logo ০৪ মে ২০২৫
তিতাসের এমন অভিযানে লাভ কি
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০:৫০
image


ঢাকা:গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সাল থেকে গ্যাসের আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকলেও ঠিকাদার এবং তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগসাজশে ঠিকই চলে অবৈধ সংযোগ। ২০১৩ সালে এসব অবৈধ সংযোগ বৈধ করতে তিতাস সুযোগ দিলে আবেদন পড়ে প্রায় ৮৬ হাজার। তিতাসের হিসাবে এর বাইরেও থেকে যায় প্রায় সব পরিমাণ অবৈধ সংযোগ।

সংযোগ বৈধ করতে আবেদন না করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে, এমন হুঁশিয়ারি থাকলেও ২০১৩ সালের ২০ জুনের পর সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কোনো অভিযানই চালায়নি তিতাস। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়ে প্রতিবেদন আসার পর গাজীপুরের কালিয়াকৈর, ঢাকার কেরানিগঞ্জ এবং সাভারের কিছু এলাকায় অভিযান শুরু করেছে তিতাস। তবে চারদিন চালানোর পরই থেমে গেছে অভিযান। আবার অভিযানে অবৈধ সংযোগ কেটে দেয়া হলেও এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তিতাস। চারদিনে আর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তিন হাজারের বেশি আর উচ্ছেদ করা হয় ৩৫ হাজার ফুট অবৈধ লাইন। কিন্তু এই সংযোগ যারা নিয়েছে এবং যারা দিয়েছে তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তিতাস বা অভিযানকারী ম্যাজিস্ট্রেট।

তবে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অভিযানকারী দলের ওপর হামলার পর তিতাসের গাজীপুর চন্দ্রা জোনের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আম সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে গত সোমবার ৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তবে এখনও কোনো আসামিকেই ধরতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। প্রমাণ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অবৈধ সংযোগ দেয়ার জন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তিতাসের অভিযান আসলে কতটা কার্যকর হবে সে নিয়ে সন্দিহান খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারাই। তারা বলছেন, গ্যাসের সংযোগ সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে নেয়া সম্ভব না। তিতাসের ঠিকাদার ছাড়া কারো পক্ষে লাইনে হাত দেয়া সম্ভব না। আবার স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশ না থাকলে ঠিকাদারদের পক্ষেও এতো বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ দেয়ার সাহস করার কথা না। এখন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে কেবল সংযোগ কেটে দিলে আবারো তারা অবৈধ সংযোগ নিয়ে নেবে নানা কৌশলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর সরাসরি কিছু না বললেও ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যারা অবৈধ সংযোগ দিয়েছে এবং সংযোগ ব্যবহারকারী উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে আমরা মামলা করেছি।’

অবৈধ সংযোগ কত : গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও তিতাস ধারণা করছে এই সংখ্যা দেড় লাখের কম না। এর মধ্যে কেবল ৮৬ হাজার সংযোগ বৈধ করার আবেদন পড়েছে। তবে পেট্রোবাংলা এবং তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি ২০০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন ও তিন লাখ অবৈধ সংযোগ আছে বলে এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল।

এমনিতেই দেশে গ্যাসের সংকট চলছে। এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিতাসের কর্মকর্তারা। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা আছে দিনে আড়াইশ’ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ আছে ২২০ কোটি ঘনফুটের কিছু বেশি।

তিতাসের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানীর পূর্ব থেকে বৃত্তাকারে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর, টঙ্গী, ঢাকার ধামরাই, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন গ্রামে আবাসিক ও শিল্পকারখানায় অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এর ঢেউ লেগেছে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরেও। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরেও আছে অবৈধ সংযোগ।  তিতাসের সূত্র এবং স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রতিটি অবৈধ সংযোগের জন্য নেওয়া হয়েছে ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর মাসে বিল তোলা হচ্ছে ৫০০ টাকা করে। এর সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গাজীপুরের উপমহাব্যবস্থাপক আশিকুর রহমান জানান, সরকার অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বৈধকরণের ঘোষণা দিলে গাজীপুর জোন থেকে নয় হাজার ও কালিয়াকৈরের চন্দ্রা জোন থেকে পাঁচ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে। জরিপ করে দেখা গেছে, বর্তমানে এ দুটি জোনে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ রয়েছে এরও তিন গুণ।

