ঢাকা: ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েই লড়তে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু জামায়াতের ১০০ আসন দাবির কারণে শেষ পর্যন্ত এই জোট হয়নি। পরে আসনভিত্তিক অঘোষিত সমঝোতা হয় দল দুটির মধ্যে। বেশ কিছু আসনে জামায়াতকে সহযোগিতার বিপরীতে জামায়াতের ভোট আছে, এমন আসনগুলোতে জামায়াতের সমর্থন নিশ্চিত করে বিএনপি।
এই গোপন সমঝোতার ফল পেয়েছিল দুটি দলই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে সবাইক অবাক করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে বিএনপি। ১৮টি আসনের পাশাপাশি ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে তাক লাগিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হয়ে অস্ত্র ধরা দলটি। বিএনপি নির্বাচনে জিতলেও প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসন না পাওয়ায় জামায়াতের সমর্থন পেয়েই সরকার গঠন করে বিএনপি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান ১৯৯১ সালের নির্বাচন নিয়ে লেখা এক বইয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন।
বিএনপি-জামায়াতের এই মধুর সম্পর্ক অবশ্য টেকেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াতের তোলা দাবির পর আওয়ামী লীগের এই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার পর বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক পরিণত হয় শত্রুতায়। জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ তোলেন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম স্বয়ং।
বিএনপি এবং জামায়াতের এই দূরত্বে ১৯৯৬ সালে সুবিধা পায় আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে হারিয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে দলটি। বিএনপির সঙ্গে গোপন সমঝোতা না থাকায় ক্ষতি হয় জামায়াতেরও। ১৮ আসন থেকে তাদের আসন নেমে আসে তিনটিতে। ভোটও ১২ শতাংশ থেকে কমে হয় আট শতাংশে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিএনপি এবং জামায়াতের সম্পর্ক আবার জোরাল হয়ে ওঠে। এবার আর গোপন সমঝোতা না, ২০০১ সালে জোট করেই নির্বাচন যায় জামায়াত। স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে এই জোট গঠন নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনায় পড়লেও বিএনপির ক্ষমতায় ফিরতে তা কার্যকর প্রমাণ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়েই ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট। জোট করায় জামায়াতের ভোট আরও কমে পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এলেও জামায়াতের আসন বেড়ে হয় ১৭টি। এরপর গত একযুগ ধরে একসঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে দেশ পরিচালনা এবং আন্দোলন করেছে বিএনপি-জামায়াত। ২০০১ সালে দুই আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে নিন্দিতও হয়েছে বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছে বিএনপির তৃণমূলের নেতারাও। নির্বাচনে হারার পর ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানে গঠিত ১৪টির বেশিরভাগের প্রতিবেদনেই এই কারণটি উল্লেখপূর্বক জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু নিজ দলের কমিটির সুপারিশ গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করেনি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
বরং আন্দোলনে জামায়াতের ওপর দিনে দিনে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বিএনপি। কিন্তু সম্প্রতি দুই দলের সম্পর্কে হঠাৎ তৈরি হয়েছে ছন্দপতন। নির্বাচন ঠেকাতে শেষ সময়ে ১৮ দলের আন্দোলন থেকে হঠাৎ পিছুটান দিয়েছে জামায়াত। এর পেছনে আছে নানা কারণ।
২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে বলতে গেলে সর্বাত্মক আন্দোলনে আছে বিএনপি-জামায়াত। কর্মসূচি একসঙ্গে হলেও দুই দলের কাছে মূল লক্ষ্য কিন্তু এক না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নতুন করে নির্বাচন বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য হলেও জামায়াতের আন্দোলনের উদ্দেশ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করে তাদের নেতাদের মুক্তি।
তবে দুই লক্ষ্যের আন্দোলন হলেও গন্তব্য (সরকারের পতন) এক হওয়ায় গত কয়েক মাসে একযোগেই চলেছে কর্মসূচি। বিএনপির ঘোষিত হরতাল-অবরোধ পালনে দলের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় না থাকলেও প্রাণপণ চেষ্টা করেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পর দুই দলের মধ্যে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। আর এর প্রভাব পড়েছে আন্দোলনে। ভোটের আগে আগে ডাকা অবরোধ বলতে গেলে অকার্যকরই হয়ে গেছে।
১৮ দল নেতা খালেদা জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকামুখী অভিযাত্রা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি নিলেও কর্মসূচিকে ঘিরে তেমন কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি জামায়াত কর্মীদের মধ্যে। বরং বিএনপির কর্মীরা রাস্তায় না নামলে জামায়াতও নামবে না- দলের এমন অবস্থানের কথা গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেন জামায়াত নেতারা। ২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচির দিন সকাল দশটায় নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়ার কথা জানানোর পর বিএনপি কর্মীদের কোনোরূপ চেষ্টা না দেখে জামায়াতের কর্মীরা রাজপথে নামার চেষ্টাই করেনি। আর সেদিন ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে না পারার পর খালেদা জিয়া পরদিন কর্মসূচি পালনের ডাক দিলেও দেশের কোথাও জামায়াত কর্মীরা বলতে গেলে কিছুই করেনি।
কেন হঠাৎ জামায়াত পিছুটান দিল, জানতে চাইলে দলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রাম করবো আমরা, মারা যাবে আমাদের কর্মীরা কিন্তু তারা (বিএনপি) আমাদের একটু সহানুভূতিও জানাবে না- এমনটি হলে আমাদের কর্মীদের আমরা কী করে ধরে রাখবো?’
