logo ০৫ মে ২০২৫
এরশাদের বিরুদ্ধে রংপুরবাসীর প্রতারণার অভিযোগ

রফিকুল ইসলাম রফিক
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ ২১:০৭:২৩
image


রংপুর: যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে ততই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে রংপুরবাসীর ভালোবাসা দিন দিন কমে যাচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়ছেন এরশাদভক্তরা। আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সর্বদলীয় সরকারে রংপুর বিভাগের ৩৮ ডাকসাইটেড নেতার বাদ পড়ে যাওয়ায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব, হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও এরশাদভক্তদের মধ্যে। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ স্বয়ং এরশাদ। তিনি একাধিক জনসভা, পথসভায় বলেছেন রংপুরে তার বা জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কমে যায়নি।

জানা গেছে, বর্তমান সর্বদলীয় সরকারের জাতীয় পার্টির ১০ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য, ৪ জন উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, ৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৩ জন যুগ্ম মহাসচিব, ৪ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ২ জন নির্বাহী কমিটির সম্পাদকম-লীর সদস্য, ১ জন যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক, ৯ জন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যই রংপুর বিভাগের আট জেলার ডাকসাইটেড নেতা। এর মধ্যে অন্তত দুই ডজন ব্যক্তি আছেন যারা এরশাদ মুক্তি আন্দোলনসহ খোদ পার্টি চেয়ারম্যানের দুর্দিনের কা-ারি হিসেবে পরিচিত, বর্তমান ও সাবেক এমপি এবং মন্ত্রী। কিন্তু তাদের কেউই সর্বদলীয় সরকারে সুযোগ পাওয়া মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে নেই। এ ঘটনাকে ক্ষমতায় গেলে রংপুর অঞ্চলের মানুষের ‘ভালোবাসা ও ঋণ’ পরিশোধের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এরশাদ, তা কতটুকু পূরণ হবে তাই নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে। সবার মুখে মুখে রয়েছে তার ডিকবাজির বিষয়টিও।

রংপুরবাসী বলছেন, রওশন এরশাদ রংপুর থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও তিনি পার্টির ময়মনসিংহের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যদিও ময়মনসিংহ থেকে তিনি কখনই এমপি নির্বাচিত হননি। এটা প্রতারণা ছাড়া আর কি হতে পারে।

জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে রংপুরের সাবেক এমপি করিম উদ্দিন ভরসা ও মসিউর রহমান রাঙ্গা, কুড়িগ্রামের একেএম মাইদুল ইসলাম এমপি (সাবেক মন্ত্রী), সাবেক এমপি তাজুল ইসলাম চৌধুরী (সাবেক মন্ত্রী), কুড়িগ্রামের সাবেক এমপি গোলাম হাবিব দুলাল, কুড়িগ্রামের নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, গাইবান্ধার ড. টিআইএম ফজলে রাব্বী চৌধুরী এমপি (সাবেক মন্ত্রী), লালমনিরহাটের মজিবর রহমান এমপি, ঠাকুরগাঁওয়ের হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এমপি, গাইবান্ধার হাবিবুর রহমান; ১৬ সদস্যের উপদেষ্টাম-লীর মধ্যে এরশাদের ছোট ভাই সাবেক এমপি মোজাম্মেল হোসেন লালু, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কুড়িগ্রামের বাদল খন্দকার, গাইবান্ধার হাবিবুর রহমান, এরশাদের ছোট বোন সাবেক এমপি মেরিনা রহমান; ৪১ সদস্যের ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কুড়িগ্রামের একেএম মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, গাইবান্ধার সাবেক এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ সরকার, দিনাজপুরের ড. আনোয়ার চৌধুরী জীবন, দেলওয়ার হোসেন, পঞ্চগড়ের কামিজ উদ্দিন প্রধান; ১৭ সদস্যের যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে গাইবান্ধার সাবেক এমপি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াহেদুজ্জামান বাদশা, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, রংপুরের শিল্পপতি ফখর-উজ জামান জাহাঙ্গীর; ৩১ সদস্যের সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে দুর্দিনের ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত রংপুরের সৈয়দ নূর আহমেদ টুলু, সাবেক মেয়র একেএম আবদুর রউফ মানিক, গাইবান্ধার কর্নেল (অব) কাদের গনি খান এমপি, নীলফামারীর এইচএন শফিকুর রহমান; এছাড়াও ২৩ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সম্পাদকম-লীর মধ্যে দফতর সম্পাদক কুড়িগ্রামের তাজুল ইসলাম চৌধুরী, কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ঠাকুরগাঁওয়ের সুলতানুল ফেরদৌস নম্র; ২৯ সদস্যের যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে কুড়িগ্রামের আবু তাহের খায়রুল হক এটি এবং ৯১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্যের মধ্যে রংপুরের অ্যাডভোকেট সালাহউদ্দিন কাদেরী, নীলফামারীর জাফর ইকবাল সিদ্দিকী এমপি, শওকত আলী চৌধুরী, গাইবান্ধার অ্যাডভোকেট এইচএন গোলাম শহীদ রঞ্জু, মেজবাউল ইসলাম লাবলু, আরাফাত আখতার নীলা, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, কুড়িগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার আনিছুর রহমান রতন রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ৩৮ জনই জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী ও কেন্দ্রীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাউকেই এরশাদ সর্বদলীয় মন্ত্রী সভায় স্থান দেননি। অথচ রংপুর অঞ্চলই বাঁচিয়ে রেখেছে রাজনীতির মাঠে এরশাদকে। ৯১ সালে এরশাদের বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রংপুর অঞ্চল থেকেই ২২ আসনের মধ্যে ২১টি আসন উপহার দিয়েছিল এই অঞ্চলের জনগণ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে গিয়েও ১১টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। রংপুর অঞ্চলের মানুষের এরশাদের প্রতি এই অগাধ ভালোবাসা ও টানের বিষয়টিও এরশাদ বারবার স্বীকার করেছেন। সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, সাংবাদিক সম্মেলন, সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি রংপুরের মানুষের কাছে ‘ঋণী’ থাকার বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। ‘ঋণের’ কথা বলে কেঁদেছেন। রংপুরের মানুষকেও কাঁদিয়েছেন। বারবার ঘোষণা দিয়েছেন একটু ক্ষমতায় যেতে পারলেই রংপুরের মানুষের ‘ঋণ’ শোধ করবেন। কিন্তু সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী সভায় নতুন করে ৬ জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা দেয়ার সুযোগ হলেও রংপুর অঞ্চল থেকে ১ জনও সেই তালিকায় স্থান পায়নি। ফলে এই অঞ্চলের নেতাকর্মী এবং এরশাদভক্তরা রংপুরের মানুষের ‘ঋণ’ পরিশোধের জন্য এরশাদের কান্না ও প্রতিশ্রুতিকেও ডিগবাজি, প্রতারণা ও অভিনয় বলেই ভাবছেন। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এরশাদের ওপর বিশ্বাস আর ভালোবাসায় ঘুণ ধরেছে।

