ঢাকা : মাসুদ পথিক। একাধারে কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার পরিচালিত সিনেমা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ পাঁচটি বিভাগে ২০১৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। তিনি এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবেও মনোনীত হয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সিনেমার নানা বিষয়ে নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সৈয়দ ঋয়াদ
কবিতা অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করেছেন, বিষয়টি ব্যাখা করবেন?
আমার কাছে কবিতা এবং সিনেমা আলাদা বিষয় নয়। দুটি জিনিসই অভিন্ন। আমি কখনো সিনেমাকে কবিতা থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করি না। আমি যখন আমার পরিচয় কারও কাছে দেই তখন বলি, আমি প্রথমত কবি, দ্বিতীয়ত কবি এবং তৃতীয়ত আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা। নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এই সিনেমাটি কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতাকে অবলম্বন করে বানিয়েছি।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণই কেন বেছে নিয়েছেন?
এই সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৭১। সে সময়ে বাংলার কোনো এক অঞ্চলের এক বর্গাচাষি, যার কোনো চাষাবাদের ভূমি নেই, সে অন্যের ভূমি চাষাবাদ করে। সে চরিত্রটি নেকাব্বর। নেকাব্বর বুঝতে পারে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা সম্পর্ক আছে। দুইয়ের মধ্যে যে মেলবন্ধন বা সাদৃশ্য এটা খুবই প্রাকৃতিক। আর নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ সিনেমায় এই গল্পটিকে কেন্দ্র করেই প্লটটি তৈরি হয়েছে।
বাংলা কবিতার বড় মাপের কবিরা এতে অভিনয় করেছেন...।
আমার সিনেমাটিতে অনেক বিষয়ে অভিনবত্ব আছে। এর মধ্যে একটি হলো আমাদের সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত বড় বা শক্তিমান কবি এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যারা বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা কবিতা সমৃদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কবিদের কেউ কেউ এখানে অভিনয় করেছেন। কেউ এর গীতি কবিতা তৈরি করেছেন। এভাবে আমি তাদের এই সিনেমায় সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করেছি।
আপনার চলচ্চিত্র সর্বাধিক পাঁচটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কারে মনোনীত হয়েছে। আপনিও প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার পাচ্ছেন, কেমন লাগছে?
যেকোনো পুরস্কারই একজন কর্মীকে কাজের উৎসাহ জোগায়। আর সেটি যদি জাতীয় পুরস্কার হয় তাহলে বলব এটি আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। যখন শুনেছি আমি এই পুরস্কারটি পাচ্ছি তখন খুবই ভালো লেগেছে। পরক্ষণে একটু খারাপও লেগেছে এই জন্য যে, এই সিনেমাটি একটি কবিতা থেকে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতা এটি। নির্মলেন্দু গুণ নিজে এর কাহিনিটি আমাকে লিখে দিয়েছেন। তিনি এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন, গানও লিখেছেন। কবি অসীম সাহাও এ সিনেমায় পদাবলী কীর্তন করেছেন। তারাও যদি অন্যান্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেতেন তাহলে আরও বেশি ভালো লাগত। আর একজনের কথা বলব, বুড়ো নেকাব্বরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাদল শহিদ। এই চরিত্রটি করার জন্য অনেক দিন যাবৎ তিনি দাড়ি-গোঁফ কাটেননি। চরিত্রে সাথে মিশে যাওয়ার জন্য মাটি পর্যন্ত খেয়েছেন। তিনি পুরস্কার পেলে ভালো লাগত।
অন্যান্য সিনেমার সঙ্গে নেকাব্বরের পার্থক্য কোথায়?
আমি চেয়েছি একটি সত্যিকারের গল্প দর্শকের কাছে তুলে ধরতে। এর প্রতিটি চরিত্র, দৃশ্য যেন বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায়। এ জন্য আমি একটি টিনের চাল পর্যন্ত দেখাইনি। কারণ আমার গল্প বর্গাচাষিদের নিয়ে। এ ধরনের চাষিরা কুঁড়েঘরে থাকে। বর্গাচাষিদের জীবন যাপনের বাস্তবসম্মত বিষয়গুলোই দৃশ্যায়ন হয়েছে এটিতে। শর্ট ডিভিশনেও আমি বিষয়গুলো মাথায় রেখেছি। সিনেমা দেখতে এসে প্রতিটি শোতেই দর্শকরা এর সঙ্গে মিশে গেছেন। সিনেমার দর্শন দর্শকদের আকৃষ্ট করছে।
আপনি বলেছেন এটি দার্শনিক ছবি, কোন অর্থে?
আপনি দেখবেন আমাদের চাষিদের পড়াশোনা নেই কিন্তু প্রকৃতিকে তারা পড়তে পারে। চাষিরা ঋতুগুলোর অর্থ বোঝে। যার জন্য হয়ত আমাদের অনেক পড়াশোনা করতে হয়। কখন বৃষ্টি হবে, কখন কোন ফসল বুনতে হবে চাষিরা কিন্তু এসব বিষয়ে পড়াশোনা করেননি, তারপরও প্রাকৃতিকভাবে এই জ্ঞান তাদের আছে। তারা অদ্ভুতভাবে এসব জানেন। মানুষ এবং প্রকৃতির যে নিবিড় সম্পর্ক এটি হলো দর্শনের বিষয়।
আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক বিষয় এ সিনেমায় এনেছেন।
হ্যাঁ, আমি এটাতে আঠারোটি প্রাণী ব্যবহার করেছি। সাপ, ব্যাঙের মতো অনেক প্রাণী। দশ-বারোটা রিচুয়াল ব্যবহার করেছি যেগুলো বাঙালি সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কাছি টান, লাঠি খেলা, পদাবলী কীর্তনসহ আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো দেখলে বাংলাদেশকে চেনা যায়। আমরা যদি সিনেমার মতো বড় প্লাটফর্মে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে না পারি তাহলে এর দায় তো আমাদেরই বহন করতে হবে। আমার ভাবনায় ছিল পুরো সিনেমাটি হবে মা, মাটি ও মানুষের। সম্ভবত আমি সে কাজটি করতে পেরেছি।
তারপর?
একটি জোঁক যখন এক পাতা থেকে অন্য পাতায় যায় তখন সে তার সুর দিয়ে একটি ছিদ্র করে তারপর পেছনের পাতা থেকে সুরটা ছেড়ে দেয়। এটা সে করে নিজেকে ব্যালেন্স করার জন্য। আমাদের নতুন কিছু করতে হবে পুরনোকে আঁকড়ে ধরে। এই ধরনের ফিলোসফিক্যাল অনেক সংলাপ আছে এতে। বুড়ো নেকাব্বর লেবু গাছকে নিজের মা মনে করে। কারণ গাছের গোড়ায় তার মায়ের কবর আছে। পুরো সিনেমাটিতে এমন অনেক দার্শনিক উপলব্ধি এবং সংলাপ আছে।
বাংলা সিনেমা নিয়ে আপনার ভাবনা?
আমি একটি কথা বিশ্বাস করি সেটি হলো র-রিয়েলিজম। নন্দন তত্ত্বে একটি কথা আছে, ‘শিল্পের জন্য শিল্প।’ আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি সব কিছু হবে মানুষের জন্য। আমি একটি জীবন দেখাব যেখানে নন্দন তত্ত্বের আড়ালে বা ফ্যান্টাসির আড়ালে সব ঢাকা পড়ে যাবে, এটি আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি মৌলিকতায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
আরও দুটো অনুদানের সিনেমা পেয়েছি। সেগুলোর জন্যই কাজ করছি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তো অনেক কিছু। বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে চাই।