logo ০৪ মে ২০২৫
বাম্পার ফলন: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১৩:১২:১৩
image


ঢাকা: চাকরি করে বা ব্যবসা করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না বাংলাদেশে। কিন্তু যারা এই দেশের মানুষের পেটে খাবার দিতে খেটে মরছে দিনে রাতে, সেই কৃষক ফসল ফলিয়ে ভাগ্য ফিরিয়েছেন এমন উদাহরণ কিন্তু বিরল।

বরং ফসল ফলিয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষগুলো। কোনো বছর কোনো কারণে কোনো একটি ফসলের দাম বাড়লে পরের বছর ওই ফসল চাষের প্রবণতা বাড়ে। আর জোগান বাড়লে দাম কমেÑ অর্থনীতির এই অমোঘ সূত্রের কারণে পরের বছর দাম পড়ে যায় সে ফসলের। এই ফেরে এবার ক্ষতির মুখে পড়েছেন আলু চাষিরা।

রংপুরের বদরগঞ্জের মধুপুর গ্রামের কৃষক কামরুজ্জামান আধমণ আলু বিক্রি করে চেয়ছিলেন চাল কিনতে। কিন্তু আধা বস্তা আলু বেচেও এককেজি চাল কিনতে পারেননি তিনি। এবার এক একর জমিতে আলুর চাষ করেছেন তিনি। পেয়েছেন ২২৫ মণ আলু। প্রতিকেজিতে উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে তিন টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পেয়েছেন দেড় টাকা। তাও সব আলু বিক্রি করতে পারেননি। দাম পড়ে যাওয়ায় হিমাগারে রাখতেও সাহস পাচ্ছেন না তিনি। কারণ, এক বস্তা আলু রাখতে গুনতে হবে ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা। অথচ একবস্তা আলুর দাম মোটে ৮০ টাকা।

কামারুজ্জামানের মতো সারা দেশে আলু চাষিদের সবার অবস্থা একই। আলুর বাম্পার ফলন মুছে দিয়েছে তাদের মুখের হাসি।  চাষের খরচ না উঠলে বছরের বাকি সময়টা কীভাবে কাটবে, সে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে এখন তাদের।

খাদ্য উৎপাদনে সরকার কৃষকদের উৎসাহ দিলেও প্রকৃত চাহিদা কতো তা এখনও জানা যায়নি বাংলাদেশে। ফলে কত পরিমাণ উৎপাদন হলে কৃষক এবং ভোক্তার স্বার্থরক্ষা হবে, সে নিয়ে কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। যেমন চলতি বছর আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে দেড় শতাংশের কিছু বেশি। এতে করেই আলুর দাম এভাবে পড়ে যাওয়ার কোনো কারণই বলতে পারছে না কেউ।

এ বছর আলু চাষ হয়েছে চার লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ লাখ টন, উৎপাদন হয়েছে ৮৬ লাখ টনের বেশি।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে উৎপাদন বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। কারণ, এতে আমদানি নির্ভরতা কমে, বাঁচে বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু আলুচাষিদের বিপদটা কেউ বিবেচনাতেই আনে না কখনও। এবার আলুর বাম্পার ফলন আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।

জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিকেন্দার আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কৃষক তিন মাসের বেশি সময় পরিশ্রম করে আলু ফলিয়েছে। এর বাইরে বীজ, সার, সেঁচ ইত্যাদি খরচ তো আছেই। এভাবে কষ্ট করে ফসল ফলানোর পর ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষক আলু চাষ ছেড়ে দেবে। তখন চাহিদা মেটাতে অন্য দেশ থেকে আলু আমদানি করতে হতে পারে।’  

উপেক্ষিত আলু চাষি : আলুর দাম পড়ে যাওয়ার জন্য সরকারের খাদ্য সংগ্রহ নীতিমালাও দায়ী বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। সরকার ধান এবং চাল সংগ্রহ করলেও অন্যতম প্রধান এই খাদ্যটির দিকে নজর দেয়নি কখনও। আবার ধান সংগ্রহের আগে চাষের খবর বিবেচনা করে সংগ্রহমূল্য ঘোষণা করে দাম পড়ে যাওয়ার হাত থেকে কৃষককে বাঁচায়। আলু আমাদের অন্যতম প্রধান খাবার হতে পারেÑ সরকার বারবার এমন কথা বললেও এই ফসল সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিকেন্দার আলী বলেন, ‘সরকার কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে তাদের বাঁচাতে পারে’।

সরকারি হিসাবে, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৮০টির মতো হিমাগার আছে। তবে এসব হিমাগারে সব মিলিয়ে ৪১ থেকে ৪২ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। অথচ দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ৮৬ লাখ টনেরও বেশি। তার ওপর বেশকিছু হিমাগার ভাড়া বাড়িয়েছে। আগে যেখানে ৩২০ টাকায় ৮০ কেজি আলুর বস্তা হিমাগারে রাখা যেত সেখানে এখন চাষিদের গুনতে হচ্ছে ৩৬০ টাকা। এতে হিমাগারে আলু রাখার প্রতিও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না চাষিরা।

জড়িত কত কৃষক : কৃষি অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এক কোটি ২০ লাখের মতো কৃষক আছেন। এদের ৮০ থেকে ৯০ লাখই প্রতিবছর আলু চাষ করেন। এবার বিপাকে এই বিপুল জনগোষ্ঠী।