এদিকে এরশাদ জন্মভূমি রংপুরে জাতীয় পার্টিতে নানা নাটকীয়তা শুরু হয়েছে। আগ থেকেই রংপুর জাপায় নীরব দ্বন্দ্ব থাকলেও গেল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তা প্রকাশ্য রূপ নেয়। মনোনয়ন নেয়া না নেয়া আর পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ভেঙে যায় জাতীয় পার্টি। গঠন করা হয় তৃণমূল জাপা। যদিও সেটি মসিউর রহমান রাঙ্গার মনোনয়ন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। এরপর এরশাদ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, সাবেক রংপুর পৌরসভার মেয়র একেএম আবদুর রউফ মানিক এবং জেলা যুব সংহতির সভাপতি এসএম ইয়াসিরকে বহিষ্কার করেন। এরপর মসিউর রহমান রাঙ্গাকে জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।

জানা গেছে, এর ৬ মাস যেতে না যেতে রংপুরের জাতীয় পার্টিতে ফের নাটক শুরু হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদকে আটক করা হয়েছে এমন খবরে রংপুরে জোরতালে আন্দোলন না হওয়ায় এরশাদ চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে বহিষ্কৃত নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, মানিক এবং ইয়াসিরকে ফের দায়িত্ব দেন। রাঙ্গার কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় বহু বছর পর জাপার দু’গ্রুপে তুমুল সংঘর্ষ হয়। দু’গ্রুপ এখন প্রকাশ্যে মাঠে রয়েছেন। এ ঘটনায় রংপুরে আগামীতে জাতীয় পার্টি কোথায় অবস্থান করবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছেন এরশাদভক্তরা।

ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম প্রশ্ন রাখেন, এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারি না। তিনি রংপুরের একজন নেতাকেও মন্ত্রীর জন্য সিলেক্ট করতে পারলেন না। ভালোবাসায় বুঝি প্রতারণা এভাবেই করতে হয়।

রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির নয়া কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে জানান, আমি এরশাদের দল করি। তাকে ভালোবাসি, তাকে সম্মান করি। তার যে কোনা সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেই।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, এরশাদ আমার নেতা। তার যে কোনো সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।

এদিকে এরশাদের ডিগবাজি আর রংপুরের জাতীয় পার্টি নিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, রংপুরের মানুষের বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে পুঁঁজি করে এরশাদ যে রাজনীতির ব্যবসা করছিলেন, তার এই কর্মকা-ের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি একজন প্রতারক রাজনীতিবিদ। আর এই প্রতারণা করেছেন রংপুরের মানুষের সাথে। তার এ বিবেকবর্জিত কাজ ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকদের তালিকায় লেখা থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/৩০ ডিসেম্বর/ প্রতিনিধি/জেডএ.)