গণমাধ্যমের সমালোচনায় ‘লোক দেখানো’ অভিযান : বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) গত বছর আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ প্রদান এবং অবৈধ সংযোগ বৈধকরণের ঘোষণা দেয়। তখন ২০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে এই এর মধ্যে সংযোগ বৈধ না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয় পেট্রোবাংলা।

কিন্তু সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরও অবৈধ হিসেবে থেকে যাওয়াদের কিছুই করেনি তিতাস। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন টেলিভিশন এবং পত্রিকায় অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে বেশ ক’টি প্রতিবেদনের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের অভিযান শুরু করে তিতাস। এরপর আরও তিনদিন অভিযান চলে। কিন্তু এরপর বন্ধ আছে কার্যক্রম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই অভিযান থামবে না। সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা পর্যন্ত চলবে তা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম অবশ্য মনে করেন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদের পাশাপাশি যারা বৈধ হওয়ার জন্য আবেদন করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অবৈধ সংযোগ বৈধ করার প্রক্রিয়ারই বিরোধী তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘অবৈধ সংযোগ বৈধ করার সুযোগ যুক্তিযুক্ত নয়। এতে অপরাধীরা উৎসাহ পাবে।’

দুর্ঘটনার ঝুঁকি : অবৈধভাবে বসানো এসব লাইনের কারণে শুধু যে গ্যাস চুরি হচ্ছে, তা নয়, গ্যাস বিতরণব্যবস্থাও ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে মানুষের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে তিতাসের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বলা হয়েছে। তার পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। দক্ষ কারিগর ও প্রকৌশলীদের পরামর্শ ছাড়া বিতরণ ও সার্ভিস লাইন বসানোর কারণে ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে এসব অঞ্চল। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিতাসের প্রকৌশলীরা। বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিতে রূপগঞ্জে তিতাসের পাইপ থেকে অবৈধ সংযোগ নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম দুই থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়। এসব পাইপ থেকে দেড় ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসিয়ে মানুষের বাসা পর্যন্ত সংযোগ দেয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে বা ঢাকা থেকে রাইজার বানিয়ে এনে তা ব্যবহার করে দেয়া হয় এসব সংযোগ। তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব পাইপ নিম্নমানের হওয়ায় বিস্ফোরণ হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়।

গ্যাসের বৈধ সংযোগ মাটির নিচ দিয়ে দেয়া হলেও অবৈধ সংযোগের পাইপ বিদ্যুতের তারের মতো গাছপালার ওপর দিয়ে এবং খুঁটি নিয়েও নেয়া হয়। কোথাও কোথাও মাটি এবং রাস্তার ওপর এক ইঞ্চি পাইপ বসিয়ে সংযোগ নিতে দেখা গেছে।

অবৈধ সংযোগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিতাসের তালিকাভুক্ত ১০টি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির দু’জন ‘টেকনিশিয়ান’কে।

জড়িত রাজনীতিবিদরাও : অবৈধ গ্যাস সংযোগের পেছনে কেবল তিতাসের কর্মকর্তা বা ঠিকাদাররা না, জড়িত রাজনীতিবিদরাও। এদের প্রভাবের কারণেই অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না তিতাস। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরও সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ‘গ্যাস কমিটি’ করে ১২ হাজারেরও বেশি বাড়িতে এভাবে অবৈধ সংযোগ দিয়েছে। এ জন্য প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে গড়ে ৪৫ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে প্রাঢ ৫৪ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। সংযোগের অপেক্ষায় আছে আরও প্রায় ১০ হাজার ‘গ্রাহক’।

অবৈধ সংযোগ নেয়া পাঁচ হাজার মানুষের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে প্রায় ২৫ লাখ টাকা তুলছে এই গ্যাস কমিটি। আর যারা পুরনো হয়ে গেছে এবং যারা আওয়ামী লীগের কর্মী, তাদের কাছ থেকে টাকা তোলা হচ্ছে না।

(ঢাকাটাইমস/২৬ফেব্রুয়ারি/টিএ/  ঘ.)