ঢাকা: অসহনীয় যানজটে ভোগা রাজধানীবাসীর যাতায়াতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য মেট্রোরেল করার চিন্তা আসে সেই ২০০৮ সালে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই আর নকশা অনুমোদনে নানা জটিলতায় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি শুরুই করতে পারছে না সরকার। যদিও জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়ন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। উল্টো বারবার জাইকা এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে তাগাদা দিচ্ছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নানা জটিলতায় দেরি হলেও আগামী বছরেই কাজ শুরুর আশা করছেন তারা। আর ২০১৯ সাল নাগাদই নগরবাসী চড়তে পারবে মেট্রোরেলে। প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের মধ্যে পল্লবী থেকে হোটেল সোনারগাঁও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার চালু করা হবে। এর পরের বছর চালু হবে সোনারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। ২০২১ সাল নাগাদ চালু হবে উত্তরা থেকে পল্লবীর অংশ। যদিও জাইকা বলছে, ২০২১ সালে নগরবাসী রেলে চড়তে পারলেই খুশি তারা। আর পুরো কাজ চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
সবশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার সংস্থান করবে সরকার। বাকি ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা জাপান সরকার প্রকল্প সহায়তা হিসেবে দেবে। প্রথম ধাপে পাওয়া যাবে এক হাজার ৮১ কোটি টাকা। এই ঋণের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, এটি সহনীয় ঋণ (সফট লোন), ৪০ বছরে এটা পরিশোধ করতে হবে এবং রেয়াত সময় থাকবে ১০ বছর। প্রকল্পের প্রাক্কলিত সময় হবে ১০ বছর। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারের সঙ্গে জাপানের জাইকার চুক্তি হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন থাকবে। যেখান থেকে যাত্রীরা উঠতে এবং নামতে পারবেন। প্রতিটি স্টেশনে রেল থামবে সাড়ে তিন মিনিট। স্টেশনগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএলটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। আর মেট্রোরেল পল্লবী থেকে ছেড়ে রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে তোপখানা রোড দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত যাবে। উত্তরা মডেল টাউনের তৃতীয় পর্যায়ের এলাকায় মেট্রোরেলের প্রধান ডিপো স্থাপন করা হবে। তবে ডিপো এলাকায় তিনটি স্টেশন থেকেও যাত্রীরা মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন।
বারবার জটিলতা : যানজটের কারণে উত্তরা থেকে মতিঝিলে আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হলে এই পথ পাড়ি দেয়া যাবে মাত্র ৩৭ মিনিটে, যা মানুষের ভোগান্তি বহুলাংশে কমিয়ে দেবে। তাছাড়া বাস ও অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে ভাড়াও কম হবে মেট্রোরেলে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে মেট্রোরেলের গুরুত্বের কথা নগর পরিকল্পনাবিদরা বলে আসছেন বারবার। এর গুরুত্ব মানছে সরকারও। কিন্তু যেভাবে কাজটি শুরুর কথা ছিল, এগোয়নি সেভাবে। বরং কোন পথ দিয়ে রেলটি যাবে, সেই বিতর্কে পাল্টাতে হয়েছে নকশা। আর এই কারণেই এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি কাজটি।
রুট নিয়ে জটিলতা : প্রাথমিকভাবে বিজয় সরণি হয়ে মেট্রোরেলের পথ নির্ধারণ করা হলেও বিমানবাহিনীর জোর আপত্তিতে তা আর হয়নি। এরপর সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে মেট্রোরেলের পথ প্রস্তাব করা হলে তাতেও বিরোধিতা আসে। এসব কারণে প্রায় ১০ মাস ঝুলে থাকার পর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দেশের পরিবহন অবকাঠামো খাতের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। গত বছরই মেট্রোরেলের ডিপো বানানোর জন্য জমি পেয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গঠিত ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ)। ওই বছরের জুলাইয়ে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই যে ছয়টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে মেট্রোরেল তার একটি। কিন্তু তার পরও ২০ দশমিক এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেলের কাজ শুরু করতে আরো বছর দুই লেগে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সড়ক বিভাগ ও ডিটিসিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির নকশা ও রক্ষণাবেক্ষণ পরামর্শক নিয়োগের চুক্তি হয়েছে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর। এখন আগে থেকেই ঠিক করা রুট অনুযায়ী নকশা তৈরির কাজ চলছে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন পরামর্শক ও পুনর্বাসন-সংক্রান্ত পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। সবকিছু গুছিয়ে আগামী জুন নাগাদ মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কোম্পানি গঠন এবং প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা হবে। এর পরই শুরু হবে জমি অধিগ্রহণের কাজ।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সিংহভাগ অর্থের জোগানদাতা জাইকার একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ঢাকা এসে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে। তারা পরিদর্শন শেষে এর ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ শুরু হবে।
এখনো সরকার মেট্রোরেলের কাজই শুরু করতে পারেনি। সময়মতো শেষ করতে পারবে কিÑ জানতে চাইলে সড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রাজধানীতে মেট্রোরেল চলবে। ঢাকাবাসীকে যানজটের কবল থেকে মুক্তি দিতে মেট্রোরেল প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ ব্যাপারে সবার সদিচ্ছা রয়েছে।’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলপথ এবং রেলের অবকাঠামো প্রকৌশলের নকশা তৈরির কাজ এ বছরের মধ্যে শেষ হবে। তার পরই কাঠামো নির্মাণ শুরু হবে। অতি দ্রুত শুরু এবং নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হবে নির্মাণকাজ। শুধু নকশা নয়, রেলের টিকিটের নকশা কেমন হবে, তাও তৈরির কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে আছে বলে জানা গেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, জাপানের নিপুণ কোয়েই কোম্পানি লিমিটেড, নিপুন কোয়েই ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, দিল্লি মেট্রোরেল কর্পোরেশন লিমিটেড, মেট্রো ম্যাকডোনাল্ড লিমিটেড ইন্ডিয়া, মেট্রো ম্যাকডোনাল্ড প্রাইভেট লিমিটেড ইউকে কনসালট্যান্সি ফার্ম হিসেবে এই প্রকল্পের নকশা তৈরি করছে। নকশা তৈরির পরই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পাবে। তারাই মেট্রোরেলের অবকাঠামো তৈরি করবে।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকাটাইমসকে বলেন, ঢাকাবাসীকে যানজটের কবল থেকে রেহাই দিতে সরকার কাজ করছে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে ছয়টি প্রকল্প দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে তার মধ্যে মেট্রোরেল একটি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্পটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মেট্রোরেল আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। শিগগির এটি মন্ত্রিসভায় উঠবে।
মেট্রোরেল আইন : সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- এবং ১০ কোটি টাকার অর্থদণ্ডের বিধান রেখে মেট্রোরেল আইন, ২০১৪-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এ আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উঠছে বলে জানা গেছে। মেট্রোরেল আইনের খসড়ার নয়টি অধ্যায়ে ভূমি অধিগ্রহণ, মেট্রোরেল পরিচালনা লাইসেন্স, ভাড়া নির্ধারণ কমিটি, আসন সংরক্ষণ, পরিদর্শক নিয়োগ, আপিল কর্তৃপক্ষ গঠনসহ মোট ৪৫টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/ ১৯ ফেব্রুয়ারি / এফএইচ /এআর / ঘ.)