logo ০৩ জুলাই ২০২৫
আনারসের দেশে লটকনের দেশে
গাজী মুনছুর আজিজ
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১২:১৫:৫০
image



ষড়ঋতুর লীলা লেগেই থাকে বাংলাদেশে। মাসে মাসে ফুলে-ফলে মেলে নানা রূপ। বাহারি ভূগোলের বদৌলতে এলাকাভেদেও আছে বৈচিত্র্য। তারই ধারায় টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারসের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশজোড়া। জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস আনারসের পূর্ণ মৌসুম। এই ফল বিক্রির সবচেয়ে বড় হাট বসে মধুপুরের জলছত্রে।






এদিকে নরসিংদীর লটকন রপ্তানি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশ অবধি। এই জেলার শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলায় লটকনের বাণিজ্যিক চাষ বেশি হয়। লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে বাগান।






জলছত্রের হাটে...






সারি সারি ভ্যানভর্তি আনারস। ভ্যানের পাশাপাশি সাইকেলেও আনারস ঝুলানো আছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের জলছত্রের আনারসের হাট এটি। স্বাদের জন্য এখানকার আনারসের সুনাম দেশজুড়ে। সে সুনামের নমুনা দেখতেই এক শুক্রবার সকালে এখানে আসি। গাড়ি থেকে নেমে যখন হাটে পা রাখি তখন ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখর পুরো জলছত্র। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশে জমে ওঠা এ হাটের বিস্তৃতি বেশ জায়গাজুড়ে।






সাইকেল বোঝাই আনারস নিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় থাকা আলমগীর হোসেন বলেন, হাটের বেচাকেনা শুরু হয় খুব সকালে। চলে বিকেল পর্যন্ত। তবে হাটে যারা ভ্যানে বা সাইকেলে আনারস বিক্রি করেন, তাদের সবাই চাষি বা মহাজন নন। মূলত তারা চাষির বাগান থেকে আনারস কেটে তা হাটে এনে বিক্রি করেন এবং এজন্য প্রতি ১০০ আনারস বিক্রির জন্য ভ্যান বা সাইকেলওয়ালা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আবার অনেক চাষি বা মহাজন নিজেই সাইকেল বা ভ্যানে করে এনে বিক্রি করেন।






ভ্যান বোঝাই আনারস বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতি ভ্যানে ১০৫টি আনারস থাকে। তবে ১০৫টি হলেও ধরা হয় ১০০টি। একইভাবে সাইকেলের দুপাশেও ঝুলানো থাকে ১০৫টি আনারস। এগুলো বিক্রি হয় আকার ভেদে। সাধারণত এ হাটে বড় আকারের আনারস প্রতিটি পাইকারি বিক্রি হয় ১৬ থেকে ২১ টাকা। আবার একটু ছোট আকারেরগুলো প্রতিটি বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা।






হাটের পাইকাররা আসেন ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে। পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার আলী বলেন, সপ্তাহের শুক্র ও মঙ্গলবারে বসা এ হাটে অনেক বছর ধরেই আনারস বেচাকেনা করি। আনারসের মৌসুমে এ হাট ২৫ মাইলের মোড় থেকে শুরু করে পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আর আনারস বেচাকেনার জন্য দেশের সবচেয়ে বড় হাট এটি। এখান থেকে কিনে পাঠানো হয় ঢাকা। সিলেট, মৌলভীবাজার বা পার্বত্য চট্টগ্রামে আনারসের চাষ হলেও স্বাদের জন্য মধুপুরের আনারসের চাহিদা আছে সারা দেশেই।






