logo ০৫ মে ২০২৫
খালেদা জিয়া কী করবেন
মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)
০২ জানুয়ারি, ২০১৪ ১১:৩৭:০৭
image


ঢাকা: জামায়াতে ইসলামীর ওপর নির্ভর করতে গিয়েই মস্তবড় ভুলটি করলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি দেশের সাধারণ মানুষ ও মুক্ত চিন্তার মানুষের আস্থা পায়নি। আর সেই দলকে মূল সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মূলত সব পক্ষের মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি নিয়েছেন। এখন কী করবেন খালেদা জিয়া?

১৮ দলীয় ঐক্যজোটের মূল শক্তি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই দুটি দলের ভাবগত আদর্শ তথা ইসলামভিত্তিক চিন্তা-চেতনা ও রাজনৈতিক আদর্শ কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তারা দুটি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক দল। বিএনপি স্বাধীনতার পক্ষের এবং স্বাধীনতার ঘোষকের গঠিত দল। এই দল দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী ও আওয়ামী লীগ তথা ধর্মহীন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের বিপরীত রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির মূল ¯্রােত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের দল। যদিও একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়ের পরে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় চেতনা আদর্শের ধারক ও বাহক হতে গিয়ে এই দলের পতাকাতলে সব ধর্মবিশ্বাসী মানুষ এমনকি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বাংলাদেশী জনগণের অংশটিকেও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে স্থান দিতে হয়েছে।

পক্ষান্তরে জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী ও কট্টর ইসলামী আদর্শ মূল্যবোধ বাস্তবায়নের নামে দেশে সহিংস রাজনীতির ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জামায়াত একে তো বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী, অন্যদিকে কট্টর ইসলামী ভাব চেতনা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে এসে দেশে অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিএনপি যদিও শুরু থেকেই তার সংগঠক জিয়াউর রহমান জামায়াতকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। কিন্তু তিনি সেই সঙ্গে তাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে তাদের অবস্থান  পুনর্মূল্যায়ন, ধর্মীয় কট্টরতার ও সন্ত্রাসমূলক রাজনীতি থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। যার ফলে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জামায়াতের কাউকে তার দলে নেননি। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য গড়েননি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম তাদের রাজনীতির শুরুতেই আমার মতে চারটি ভুলের ওপর তাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করে। তারা প্রথমেই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার পথ বেছে নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘ভোট দিলে দাঁড়িপাল্লায় খুশি হবেন আল্লায়’Ñ এ ধরনের একটি অত্যন্ত গর্হিত স্লোগান দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। জামায়াত কর্মীদের ইসলামিক লেবাস, আচার-আচরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, দৈনন্দিন কর্মকা- ও সামাজিকভাবে তাদের সৎ ও শিক্ষিত পরিচিতি জনগণের একটি অংশ তাদের অবচেতন মনে বিশ্বাস করে নেয় যে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে সত্যিই আল্লাহ খুশি হবেন। প্রাথমিকভাবে এই স্লোগান তাদের রাজনৈতিক সুবিধা করে দিলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের জন্য এই স্লোগানই বিপদ ডেকে এনেছে।  

দ্বিতীয় যে ভুলটি তারা করেছে সেটি হলো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশ। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের রাজনৈতিক ক্যাডার সৃষ্টি করার সময় তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তাদের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে। রগ কাটার কারণে অনেকেই যেমন ভীত হয়ে তাদের দলে যোগদান করে, তেমনি এই একটি মাত্র কারণে সাধারণ ছাত্র যুবসমাজের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটি বিশাল জনমত তৈরি হয়। জামায়াত তথা শিবিরের রগ কাটা কর্মসূচির কারণে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার জন্য বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- গড়ে উঠতে পারছে না। বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দল হয়েও শুধু জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে জনগণের আস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

তৃতীয় যে ভুলটি জামায়াতের ক্ষতি ডেকে এনেছে সেটি হলো তারা মুখে এবং আচার-আচরণে দুর্নীতির কথা বললেও তাদের সব রাজনৈতিক আর্থিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা মুখে সৎ মানুষের শাসনের কথা বললেও রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন অসাধু, কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অর্থপাচার ও অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপুল আর্থিক শক্তির অধিকারী হয়ে রাজনীতিকে কেনাবেচার হাটে পরিণত করেছে। তারা দলীয় আদর্শে এবং সৎ রাজনৈতিক ভাবাদর্শের নেতা-কর্মী না বানিয়ে ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেছে। যাদের সব কাজের জন্য অর্থ মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন কোচিং ও ব্যক্তিগত শিক্ষা ও যোগ্যতা সৃষ্টি করে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরিতে সুপরিকল্পিতভাবে প্রবেশ করিয়ে তাদের কর্মস্থলের অন্য চাকরিজীবীদের অবিশ্বাস, অনাস্থা ও ভয় সৃষ্টি করেছে। যার ফলে প্রতিটি স্তরে তাদের ঘোরতর প্রতিযোগী সৃষ্টি হয়েছে।

