝায় তার বাস্তবিক উদাহরণ হচ্ছে ঈদের সময় আমাদের ছোট দোকানগুলো। ছোট ছোট দোকান হলেও এগুলোই এই সময়ে বিশাল পরিমাণের অর্থনীতিতে রূপ নেয়। ঈদ আমাদের অর্থনীতিতে বাড়তি গতিশীলতা আনায়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে যে বিদ্যমান সম্পদ বৈষম্য রয়েছে তা কিছুটা কমিয়ে সমাজকে বসবাসযোগ্য রাখতে প্রতিটি উৎসবের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। ঈদকে কেন্দ্র করেই শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত চাঙ্গা হয়ে উঠে আমাদের বাজার অর্থনীতি। এই ঈদও এর ব্যতিক্রম নয়।
লেখক: উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।