নাটোর শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড ও সিংড়ার চলনবিল গেটে পৌঁছালেই শোনা যাবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিচালকদের হাঁকডাক- ‘ঘুরে আসি এই কক্সবাজার। এই কুয়াকাটা।’
প্রথমটা একটু চমকে যেতে হয়। পরে চমক ভাঙে। না, আসলে এখানে কক্সবাজারের ছিটেফোঁটাও নেই। আছে এক বিল, যা নাম কিনেছে দেশের ওই জনপ্রিয় সাগর সৈকতের। বর্ষায় বিস্তৃত জলরাশি আর অজ¯্র পাখ-পাখালির সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি নৌকা ভ্রমণের আনন্দ পেতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে চলনবিল। যথাযথ তত্ত্বাবধান ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী এই চলনবিল একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
নাটোর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার উত্তরে পাটুলঘাটে চলনবিলের একটি অংশ হালতিবিল ও বিশ কিলোমিটার উত্তরে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ দুবন্ত সড়ক (কবিরগঞ্জ পার্ক) এলাকার একটি অংশ চলনবিলের ডুবন্ত সড়ক নামে পরিচিত। দুই বিলের মধ্যে রয়েছে কংক্রিটের তৈরি সমতল সড়ক। ভারি বৃষ্টি ও বন্যায় সড়ক দুইটিই তলিয়ে যায়। তখন চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মাঝে দ্বীপের মতো বেশকিছু গ্রামও চোখে পড়ে। ওই সময় ডিঙি নৌকায় বিলে ভেসে বেড়াতে গেলে মন ভরে যায়।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে চলনবিলের এই আনন্দ উপভোগ করতে এসেছেন অনেকেই। কেউবা এসেছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে, কেউ অটোরিকশা, ট্যাক্সি, নছিমন বা ভটভটি ভাড়া করে। সড়ক ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। দুই পাশ থেকে ঢেউ আছড়ে পড়ছে পথিকের পায়ে। যেন যতœ করে পা ধুয়ে দিচ্ছে। চারদিকে ¯্রােতের কলকল শব্দ আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের ডাক।
পাটুলঘাট থেকে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সড়ক এর দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। এ সড়কটিও চলনবিলের তলি দিয়ে তৈরি। বিলের পানি বাড়লে রাস্তা ডুবে যায়। তখন নৌকা চলে। খোলা বাতাসে বিলের ঠান্ডা পানিতে পা ভেজাতে এখানেও ভিড় করেন মানুষ। বিকালেই ভিড় বেশি হয়। ইচ্ছা করলে এখানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যায়। স্থানীয়রা চলনবিলের এই অংশের নাম দিয়েছেন ‘কুয়াকাটা সৈকত’।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক চলনবিলবাসীকে উপহার দেন সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ এই ডুবন্ত সড়কটি। ইতোমধ্যে চলনবিলবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ চলনবিলে পর্যটকদের সুবিধা বাড়াতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বগুড়া থেকে সপরিবারে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে প্রশংসা শুনে এখানে এসেছি। আসার পর এখানকার সৌন্দর্য্য দেখে অবাক লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই যেন কক্সবাজার এসেছি। পরিবারের লোকজন প্রতিনিয়তই আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।’
নাটোরের দিনমজুর রসুল আলী বলেন, ‘সারাবছর দিনমজুরি দিয়া খাই। আমাদের তো আর কক্সবাজার যাওয়ার সামর্থ নাই। তবে সামান্য খরচে যা দেখছি- তা টেলিভিশনে দেখা ক´বাজারের চেয়ে কম কী?’
কেমন খরচ হয়েছে জানতে চাইলে রসুল হাসিমুখে বলেন, ‘নাটোর শহর থেকে মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় এখানে আইছি। আর অন্যদের সাথে নৌকার ভাড়া দিছি ৩০ টাকা। এই তো খরচ!’
স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বেশি আসেন এখানে। সাধ্যের মধ্যে খুঁজে পেতে চান স্বস্তি ও সুখ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আসেন।
বিলহালতি ত্রিমোহী কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে বললেন, ‘আমি কক্সবাজারসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তার মধ্যে এখানকার সৌন্দর্যটা অন্য রকম। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অল্প খরচে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘোরা যায়। তবে এখানকার বড় সমস্যা, এখানে থাকা ও খাওয়ার ভালো হোটেল নেই।’
সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন ম-ল জানান, চলনবিলে স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ানোর জন্য নিরাপত্তার দিকে নজর রাখা হয়েছে। সাদা পোশাকের ফোর্সসহ পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য টহলে রাখা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/১৪ সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/এলএ)