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ দল গত ২৫ অক্টোবরের পর আন্দোলনে নামলেও গত ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর শুরু হয় ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলন। কিন্তু এই ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলনেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা থাকে অনুপস্থিত। জোটের অবরোধে সহিংসতা হয়েছে মূলত জামায়াতের শক্তিশালী অবস্থান আছে এমন ১৪টি জেলায়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই মূলত নানা ঘটনা ঘটিয়ে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে এসেছে। তবে আন্দোলনের নামে নজিরবিহীন সন্ত্রাসের কারণে এই আন্দোলন নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর।
বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কথা বললেও আন্দোলনে সহিংসতার দায় কখনো নিতে চায়নি। জামায়াতের সহিংসতার কারণে বিএনপির ভাবমূর্তি যে ক্ষুণ্ন হয়েছে তা অস্বীকার করেন না বিএনপির নেতারাও। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘জামায়াতের আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির কর্মসূচির কোনো সম্পর্ক নেই’। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান এই সময়কে বলেছেন, ‘আন্দোলনের নামে সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না’।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপির প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেয়া থেকে বিরত থাকায়ও জামায়াত অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে কাদের মোল্লার ফাঁসির পর বিএনপির নীরবতা রীতিমতো ক্ষুব্ধ করে জামায়াতকে। জোটের আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিলেও বিএনপি জামায়াতকে কী দিয়েছে, সে প্রশ্ন তোলেন দলের নেতারা।
জামায়াতের দাবি, ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনে জামায়াত কর্মীরা না থাকায় ঢাকায় কিছুই করতে পারেনি। বরং দলটি উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে দলের শক্তিশালী অবস্থান, এমন এলাকায় কর্মীদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। আর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে জামায়াত কর্মীদের সহিংসতার কারণে চিন্তিত হয় সরকার। বিএনপির ঘাঁটিতে বগুড়ায়ও জামায়াতকেই করতে হয়েছে ‘যা করার’।
গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১১টি জেলায় শুরু হওয়া যৌথবাহিনীর অভিযানেও এখন পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে প্রায় সবাই জামায়াতের নেতা-কর্মী। দলটির হিসাবে এখন পর্যন্ত এই অভিযানে মারা গেছে ১৩ জন। কিন্তু এই অভিযান নিয়েও বিএনপি তেমন কোনো অবস্থান নেয়নি।
এসব কারণে আন্দোলন থেকে জামায়াতের পিছুটানের খবর এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। দুই দলের সম্পর্কে হঠাৎ ভাটার কারণে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। কারণ জোটে ১৮টি দল থাকলেও বাকি ১৬টি দল একেবারেই নামসর্বস্ব। ভোটের রাজনীতি বা কর্মী সংখ্যার দিক দিয়ে তারা কখনও ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, দুই দলের মধ্যে দূরত্ব থাকলে জামায়াতের কোনো লাভ নেই। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের এমন কোনো শক্তি নেই যে তারা বিএনপিকে বাদ দিয়ে দাবি আদায় করে ফেলতে পারবে। তাদের লড়তে হবে এক হয়েই।’
আন্দোলনে জামায়াতের ওপর নির্ভর করাটাই বিএনপির কাল হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘বিএনপির তরুণ যে নেতৃত্ব তারা মাঠে সক্রিয় না বলে আন্দোলন গতি পাচ্ছে না। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে গেছে। এই অবস্থায় তারা কিছু করতে পারছে না।’
অবশ্য বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা আর যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ছাড়াও চরমপন্থা নিয়েও জামায়াতে তৈরি হয়েছে মতবিরোধ। গত ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির পর রাজধানী এবং বেশ কিছু জেলায় জামায়াত সন্ত্রাস চালানোর পর এই বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। ফাঁসির পরদিন সহিংসতার পর পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে জামায়াতের সহিংসতাকে ভুল আখ্যা দেন। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি ছিল একটি ভুল, আর যে প্রক্রিয়ায় তার মোকাবিলা হচ্ছে, তা আরও বড় ভুল।
(ঢাকাটাইমস/৯জানুয়ারি/এসআর/জেডএ.)