logo ০৫ মে ২০২৫
বিএ সার্টিফিকেটের খবর নেই এমবিএ পড়ছেন হাওলাদার

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ ২১:০২:২৪
image


ঢাকা: এই যুগে এমবিএ (মাস্টার্স ইন বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন) থাকলে চাকির বাজারে পাওয়া যায় বেশ সুবিধা। তাই অন্য বিষয়ে পড়াশোনা শেষে, এমনকি বেসরকারি চাকুরেরা তাদের চাকরির পাশাপাশি করে নিচ্ছেন ডিগ্রিটি।

এই ডিগ্রির প্রতি হঠাৎ আগ্রহী হয়েছেন জাতীয় পার্টিও মহাসচিব এমবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারও। নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় এমবিএ পড়ছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। অবশ্য এমবিএ পড়ার জন্য স্নাতক ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এই রাজনীতিবিদ এর আগে কখনও তার সেই যোগ্যতার প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বারবার নোটিশ করা হলেও এই শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ তিনি জমা দিতে পারেননি নির্বাচন কমিশনেও।

নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের আটটি তথ্য সংবলিত হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এই তথ্যগুলো প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এই হলফনামা এবং ২০০৮ সালে জমা দেয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে এই বিষয়টি দেখা গেছে।

হলফনামা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠেছে পাঁচ বছরে। হলফনামায় অবশ্য আয়ের উৎস দেখাতে হয় না কাউকে। তাই কীভাবে এই সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে আছেন রুহুল আমিন হাওলাদার এবং তার স্ত্রী রতœা হাওলাদারও।

গত পাঁচ বছওে জাতীয় পার্টিও মহাসচিবের সম্পদ বেড়েছে আটগুণ আর স্ত্রীর সাতগুণ। এসব বিষয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই সময়কে বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কোনো দৃশ্যমান কারণ নেই। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। যাদের সম্পদ ছিল লাখের ঘরে, তা কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কারো হলফনামায় অসঙ্গতি থাকলে নির্বাচন কমিশনও ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া যদি কেউ তথ্য গোপন কিংবা মিথ্যা তথ্য দেন তাহলে তার প্রার্থিতাও বাতিল করা বিধান রয়েছে।

রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে প্রশ্ন আছে দলের ভেতরেও। তবে এরশাদের আস্থাভাজন হওয়ায় কেউ প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। তবে দলের ভেতর হাওলাদারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে, এমনটিও দাবি করেন না কেউ। দলের অবস্থান নিয়ে একেক নেতা একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেনÑ এটা গত কয়েক মাস ধরে এক সাধারণ চিত্র। জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া এবং না যাওয়ার বিষয় নিয়ে দলের নেতাদের বক্তব্য নিয়ে রীতিমতো হাস্যরস তৈরি হচ্ছে। একদিন সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদের কথা বলেই নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছেন এক নেতা, তো পরদিন আবার সংবাদ সম্মেলন করে ওই এরশাদের কথা বলেই নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছেন আরেক নেতা। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে নাইÑ এমন কথা যেমন বলা হচ্ছে, তেমনি দলের ৮৮ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছেন-এমন বক্তব্যও আসছে।

রাজনীতিবিদ হিসেবেও রুহুল আমিন হাওলাদারের উত্থানটাও বিস্ময়করই বটে। এরশাদ আমলে হঠাৎ করেই তিনি আলোচনায় আসেন। হয়ে যান বস্ত্রমন্ত্রীও। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রজ্ঞা এবং মেধার পরিচয় না দিলেও হঠাৎ করেই তাকে মহাসচিব নিয়োগ করেন এরশাদ।

এরশাদ আমলে এই নেতার বিরুদ্ধে ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির নানা অভিযোগ। ১৯৯০ সালে মন্ত্রী থাকাকালে টেক্সটাইল মিলের ঠিকাদার নিয়োগে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। পরে অবশ্য সে মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি।

এরশাদ আমলে বস্ত্রমন্ত্রী থাকাকালে অবৈধ উপায়ে ১২১ জনকে নিয়োগ ও ৭৫৮ জনকে সরাসরি নিয়োগের অভিযোগেও মামলা হয় হাওলাদারের বিরুদ্ধে।

সম্পদের উল্লম্ফন:



গত পাঁচ বছরে নিজের সম্পদ বেড়েছে প্রায় আটগুণ। আয় বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি। সঙ্গে ৩০ কাঠার একটি প্লটের মালিক হয়েছেন। অন্যদিকে স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে সাতগুণের বেশি। সঙ্গে পূর্বাচলে মিলেছে সাড়ে সাত কাঠার প্লট।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের সম্পদ ছিল দুই কোটি ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪৫ টাকার। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৮৫ লাখ ১২ হাজার ৩৭ টাকা।

২০০৮ সালে স্ত্রী নাসরিন জাহানের সম্পদ ছিল ৩৬ লাখ ২৭ হাজার ৮৩৫ টাকার। ২০১৩ সালে তা হয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ৮৪৭ টাকা।

২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদার বছরে বাড়ি ভাড়া থেকে আয় করতেন ১৩ লাখ আট হাজার ৯৩৮ টাকা। ২০১৩ সালে তা সাড়ে ১২ গুণ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।