সম্প্রতি আলু চাষ করে বিপাকে পড়া চাষিরা মহাসড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভ করেছে। রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরেছে তাদের দুর্দশার চিত্র। কিন্তু সরকারের কানে কি পৌঁছেছে তাদের দুর্দশার কথা? কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, এক মাসের মধ্যেই আলুর দাম বাড়বে। কৃষকদের হতাশ না হয়ে মাচা করে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

কৃষিবিদ অধ্যাপক সিকেন্দার আলী মনে করেন, মাচা করে আলু সংরক্ষণ সবার জন্য সহজ না। তিনি বলেন, এত আলু সংরক্ষণে মাচা তৈরির ক্ষমতা কৃষকের নেই। তাই সরকারকেই আলু সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।

কৃষিমন্ত্রীর এই আশ্বাসে কি কৃষকের হতাশা কাটছে? দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সাদুল্যাপুর গ্রামের কৃষক মনোজ হালদার কিন্তু কোনো আশাই দেখছেন না। ঢাকাটাইমসকে তিনি জানান, একটি এনজিও কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুই বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। কিন্তু আলু কেনার কেউ নেই।

রংপুরের বদরগঞ্জের সামছুল হক সরকারি এসব আশ্বাস বিশ্বাস করছেন না। অন্য সমাধান বের করেছেন তিনি। গরুর জন্য এক বস্তা ভুসি কিনতে তার লাগে এক হাজার টাকার চেয়ে বেশি। অথচ এক বস্তা আলুর দাম ৮০ টাকা। তাই গরু এখন ভুসির বদলে খাচ্ছে আলু।

রফতানিতে সমাধান দেখছে সরকার : এশীয় অঞ্চলে আলু সবজি হিসেবে বেশি সমাদৃত হলেও ইউরোপের অনেক দেশেই প্রধান খাদ্য আলু। এই দিকটি দেরিতে হলেও বিবেচনায় নিয়ে আলু রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদিত হলেও রফতানি হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টন। এই বর্তমানে ২৭টি দেশে আলু রফতানি হচ্ছে। যদিও গত ২০১২-১৩ অর্থবছর ১৮টি দেশে আলু রফতানি হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে সম্প্রতি রাশিয়াতে আলু রফতানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় আরও কয়েকটি দেশে আলু রফতানির সুযোগ করে দেয়া হয় তবে অর্থকরী ফসল হিসেবেও আলু চাষে উদ্বুদ্ধ হবে কৃষক।

উন্মুক্ত কনটেইনারে প্রতি টন আলু ২২৫ থেকে ২৩৫ ডলারে, আর কুল চেইন পদ্ধতিতে ২৮০ থেকে ২৯০ ডলারে রফতানি হয়। এই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ে ১৭ থেকে ১৯ টাকা করে। কিন্তু ভারত এই আলু রফতানি করে ১৮৫ থেকে ২১০ ডলারে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের আলুর চাহিদা বেশি। আলুর রফতানিমূল্য কমানো গেলে রফতানিকারকের পাশাপাশি কৃষক লাভবান হবে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দীন জানান, ‘বিশ্বের অনেক দেশে আলু রফতানি করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে আলু রফতানি করা হয়। রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে আলু রফতানির সুযোগ রয়েছে।’ আলু চাষিদের বাঁচাতে হলে ভিজিএফের মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষকে আলু দেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

বিকল্প আরও আছে : দীর্ঘমেয়াদে আলু চাষির বিড়ম্বনা দূর করতে খাদ্যাভ্যাস বদলের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন। এই সময়কে তিনি বলেন, আলুতে প্রচুর পরিমাণের খাদ্য উপাদান রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে আছে প্রায় ৯৬ কিলোক্যালরি। ৪০ গ্রাম আলুর চিপসে প্রায় ২০৫ কিলোক্যালরি আছে। ৬০ গ্রাম আলু ভাজিতে প্রায় ২৩৫ কিলোক্যালরি পাওয়া যায়। আলুতে স্বল্প পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ আছে। আলুর খোসাও বেশি উপকারী। আলুর খোসাতে ভিটামিন ‘এ’, পটাশিয়াম, আয়রণ, অ্যান্টি-অক্সাইড, ফাইবারসহ প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট আছে। তাই খাদ্য হিসেবে নিয়মিত আলু খেলে রক্তচাপ ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং ত্বক ভালো থাকে। তবে আলু দিয়ে তৈরি খাদ্য এখনও জনপ্রিয় করে তোলা যায়নি। আলুর খাদ্যমান সম্পর্কেও সঠিক তথ্য সবার মধ্যে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচার বাড়াতে হবে। আলুর খাবার প্রস্তুত প্রণালি তৈরি করে সবার মধ্যে বিতরণ এবং গণমাধ্যমে এ সম্পর্কে প্রচার বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

কৃষকের সর্বনাশ, ফঁড়িয়ার পৌষ মাস : কৃষক দুই টাকারও কম দরে আলু বিক্রি করলেও ভোক্তারা কিন্তু তা কিনছে ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি করে। মধ্যস্বত্বভোগীরা মাঝে হাতিয়ে নিচ্ছে এই টাকা। তবে তাদের দাবি, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বাজারে আলুর দাম গ্রামের চেয়ে কিছুটা বেশি। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী নাজিমুদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আগে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় ট্রাক ভাড়া পাওয়া যেত। এখন ৫০ হাজার টাকাতেও ট্রাক পাওয়া যায় না। দেখা যায় আলুর দামের চেয়ে ট্রাক ভাড়াই বেশি।

(ঢাকাটাইমস/ ১২ফেব্রুয়ারি/এফএইচ/এআর/ ঘ.)