ঢাকা: একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন, বেতার ও চলচ্চিত্র অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। ইতিমধ্যে দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও ছড়িয়েছে তার পরিচিতি। শিল্পের মানুষরা স্বভাবতই ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি নির্বিশেষে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। রাইসুল ইসলাম আসাদও তেমন একজন। ১০ মার্চ ঘোষণা দেওয়া হলো ষষ্ঠবারের মতো জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন তিনি। ৫০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা আসাদ অভিনয়ের মতো পড়াশোনায়ও ছিলেন মেধাবী। পুরান ঢাকার শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা রাইসুল ইসলাম আসাদ মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭১ সালে ২নং সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ঢাকার উত্তরে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তার গেরিলা কমান্ডার ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। যুদ্ধ থেকে পাওয়া না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে আসাদ বলেনÑ‘আমার কখনো আক্ষেপ হয় না। একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এটা অনেক বড় পাওনা। স্বাধীন দেশে বসে আক্ষেপের ভাবনাও ভাবছি এটা কম কিসে? তবে সে স্বাধীনতা ভূখ-ের। কিন্তু সংস্কৃতির স্বাধীনতা বিভিন্ন কারণেই হোঁচট খাচ্ছে। সংস্কৃতির বিপ্লব ছাড়া রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আর চেতনা শাণিত হয় না। দেশ আজ ধর্মান্ধ, মৌলবাদ, উগ্রবাদীদের রাহুগ্রাসে। আসলে আমাদের মূল ভাবনা থেকে এখন নানা কারণেই অনেক দূরে।’ যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার। ১৯৭২ সালে প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয়, তারপর ‘আমি রাজা হব না’ এবং ‘সর্পবিষয়ক গল্প’ নামের ২টি নাটক যার মাঝে বিরতি ছিল। তার ভাষায়, ‘অভিনয় করব এমন ভাবনা স্বপ্নেও ভাবিনি। একজন মঞ্চ নাটককর্মী হিসেবে কাজ করব। কিন্তু নির্ধারিত চরিত্রের অনুপস্থিতির কারণে কীভাবে যেন জীবনের প্রথম মঞ্চ নাটকেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করলাম। এরপর একই বছরের শেষদিকে স্বাধীন বাংলা বেতারের আবদুল্লাহ বাকীর হাত ধরে বেতারে কাজ শুরু। ওই বছরই শুরু হলো খান আতাউর রহমান পরিচালিত আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) চলচ্চিত্রের কাজ। চরিত্রের প্রয়োজনে তাতে অভিনয়ও করলাম।’ সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ও প্রয়াত বাদল রহমান তখন ভারতের পুনায় চলচ্চিত্রের ওপর শিক্ষাগ্রহণ (১৯৭৯) শেষে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে জাকী চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন বলে স্থির করেছেন। আমাদের করা মঞ্চ নাটকের প্লট নিয়ে ঘুড্ডি ও ঘূর্ণি নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। বিরতির আগে-পরে দেখানো হবে। আমার থাকার কথা ঘূড্ডির পেছনের দিকের সহকারী পরিচালক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করলাম, তখন তা ঘূর্ণি নয়, হয়ে গেল ঘুড্ডি। শুটিং শুরু হলো নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা কেল্লায় এক কস্টিউমে কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। এখনো সেই ঘুড্ডির মতোই ভেসে বেড়াচ্ছি। রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গেয়ে থাকেন। তিনি প্রথম গান গেয়েছিলেন ঘুড্ডি ছবিতে। আসাদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে এইসব দিনরাত্রি, সংশপ্তক, হৃদয়ের ছবি, ১৯৭১ (টেলিফিল্ম), পৌষ ফাগুনের পালা, চিঠি আসে না। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩), ঘুড্ডি (১৯৮০), নতুন বউ (১৯৮৩), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩), পাতঙ্গ (হিন্দি) (১৯৯৩), সুজন সখী (১৯৯৪), অন্যজীবন (১৯৯৫), সত্যের মৃত্যু নেই (১৯৯৬), বুকের ভেতর আগুন (১৯৯৭), লাল দরজা (১৯৯৭), হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮), কীর্তনখোলা (২০০০), লালসালু (২০০১), আধিয়ার (২০০৩), দুখাই (২০০৪), লালন (২০০৪), দূরত্ব (২০০৬), ঘানি (২০০৬), মনের মানুষ (২০১০), আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১), একই বৃত্তে (২০১১), মাটির পিঞ্জিরা (২০১৩), মৃত্তিকা মায়া (২০১৩) ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র গাড়িওয়ালা (২০১৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
রাইসুল ইসলাম আসাদ একজন অভিনেতার আড়ালে কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা এটা সব মহলেই অজানা ছিল। ‘আসলে এগুলো বলার নয়, বলতে বা জানাতে ভালো লাগে না, কেমন যে আত্মপ্রচার টাইপের মনে হয়’Ñএভাবেই জানালেন নিজের অজানা অধ্যায়। তিনি শাহ আলম কিরণ পরিচালিত বিচার হবে (১৯৯৬) চলচ্চিত্রের কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা। এছাড়া হাফিজউদ্দিন পরিচালিত ঘরণীর (১৯৮২) চিত্রনাট্যকার এবং ‘চুড়িওয়ালা’ ছবিরও চিত্রনাট্যকার। জীবনে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। তিনি পদ্মা নদীর মাঝি, অন্যজীবন, লালসালু, দুখাই, ঘানি ও মৃত্তিকা মায়ার (মনোনীত) জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়া একাধিকবার বাচসাস, আনন্দলোক, প্রযোজক সমিতি পুরস্কার এবং ভারতের সম্মানজনক ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড (এফজেএ)সহ বহু সম্মাননা অর্জন করেন।
সম্ভাবনাময় পরিচালক সম্পর্কে তিনি বলেন, ঠিক এ মুহূর্তে সেভাবে কারও নাম আসছে না, তবে গাজী রাকায়েতকে পৃষ্ঠপোষকতা করলে ভালো করবে। ওর পরিচ্ছন্ন চেষ্টা আর মননশীল চলচ্চিত্রের জন্য কার্যকর। এছাড়া কেউ কেউ চেষ্টা করছেন, তাদের কিছু কিছু দিক ভালোও হচ্ছে। আমাদের দেশের শক্তিমান অভিনেতা সম্পর্কে তিনি বলেন, হুমায়ুন ফরীদি আমার দেখা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শক্তিমান অভিনেতা হতে পারত। কিন্তু নিজেকে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সস্তা গিমিকে পরিণত করার ফলে অনেকটাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। যে নিজেকে কখনোই সস্তা করতে চায়নি তাকেই শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতে হয়েছে নষ্ট চলচ্চিত্রের বিক্রেতাদের কাছে। তবে এটাও সত্য, শিল্পী ফরীদির সমকক্ষও কেউ হতে পারেনি মঞ্চ-নাটক-চলচ্চিত্র যেটাই বলি না কেন।
রাইসুল ইসলাম আসাদ ভারতীয় বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে একাধিক কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এর মধ্যে গৌতম ঘোষ, বাসু চ্যাটার্জি ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অন্যতম। এছাড়া দেশের খান আতাউর রহমান, শেখ নিয়ামত আলী, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য। দেশীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রে এখন মেসেজ ও গল্প নেই। একই বৃত্তে আবর্তনের ফলে সিনেমা হল একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট মানুষরা বেকার হয়ে পড়ছে। দর্শক হলবিমুখ, ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজিবাদী করপোরেট ব্যবসার ধাক্কায় আজ আমরা বেসামাল। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে যোজন যোজন।