২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের হাতে নগদ টাকা ছিল ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৮ টাকা। ২০১৩ সালে তা হয়েছে ছয় কোটি ৬৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৯০ টাকা।

২০০৮ সালে স্ত্রীর নগদ টাকা ছিল ১৬ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৮ টাকা। তবে ২০১৩ সালে তা কমে ১১ লাখ ৪২ হাজার ৬৫০ টাকা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কোনো বন্ড বা শেয়ারের মালিক ছিলেন না রুহুল আমিন দম্পতি। তবে এখন তিনি সাত কোটি টাকার বন্ড বা শেয়ারের মালিক। স্ত্রীর আছে দেড় কোটি টাকারও বেশি বন্ড বা শেয়ার।

পাঁচ বছর আগে নিজেদের কোনো গাড়ি ছিল না রুহুল আমিন দম্পতির। কিন্তু এখন দু’জনের দুটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িও আছে। রুহুল আমিনের গাড়ির দাম ৬৭ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ টাকা। স্ত্রীর গাড়িটির দাম ৫৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩০ টাকা।

পাঁচ বছরে স্থাবর সম্পদও বেড়েছে এই দম্পতির। ২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের নামে কৃষি জমি দেখানো হয়েছিল ৩০ কাঠা। ২০১৩ সালে কৃষি জমি হয়েছে ১৩২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পৈত্রিক সূত্রে ৩০ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন তিনি। তার নামে গুলশানের ১২ দশমিক সাত কাঠার প্লটটি আগেও ছিল। স্ত্রী নাসরিন জাহানের অতীতে কোনো প্লট না থাকলেও এবার পূর্বাচলে পেয়েছেন সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট। তবে এসব আয়ের বিস্তারিত তথ্য হলফনামায় দেয়া হয়নি। ফলে গাড়ি কেনার টাকা কোত্থেকে পেয়েছেন, শেয়ারের টাকাই বা কোথায় পেলেন তিনি, সে প্রশ্নেরও জবাব নেই হলফনামায়। আর এসব জানতে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া না দেয়ায় ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি।

হাওলাদারের শিক্ষাগত যোগ্যতা আসলে কী?

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি এখনও কাটেনি। ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে দুই রকম তথ্য দিয়েছেন তিনি নিজে।

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় রুহুল আমিন হাওলাদার তার শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখেছিলেন-বিএ (সম্মান) লোক প্রশাসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তিনি তখন সনদ দিতে পারেননি। জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইটে দেয়া রুহুল আমিন হাওলাদারের জীবনবৃত্তান্তে তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখেছেন বিএ (সম্মান)।

পাঁচ বছর পর নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় রুহুল আমিন হাওলাদার এবার বলেছেন তিনি এমবিএ অধ্যয়নরত। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে সনদ থাকলেই কেবল তা উল্লেখের নিয়ম আছে।

২০০৮ সালে বাছাইকালে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। রুহুল আমিনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল হাফিজ মল্লিক অভিযোগ করেছিলেন, হলফনামায় উল্লিখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা তার নেই। নির্বাচন কমিশন এ অভিযোগের ওপর শুনানি গ্রহণ করে। শুনানিতে অংশ নিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার নির্বাচন কমিশনকে বলেছিন, তার সনদ হারিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নকল কপি তুলে দ্রুত তিনি তা জমা দেবেন। কিন্তু তারপর একাধিকবার সময় বেঁধে দিলেও জাপা মহাসচিব জমা দেননি কথিত সেই সনদ। তবে সনদ নিয়ে এবার আর যেই পথে পা বাড়াননি জাতীয় পার্টির নেতা। সেবার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ হারিয়ে গেছে বলে পার পেয়েছিলেন তিনি। এবারও শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য নিয়ে কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। লিখেছেন তিনি এমবিএ অধ্যয়নরত। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরের নিচে লেখা আছে ‘উত্তীর্ণ পরীক্ষার নাম’ উল্লেখ করতে হবে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে হলফনামায় রুহুল আমিন হাওলাদার নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা এদিকে গত ৩০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের জারি করা একটি পরিপত্রে মনোনয়নপত্রে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ আট ধরনের তথ্য দেয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে, মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে দুদকের যত মামলা

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে (দুদক) তিনটি মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া দুদক আইনে করা দুটি মামলা থেকেও পার পেয়েছেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুর্নীতি দমন আইনের ৫(২) ধারায় ৪০৯/১০৯ দ-বিধিতে যশোর জেলা জজ আদালতে একটি মামলা রয়েছে। বিশেষ এ মামলার নম্বর ১৭/১৯৯৪। একই ধারায় ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এগুলোর নম্বর ৭/১৯৯২ এবং ৮/১৯৯২।

এসব মামলার অভিযোগ কী, মামলা কোন পর্যায়ে আছে- সে নিয়েও বিস্তারিত কোনো তথ্য হলফনামায় দেননি রুহুল আমিন হাওলাদার।



(ঢাকাটাইমস/৩০ ডিসেম্বর/এইচএফ/জেডএ.)