বেশ কিছুক্ষণ হাটে ঘোরাঘুরি করি। কথা বলি হাটুরেদের সঙ্গে। বাজারের দোকানে গরুর দুধ দিয়ে বানানো চা খাই। তারপর ভ্যানে গ্রামের পথ ধরি আনারস বাগানের উদ্দেশে। যেতে যেতে পথে দেখি সাইকেল ও ভ্যান বোঝাই করে আনারস বিক্রেতারা হাটের উদ্দেশে আসছেন। ভ্যান থেকে নেমে কথা হলো হাটের উদ্দেশে আসা ইমতিয়াজ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে চাষির খেত থেকে নিজেই আনারস কেটে তা সাইকেলে বোঝাই করে রওনা হয়েছেন হাটের উদ্দেশে। বিক্রি করে পারিশ্রমিক পাবেন ৩০০ টাকা। বাকি আনারসের টাকা নিজেই পৌঁছে দিবেন চাষিকে। তার সঙ্গে কথা শেষে আবার উঠি ভ্যানে।






রাস্তার দুপাশে যেদিকেই দেখি, সেদিকেই কেবল আনারসের বাগান। কিছুক্ষণ চলার পর অরণখোলার জাঙ্গালিয়া গ্রামের খোদেজা বেগমের আনারস বাগানের সামনে নামি। খোদেজা বেগম বলেন, মধুপুরের প্রায় সব অঞ্চলে আনারস চাষ হয়। তবে অরণখোলা অঞ্চলে বেশি হয়। এখানকার জাঙ্গালিয়া, মাগন্তীনগর, বেরিবাইদ, আংগারিয়া, ধরাটি, পীরগাছা, কোনাবাড়ী, নয়নপুর, সাইনামারী, মমিনপুর, মালাইদ, রাজঘাট, কুড়াগাছা, চাপাইদ, পিরোজপুর, ভবানীটেকি, পলাইটেকি, আকালিয়াবাড়ী, কাকরাইদ, গাছাবাড়ী, বংশীবাইদ, টেলকী, গায়রা, জলই, ভুটিয়া, আমলীতলা, কামারচালা, ফেকামারী, গোবুদিয়া, চুনিয়া, খানপাড়া, চিকনবাইদ, ঝাটারবাইদ, পলটপাড়া, পাটপচা, কমলবাইদ, দিগলবাইদ, ফেইটামারী, রাজাবাড়ী, ঘেচুয়া, দানকবান্দা গ্রাম, ঘোলাকুঁড়ি ও আউশনাড়া ইউনিয়নসহ এর আশপাশের গ্রামে আনারসের চাষ বেশি হয়।






জাঙ্গালিয়ার আনারস চাষি কালাচান বলেন, আমাদের দেশে হানিকুইন, জায়েন্ট কিউ ও ঘোড়াশাল প্রজাতির আনারস চাষ হয়ে থাকে। তবে এ অঞ্চলে আগে বেশি চাষ হতো হানিকুইন বা জলডুগি আনারস। আর এখন চাষিরা বেশি চাষ করছেন জায়ান্ট কিউ প্রজাতির আনারস। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার টাঙ্গাইলে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। সাধারণত আমরা ফালগুন-চৈত্র মাসে আনারসের চারা রোপণ করি। স্বাভাবিকভাবে আনারসের বীজ হয় না। তাই পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশ বিস্তার করি। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বেশি উপযোগী। জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাসে ফল সংগ্রহের পূর্ণ মৌসুম।






চাষি রেখা বেগম বলেন, আমরা দুরকম চারা রোপণ করি। একটা ছোট আকারের, আরেকটা বড় আকারের। বড় আকারের চারা থেকে ফল আসতে ১৮ মাস সময় লাগে। আর ছোট আকারের চারা থেকে ফল আসতে লাগে ৩৬ মাস। বাকি সময়ে আমরা আনারসের পাশাপাশি আদা বা হলুদ চাষ করি।






চাষি কালাচান তার বাগান থেকে আনারস কেটে রাস্তার পাশে স্তূপ করছেন। তারপর নিজেই হাটে নিয়ে বিক্রি করবেন। তার সঙ্গে তার বাগানে যাই। সঙ্গে তার কন্যা মাসুদা খাতুনও আছে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বাগানে গিয়ে কালাচান দেখান আনারসের ফুল, ফল, চারাসহ চাষের নানা বিষয়।