চতুর্থত, তথা যে মহা ভুলটি তারা গত ৪০ বছর ধরে করে আসছে সেটি হলো ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণভাবে অসম্মান। গত ৪০ বছরে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান বা মূল্যায়ন করেছে এবং কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের রাজনৈতিক দলে স্থান দিয়েছে এর কোনো বাহ্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে সে বাংলাদেশের জন্মকে তারা এখনো স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নিয়ে তাদের কোনো ধরনের অপরাধবোধ বা মানসিক পরাজয়ের লক্ষণও কোনো কর্মকা-ে কখনো দেখা যায়নি। ’৭১-এ গণহত্যা, ঘাতক ও দালাল হিসেবে তাদের সম্পৃক্ততা সর্বোপরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করার ব্যাপারে তাদের কুণ্ঠিত হওয়া বা জাতির সামনে এখন পর্যন্ত তাদের সেই ঘৃণিত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা বরং উল্টো তাদের সেই ঘৃণিত অবস্থান সঠিক বলে দম্ভোক্তি করে আসছে। তাদের এই অবস্থান দেশের তরুণ সমাজকে আহত করেছে, তরুণ সমাজের মধ্যে তাদের প্রতি চরম ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে, তরুণ সমাজ তাদের বিরুদ্ধে আজকে সোচ্চার এবং তাদের সেই ঘৃণিত অপরাধের শাস্তির জন্য রাজপথে নেমে এসেছে। তরুণ সমাজের চেতনাকে জামায়াত শুধু অবজ্ঞাই করেনি বরং বিভিন্ন সময়ে এই তরুণ সমাজকে ধ্বংস করার হুমকি-ধমকি দিয়ে বাংলাদেশে একটি সন্ত্রাসী পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে।



যার ফলে আজকে সারা বাংলাদেশের তরুণ সমাজ গোটা জামায়াতের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছে এবং জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য এক নতুন মুক্তিযুদ্ধে নেমেছে। যার ফলে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে জামায়াতকে শুধু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সম্মুখীনই হতে হয়নি, বিচারে তাদের ফাঁসি এবং সেই ফাঁসিও একে একে কার্যকর হতে চলছে। শুধু জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে এই নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ থেমে থাকেনি বরং পুরো জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করে দিয়েছে। যেই জামায়াত ৪০ বছর ধরে এ দেশের উদার জনগোষ্ঠীর, যেখানে জামায়াতকে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করে তাদের উত্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল। আজকে সেই জনগোষ্ঠীর তাদের বর্তমান দম্ভোক্তি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অর্থনৈতিক অনৈতিকতা, অবৈধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত ও সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে তাদের প্রকাশ্যে অবস্থানের কারণে জামায়াতকে আজকে রাজনৈতিক আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছে। আগামীতে জামায়াতে ইসলামের নামে রাজনীতি করা যাবে কি না সেটিও জনগণের সামনে একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

২০০১ সালের নির্বাচনে জোট বাঁধতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামকে বিএনপির আদর্শ ও অবস্থান এবং স্বাধীনতার ঘোষকের গঠিত দলের চরিত্রের সঙ্গে আপস করে জামায়াতে ইসলামকে নিয়ে নির্বাচনী জোট বাঁধা বিএনপির জন্য এক চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছর জামায়াতকে নিয়ে দোর্দ- প্রতাপে ক্ষমতায় থেকেও ২০০৬ সালের অক্টোবরে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। ক্ষমতা ছেড়েও তৎকালীন চারদলীয় ঐক্যজোট রেহাই পায়নি তাদের ১/১১ এর বিরূপ এবং বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে হয়। ১/১১-এর সেনাসমর্থিত সরকারের সব নির্যাতন, কারাবরণ ও সব নিষ্পেষণের সময়ে যে জামায়াত একটি কথাও বলেনি সেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পরও তাদের বোধোদয় হয়নি। বিএনপি যেখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে চরমভাবে হেরে গিয়ে গত পাঁচ বছরে নিজের দলকে ২০১৩-১৪ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি না নিয়ে জামায়াতকে নিয়ে জামায়াতের স্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলনে নিজেকে ব্যস্ত রেখে আজকে অত্যন্ত অপ্রস্তুতভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আজকে চরম দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য জামায়াত ছাড়া বিএনপি ঢাকা শহরের কোনো রাস্তায় একটি ক্ষুদ্র মিছিল করতেও ব্যর্থ। ঢাকা শহরে বিএনপির আন্দোলনের অবস্থান দেখলে মনে হয় জামায়াত ছাড়া বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনে যাওয়া তো দূরের কথা তার নিজ অফিস বা বাসায় থাকাও কঠিন। অথচ এমনটি তো বিএনপির হওয়ার কথা ছিল না। বিএনপি সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায়ও এমন একটি পাড়া বা মহল্লা নেই, যেখানে বিএনপির একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। অথচ এই বিএনপি জামায়াতের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ছত্রছায়া ছাড়া নিজ শক্তিতে একটি মিছিল করারও ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থার জন্য মূলত দায়ী জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির অনৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শহীন জোট বাঁধা বা জামায়াতের স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া।

 জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির রাজনীতি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অতীতে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে খেলে জামায়াতকে বিএনপির বিরুদ্ধে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। ২০০৮-এর পরে অত্যন্ত সুকৌশলে এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে জামায়াতকে বিএনপির ঘরে ঠেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ছোট বড় সব সারির নেতারা যুদ্ধাপরাধী জামায়াতী নেতাদের বাঁচানোর জন্য বিএনপি বিভিন্ন আন্দোলন করছে বলে প্রতিদিন গলাবাজি করছে। সেখানে বিএনপি একদিকে জামায়াতকে সঙ্গে রাখছে, অন্যদিকে অত্যন্ত বোকার মতো বলে বেড়াচ্ছে বিএনপিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে সে বিচার হতে হবে সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন। বিএনপির এ বক্তব্য কী অর্থ দাঁড়ায় তা আমার মনে হয় বিএনপির কোনো নেতা-নেত্রী পরিষ্কারভাবে বলতে পারবে না। আমি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলতে চাই ভুল করে হোক বা কোনো বাধ্যকতার কারণে হোক জামায়াতের সঙ্গে যখন বিএনপি জোট বেঁধেছে তখন জামায়াতের সব দায় দায়িত্ব বড় দল হিসেবে অবশ্যই বিএনপিকে নিতে হবে। জামায়াতের কোনো অপরাধেরই বিচার নীতিগত ও নৈতিকতাতেই চাইতে পারে না। ১৮ দলীয় ঐক্যজোটে জামায়াতকে শরিক করার সঙ্গে সঙ্গেই জামায়াতের অতীতের সব কার্যক্রমকে অবশ্যই ১৮ দলীয় সব নেতা-নেত্রীরা মেনে নিয়েছেন এবং মেনে নিয়েছেন বলেই তারা জোট বেঁধেছেন। যদি প্রথম থেকেই বিএনপি এই পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করত তাহলে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি করার মতো সুযোগ এবং সাহস কোনোটাই বর্তমান সরকার পেত না। আজকের দিনের চরম বাস্তবতা হলো বর্তমান এই রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ হলো বিএনপির স্ববিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান। বিএনপি এক দিক দিয়ে আন্দোলন করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে। কিন্তু সরকার সেই দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তাদের রায় কার্যকর করার সময় সরকারের ক্ষমতা ত্যাগের শেষ মাথায় নিয়ে এসেছে। অথচ বিএনপি এই বিচারের বাস্তব অবস্থা এবং রাজনীতি তথা নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তনে কী প্রতিক্রিয়া রাখবে তা অনুধাবন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গুরুত্ব না দিয়ে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রায় সম্পন্ন করে সরকারের ক্ষমতা শেষ প্রান্তে এসে রায় কার্যকর করার দিনক্ষণ নিয়ে আসছে। সেখানে যেই শক্তি বা চাপের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সরকার বাধ্য হচ্ছে তারা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর না করা পর্যন্ত সরকারকে টিকিয়ে রাখার বা পুনর্নির্বাচিত করার মতো পরিবেশ ও জনমত সৃষ্টি করবে সেটা বুঝতে কোনো সচেতন রাজনীতিবিদের সময় লাগার কথা নয়।



