logo ০৪ মে ২০২৫
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়: নতুন চাপে বিএনপি
প্রণব সাহা
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১৮:৫৯:৫৫
image


ঢাকা: চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের খবর শুনে নীরব ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এটা আদালতের পর্যবেক্ষণ থেকে করা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনাম। আর আদালতে এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের সময়কার ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক আহমেদ রুমী। ১০ বছর পর সেই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণার পরও যথারীতি নীরব আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান খালেদা জিয়া। তবে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলীয় আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় হওয়ার প্রতিবাদে সারা দেশে গত ৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালন করার চেষ্টা করেছে। সেই হরতাল নিয়েও অস্বস্তিতে পড়েছিল বিএনপি। নিজেদের ১৯ দলীয় জোটের এক শরিকের ডাকা হরতালে সরাসরি সমর্থন জানাতে পারেনি বিএনপি। তবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিএনপিকে ফাসাতে ষড়যন্ত্রের রায়। এই রায় প্রহসনমূলক, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত।’ খুব মনে আছে অস্ত্র আটকের পর তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর মন্তব্য করেছিলেন যে আওয়ামী লীগই এই অস্ত্র এনেছে। দেশের রাজনীতিতে তখন আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিলের ‘টার্ম কার্ড’ নিয়ে উত্তেজনা চলছিল।

দশবছর পর এখন রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপটে ঘোষিত হলো চট্টগ্রাম অস্ত্র আটক মামলার রায়। আর এই রায় ঘোষিত হলো তখন যখন সব রকম প্রতিরোধের চেষ্টা করার পরও নির্বাচন করে দশম জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু করতে পেরেছে সরকার। নিজেদের মহাজোটকেও অটুট রাখতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। ‘নতুন কনসেপ্টে’র বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরকারের মেয়াদের দিন গণনা শুরু হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে। কারণ সংসদের মেয়াদই সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের মেয়াদ। আর নির্বাচনের পর যতই কূটনীতিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের কথা বলছেন ততই যেন সরকারের মন্ত্রীরা জোরেশোরে বলতে শুরু করেছেন যে তারা পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবেন। এমনকি উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি নেতাদের অংশগ্রহণকেও দলের ভুল বুঝতে পারা হিসেবেই অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা।

তবে এ কথা বলা যায় যে, বিগত নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনের (যা নাশকতা হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে) সময় পশ্চিমা কূটনীতিকদের ওপর বিএনপির অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাকে নতুন করে মূল্যায়ন করছেন বিএনপি নেতারা। যদিও নির্বাচনের পরে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার দেখা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে, এমনকি নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং কথা বলেছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। সেই সময় দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘দু’বছর ধরে খালেদার সঙ্গে যোগাযোগ করে হতাশ ভারত।’

ইত্তেফাকের ওই রিপোর্টটি পড়ে মনে হয়েছে, ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বাইরে রাষ্ট্রযন্ত্র একটি অবস্থান থেকে প্রতিবেশী বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এর কারণ হয়তো এই যে দেশের জনগণ কখন কোন দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নেবে, তা বাইরের কোনো দেশের ওপর নির্ভর করে না। কিছুদিন আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একটি অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ আমাদের আত্মার আত্মীয়।’ ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উষ্ণ সম্পর্কের ভিত্তিভূমি হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আর ইতিহাস বলছে, একই সময় ঢাকায় আওয়ামী লীগ আর দিল্লিতে কংগ্রেস সরকারের অবস্থানটা ১৯৭৫ সালের পর এবারই প্রথম। হয়তো সে জন্যই ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টে দিল্লি থেকে অঞ্জন রায় চৌধুুরী জানিয়েছেন, ‘বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে হতাশ ভারত। বিগত দুই বছরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আলোচনার পরও কোনো ইতিবাচক ফল না আসায় ভারত হতাশ হয়েছে।’ এর কারণটা কি এমন যে, ক্ষমতাসীন দলের বাইরে দেশের প্রধান দল বিএনপির সঙ্গে দিল্লির সাউথ ব্লকের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কূটনীতিকরা কি মনে করছেন যে বাংলাদেশে গত ২০ বছরে যেভাবে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে তাতে করে বিএনপি ভবিষ্যতে যে কোনো নির্বাচনে অংশ নিলে তারা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।