বাগান থেকে ফিরে বসি কালাচানের বাড়ির বারান্দায়। টিনের চালা মাটির দেয়াল। তার মা বাগান থেকে সদ্য আনা পাকা আনারস কেটে লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে মাখিয়ে দেন আমাকে। আনারস অনেক খেয়েছি, তবে এ আনারসের স্বাদ অন্য তৃপ্তি দিয়েছে। সেইসঙ্গে কালাচান পরিবারের আতিথেয়তা প্রমাণ করে বাঙালি সত্যিই অতিথিপরায়ণ।






আনারস খেয়ে হেঁটে রওনা হই হাটের দিকে। রাস্তার দুপাশই বড় বড় গাছগাছালিতে ঢাকা। আসলে শালবনঘেঁষা এই এলাকার গ্রামগুলো দারুণ সবুজময়। কিছুক্ষণ হেঁটে ভ্যানে ওঠে আসি হাটে। হাটে বেচাকেনা চলছে। পাইকাররা আনারস কিনে ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানে তুলছেন। পাইকারির পাশাপাশি খুচরাও বিক্রি চলে। কেউ কেটেও বিক্রি করেন। অনেক ক্রেতা সদ্য বাগান থেকে আনা পাকা আনারস কিনে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুরও তোলেন।






প্রয়োজনীয় তথ্য : ঢাকার মহাখালী থেকে বিনিময় বাস মধুপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত। মধুপুর নেমে অটোরিকশায় বা প্রান্তিক বাসে জলছত্র যাওয়া যাবে। এছাড়া নিরালা, সকাল-সন্ধ্যাসহ বিভিন্ন এসি-ননএসি বাস যায় টাঙ্গাইল। সেখান থেকে আবার লোকাল বাসে যাওয়া যাবে জলছত্র। খাওয়ার জন্য জলছত্র হাটে রেস্টুরেন্ট আছে। থাকার জন্য মধুপুর শহরে হোটেল পাবেন।






থোকায় থোকায় ফল






থোকায় থোকায় লটকন ঝুলছে গাছের শরীরজুড়ে। এমনকি গাছের গোড়ার দিকে ঝুলে থাকা লটকন মিশেছে মাটির সঙ্গেও। বলা যায় লটকনে পরিপূর্ণ বাগানের প্রায় সব গাছ। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ছোটাবন্দ গ্রামের এ লটকন বাগানে ঢুকেই খায়েশ হলো লটকন খাওয়ার। বাগানের মালিক হাসান ভূইয়া হয়ত মনের কথা বুঝতে পেরেই বললেন -‘যে গাছ থেকে মন চায় ছিড়ে খেতে পারেন, যত খুশি খেতে পারেন।’ তিনি শুধু বলেই শেষ করেননি, সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন কোন গাছের লটকন মিষ্টি, আর কোন গাছের লটকন টক। তার কথা শুনে আর তর সইলো না। ছিড়ে খাওয়া শুরু করি। সঙ্গে কথাও চালাই।






হাসান ভূইয়া জানান, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলা এবং এর আশপাশের এলাকাজুড়েই লটকনের চাষ হয়। তবে বেশি হয় শিবপুর উপজেলাতেই। এখানকার যোশর, আগরপুর, মাকাল্লা, ভিটিখৈনকুট, দক্ষিণ কামালপুর, লালখারটেক, কামারটেক, চৈতন্য, চান্দারটেক, শরীফপুর, কুলুরটেক, টঙ্গিরটেক, পুরানা আটশিয়া, আমড়াতলী, কাজিয়ারা, লেটাব, মাছিমনগর, মালিয়ারা, নৌকাঘাটা, নন্দিরটেক, মুরগীবের, দেবালেরটেক, পাহাড়ফুলদী, শৈকারচর, শ্রীরামপুর, সৃষ্টিগড়, ভঙ্গারটেক, জাংখারটেকসহ আশপাশের সব গ্রামেই লটকনের বাগান আছে। দেশের অন্য এলাকায় লটকন হলেও স্বাদের জন্য এখানকার লটকনের সুনাম রয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলেই বাণিজ্যিকভাবে লটকনের চাষ বেশি হয়। আর এ লটকন যায় সারা দেশে।






জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত লটকনের পূর্ণ মৌসুম। তবে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্তও কিছু লটকন পাওয়া যায়। এখানকার লটকন বিক্রির হাট বসে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল বাজার বাসস্ট্যান্ড, শিবপুরের কামারটেক বাজার বাসস্ট্যান্ড, চৈতন্য বাজার ও গাবতলী বাজার। চাষিরা খুব সকালে লটকন ছিড়ে ছোট ঝুড়িতে ভরে নিয়ে আসেন বাজারে। সকালেই বাজার জমে। পাইকাররা আসেন ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে। অনেক পাইকার বাগান থেকেও কিনে নেন। পাইকার নাজমুল হক বলেন, মূলত স্বাদের জন্য এখানকার লটকনের চাহিদা বেশি থাকে। আর বাণিজ্যিকভাবেও এ অঞ্চলে লটকনের চাষ বেশি হয়। সকালে লটকন কিনে দিনে দিনেই পাঠিয়ে দেই মোকামে।












 






লটকন বাগানের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই লটকনের চারা লাগানো যায়, তবে আমরা সাধারণত বর্ষা মৌসুমে চারা লাগাই। চারা আলাদা করে কিনি না। গাছ থেকে লটকন পড়ে বা পাখি খেয়ে যে লটকন ফেলে দেয় সেই লটকন থেকেই চারা গজায়। সেই চারা লাগাই। লাগানোর চার বছর পর থেকে গাছে লটকন ধরতে শুরু করে। তবে চারা বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। এছাড়া খুব একটা যতœও করতে হয় না লটকন গাছের। মৌসুম শেষে গাছের গোড়ায় কিছু মাটি বা গোবর দেই।






লটকন বাগানের মালিক সিদ্দিক মিয়া বলেন, বড় আকারের একটি গাছ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত লটকন পাওয়া সম্ভব। আর একটি গাছ ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তবে লটকন গাছের কাঠ দিয়ে ফার্নিচার হয় না, কেবল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। লটকন বিক্রি হয় বড় বা ছোট আকার ভেদে। মৌসুমে বড় আকারের লটকন প্রতি মণ ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ছোটগুলো আরও কম দামে।






কথা বলতে বলতে কয়েকটি গাছের লটকন ছিড়ে খাই। কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা একটু টক। তবে মজার। আবার বাগান থেকে বের হওয়ার সময় হাসান ভূইয়া কিছু লটকন দিয়েও দিলেন ব্যাগ ভরে।






বাগান ছাড়াও এখানকার প্রায় সব বাড়ির আশপাশেই লটকনের গাছ আছে। আর প্রতিটি লটকন গাছ মানেই সম্পদ। সেজন্য লটকন অন্যতম অর্থকরী ফসলও বলে জানালেন এখানকার মানুষ।






লটকন খেয়ে বাগান দেখে আসি কামারটেক বাজারে। বাজারে দেখি কয়েকজন বিক্রেতা খুচরা লটকন বিক্রি করছেন। বাজারের হুমায়ূন কবিরের দোকানে গরুর দুধের চা খেয়ে বিদায় নেই লটকনের এ রাজ্য থেকে।






জেনে নিন : গুলিস্তান, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী থেকে সিলেট বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গাড়িতে শিবপুরের কামারটেক নামা যাবে। সেখান থেকে হেঁটে বা অটোরিকশায় ছোটাবন্দসহ এর আশপাশের গ্রামের লটকন বাগানে যাওয়া যাবে।






(ঢাকাটাইমস/৭সেপ্টেম্বর/এজেড/এমএইচ)