আজকে আওয়ামী লীগ সারা জাতিকে অত্যন্ত সফলভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে মূল সমস্যা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের রায় কার্যকর করা সমগ্র জাতিরই সর্বাগ্রে রাজনৈতিক ইস্যু। কাজেই এ মুহূর্তে যেভাবেই হোক বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বা দলগতভাবে আমার দল কী ভাবল তার চেয়ে বেশি বিবেচ্য দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাবনা। সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার পরও বর্তমান সরকারের নির্বাচনী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জনগণ এখনো তেমনভাবে রাস্তায় নেমে আসেনি। একদিক দিয়ে জনগণ ভোটের প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে অন্যদিক দিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনকে ঠেকানোর জন্য জনগণের সে রকম তীব্র প্রতিবাদও দৃশ্যমান হচ্ছে না। মানুষ যেন দুই দলের নেত্রীর প্রতিই তাদের চরম অনাস্থা প্রকাশ করে নির্বাচনের পক্ষেও নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে না, আবার নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য শক্তভাবে মাঠে নেমে আসছে না। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থাটি যেন মানুষ নেতিবাচকভাবে মেনে নিয়েও একটি আগামী ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। জনগণ হয়তো নতুন রাজনীতি ও নতুন নেতৃত্বের জন্য কেন জানি না আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। তাই আমার মনে হয়, মানুষ বর্তমান দুই নেত্রীসহ প্রায় সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি চরম মানসিক অনাস্থা ও ঘৃণা মনে মনে পোষছে এবং আগামী দিনের একটি নেতৃত্বের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

বিএনপিকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং এর জন্য আমার মনে হয় অনতিবিলম্বে তাকে নি¤œলিখিত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করতে হবে।

১.    বিএনপিকে অবশ্যই বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং নিজেকে নিজে থেকেই পরাজিত ঘোষণা করে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ও কল্যাণে বর্তমান চলমান আন্দোলন থামিয়ে দিতে হবে।

২.    জামায়াতে ইসলামকে নিয়ে প্রকাশ্যে নতুন করে জোট তৈরি করে প্রয়োজনে তাদের সবাইকে দলে নিয়ে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-উত্তর বাংলাদেশে ইসলামভিত্তিক রাজনীতি দল বা রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করতে হবে।

৩.    দেশের সব ইসলামিক আদর্শে বিশ্বাসী দল ও জনগণকে নিয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট বা মঞ্চ তৈরি করতে হবে।

৪.    অন্তত দুই বছরব্যাপী একটি ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে একদম তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন নেতানেত্রী বিশেষ করে দুর্নীতিমুক্ত, সাহসী ও ত্যাগী আদর্শবান, শিক্ষিত, তরুণ, যুবক ও মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষের নেতৃত্বে বিএনপিকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সকল পর্যায়ের নেতৃত্ব সরকারি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে। এমনকি শীর্ষ নেতৃত্ব গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে হবে।

৫.    বাংলাদেশে উন্নয়ন, জনগণের কল্যাণ, অর্থনৈতিক মুক্তি, যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা, বেকারত্ব দূর করে ১০০% কর্মসংস্থান, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ, ধর্মভিত্তিক আদর্শ ও চারিত্রিক উন্নয়ন এবং বাংলাদেশী মূল্যবোধের সৃষ্টি করে দেশকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে তৈরি করতে হবে।

৬.    যেকোনো অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা, নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র উপায়ের পরিবেশ জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

৭.    সব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, সন্ত্রাসী রাজনীতি দূর করে সৎ, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সব প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে একটি নীতিবান সমাজ ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

দেশ আমার, আপনার ও সবার। এ দেশ কোনো নেতা-নেত্রীর কাছে জিম্মি করা হয়নি। নেত্রীরা যেমন চান জনগণ তাদের ডাকে তাদের কাছে এসে দাঁড়াবে তেমন জনগণেরও তাদের নেতা-নেত্রীদের পছন্দ করার সুযোগও থাকতে হবে। দলে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে গণতন্ত্র আসার সুযোগ নেইÑ গত ২০ বছরের গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ সত্যটি চরমভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো দল ক্ষমতায় গেল সেটি দেখার আগে সেই দল জনগণের পছন্দ কি না এবং সেই দলের নেতা-নেত্রীরাও জনগণের অনুমোদিত কি না, সেটিও পরিষ্কার করা দরকার। একজন ক্ষমতায় বসে তিনি তার চারপাশের তাদের চাকরবাকর তোষামোদকারীদের দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে গণতন্ত্রের বুলি আওড়াবেন আর সরকারে গণতন্ত্র আনার জন্য নিরীহ, নিরপরাধ, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ আগুনে দগ্ধ হয়ে চরম কষ্টে মৃত্যুবরণ করবেন এটি মেনে নেওয়া যায় না। মনে হয় সময় আসছে শুধু একজনকে হুকুমের আসামি নয়, হয়তো আগামী দিনে অনেককেই হুকুমের আসামি করে এই আগুনে দগ্ধ মানুষ হত্যার বিচার এ দেশের জনগণ চাইবে। আমরা সেদিনের অপেক্ষায়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

(ঢাকাটাইমস/ ০২ জানুয়ারি/ এআর/ ঘ.)