প্রসঙ্গটি এ জন্যই সামনে নিয়ে এলাম যে, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষণার পর তার কি প্রভাব পড়বে সাউথ ব্লকের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক উন্নয়নের ক্রমাগত চেষ্টার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে। ঢাকায় নিযুক্তরা শুধু নন, দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও এ কথা জোর দিয়েই বলেন দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের একটি বড় বিষয় হচ্ছে- ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তা’। ফলে ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন উলফা গেরিলাদের জন্য অস্ত্র আনা এবং সেই চোরাচালানের সঙ্গে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চয় প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্র প্রশাসন সহজভাবে নেবে না, তা কেন্দ্রে যে দলেরই রাজনৈতিক সরকার থাকুক না কেন। এ কথা নিশ্চয় বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বা দলের নেতারা অস্বীকার করবেন না যে, ২০০৪ সালের পর থেকে শুধু নয়, ২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। আর ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামে অস্ত্র আটকের পর তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

খুব নিকট অতীতের ঘটনা হচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ঢাকায় আসার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের তার সঙ্গে দেখা হয়নি। যদিও সেটা ঠিক হয়নি বুঝতে পেরেই খালেদা জিয়া সর্বশেষ ঢাকায় আসা ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ইত্তেফাকের যে রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়েছি শুরুতে, দিল্লি থেকে অঞ্জন রায় চৌধুুরী তাতে লিখেছেন, ‘গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বয়কট করায় দিল্লির সাউথ ব্লক হতাশ। কারণ এর মাধ্যমে ইতিবাচক কোনো ফল বেরিয়ে আসবে না।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘২০১২ সালে ভারত সফরের সময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, তিনি খোলামন নিয়ে এসেছেন। অতীতের ক্ষত ও তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে তিনি নতুন যুগের সূচনার প্রত্যাশা করেন। তার ঢাকা ফেরা ও শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থি বলে আক্রমণ করার আগ পর্যন্ত তার সফরকে দিল্লি সফল হিসেবে দেখছিল।’

ইত্তেফাকের রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সূচনা হয়। ২০১২ সালে খালেদা জিয়া যখন ভারত সফর করছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার জন্য বিশেষ মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এমনকি গত বছরের মার্চে ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার সঙ্গে বৈঠক করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই বৈঠক অবশ্য বিএনপি এড়িয়ে গেছে হরতাল-অবরোধের অজুহাতে। বিষয়টি ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকর ছিল। একাধিক কূটনীতিক তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, বিএনপি নেতারাই যোগাযোগ করে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের চেয়ারপারসনের সাক্ষাতের সময়টি সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। কিন্তু হরতালের মধ্যে বিএনপি নেত্রী বাসার বাইরে বের হবেন না এই কারণে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কথা হলো না।

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়া না নেয়া সঠিক ছিল না ভুল ছিল সেই বিতর্কের ইতি ঘটবে না সহজেই। কিন্তু নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলার দায় শরিক জামায়াতে ইসলামীর কারণে খুব সহজেই এড়াতে পারবে না বিএনপি। আর একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ভারত শুধু নয়, পশ্চিমা বিশ্বের উদারনীতির দেশগুলোও সংখ্যালঘু নির্যাতন বা জঙ্গিবাদী সব তৎপরতার বিরুদ্ধে। তাই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য বিএনপির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এখন অনেক বেশি। হয়তো তাই ১৯ দলীয় জোটের প্রধান এবং শক্তিশালী শরিক জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ফাঁসির রায় ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও তার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করতে পারছেন না বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়া। এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে আসামি হিসেবে ফাঁসি হয়েছে উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়–য়ারও। অস্ত্রগুলো খালাস হয়েছিল এমন একটি স্থাপনায়, যা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং ২০০৪ সালে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। মামলার সাক্ষী শিল্পসচিব শোয়েব আহমদ আদালতে বলেছেন যে, অস্ত্র আটকের ঘটনা মন্ত্রী নিজামীকে জানানোর পর তিনি কোনো পদক্ষেপ না নিতে বলেছিলেন।

ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করেই বিচারক অভিমত দিয়েছেন যে, সব শুনেও নিজামীর মতো খালেদা জিয়াও চুপ ছিলেন। মামলার এসব বিবরণী পড়ে সাধারণ মানুষ কি ধরে নেবে যে, উলফার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে তখনকার বিএনপি সরকারের সায় ছিল। প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র আন্দোলনে শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, একই সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহে সহযোগিতা করার এ বিষয়গুলো জানার কারণেই কি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরফ-শীতলতায় জমে গিয়েছিল। মাত্র কয়েক দিন আগেই ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও বিএনপি নেতাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন, সাবেক এমপি মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম উপস্থিতি ছিলেন। বলা যায়, ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাটা অব্যাহত আছে; কিন্তু ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় কি সে ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না?

(ঢাকাটাইমস/৫ ফেব্রুয়ারি/ পিএস/ জেডএ.)