logo ০৪ মে ২০২৫
২০০১ সালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার এবার হবে তো?
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০৬:১২
image


ঢাকা: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। হিন্দুদের ওপর এই ধরনের হামলা ঘটেছে বারবার। নানা সময় জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে জেতার পর ভোট না দেয়ার অজুহাতে অথবা হেরে যাওয়ার পর প্রতিশোধ স্বরূপ এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়েছে তা নিয়ে নিন্দার ঝড় এখনও বইছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট এ অভিযোগ পাঁচ বছর ধরে অস্বীকার করেছে।

তবে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ওঠে আসে ভয়াবহতার চিত্র। সারাদেশে তিন হাজার ৫৫৭টি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কমিটির প্রধান। এসব ঘটনায় ২৬ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে তারা চিহ্নিতও করেছিল। চারদলীয় জোট সরকারের ২৫ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এসব হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল বলে কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান কমিশনার এবং সে সময়ের জেলা জজ মো. শাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নেতৃত্বে তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটি এক বছর তিন মাস কাজ করার পর এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। ২০১১ সালে এক হাজার ৩৫৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পরে সরকার নানা সময় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত কাজ কিছুই করেনি।

তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেতার পরও বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আগের ঘটনায় দায়ীদের বিচার না হওয়াতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছেÑ এমন কথা বলছেন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজ্ঞরা। এই অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবিও উঠেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়টি তাদের সর্বোচ্চ বিবেচনায় আছে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাবানদের একটি বড় অংশ এপার বাংলা ছেড়ে চলে যায়। আর এতে অনেকটা নেতৃত্বহীন অবস্থায় পড়ে যায় দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। রাজনৈতিক কারণের পাশাপাশি সম্পদ দখলও এদের ওপর হামলার কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠলেও কিন্তু সম্পদ দখলের অভিযোগ আছে সব দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে। কাজেই হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি একদিক থেকে চিন্তা না করার সুপারিশ করেছেন তিনি।

এবার অবশ্য ভোটের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। ভোটের পাঁচদিন পর ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দলে থাকায় এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা রোধে আওয়ামী লীগ কিছু করতে পারেনি। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় আছে সে বিষয়টি ভুলে না যেতে হামলাকারীদের সতর্ক করে দেন শেখ হাসিনা।

যশোর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধাসহ যেসব এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে সেসব এলাকায় পুলিশ এখনও অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজও শুরু করেছে সরকার। যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতে বিজিবিকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে যশোরের অভয়নগরে কাজ শুরু করেছে বিজিবি। এ কাজ শেষে সাতক্ষীরায় কাজ শুরু করবে তারা।

এই পুনর্বাসনের পাশাপাশি এবারসহ গতবারের হামলায় জড়িতদের বিচারের বিষয়টিও গুরুত্ব যথেষ্ট পাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টিও সামনে এসেছে। এক আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০১ সালের সংখ্যালঘু ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রতিবেদনটি ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তলব করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে সময় চাইলে আদালত আরও এক সপ্তাহের সময় দেয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি অন্য কোনো উপায়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

ঢাকাটাইমসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ওই তদন্ত কমিটির প্রধান ও দুদক কমিশনার শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘কমিশন যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল তখন মন্ত্রী ছিলেন সাহারা খাতুন। তার পরে মন্ত্রী হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। কিন্তু আমার মনে হয় তাদের অপরিপক্বতার কারণে ওই সময় তদন্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। তাছাড়া তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সোবহান শিকদারের অসহযোগী মনোভাবও এর পেছনে রয়েছে।’ অবশ্য প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে সাহারা খাতুন এক সংবাদ সম্মেলন করে ২০০১ সালে হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য দায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরে কেন যেন আর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কমিশনের তদন্ত কাজ খুব একটা সহজ ছিল না উল্লেখ করে শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, যদি ওই সময় প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো তবে এবার নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তা না-ও হতে পারত। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমি খুব বেশি দিন হয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেইনি। আগে বিষয়টি জেনে তার পর কথা বলব।’

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ :  বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে জোট সরকারের আমলে যে ২৫ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম উঠে এসেছে তাদের প্রায় সবাই এখনও রাজনীতিতে সক্রিয়। এদের মধ্যে বিএনপি নেতার সংখ্যাই বেশি। আছেন জামায়াতের কয়েকজন নেতাও।

বিএনপির নেতাদের মধ্যে আছেন জোট সরকারের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, পানিসম্পদ মন্ত্রী হাফিজউদ্দিন আহমেদ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদনে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেনÑ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, শহীদুল হক জামাল, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, নাদিম মোস্তফা, জয়নুল আবেদিন, এএইচএম সেলিম, শহিদুল ইসলাম, ইলিয়াস আলী, ইলেন ভুট্টো, হাফিজ ইব্রাহীম, সালাউদ্দীন আহমেদ, আলমগীর হায়দার, ডা. সালেক চৌধুরী, জহিরউদ্দীন স্বপন ও সাখাওয়াত হোসেন।

২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত হামলায় জামায়াতের বেশ ক’জন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও জড়িত ছিলেন বলে কমিশনের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। এঁরা হলেনÑ জামায়াতে ইসলামীর আমির ও জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবু তাহের ও আবদুস সোবহান। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় আসছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। বরং তারা বলেছিল, বাংলাদেশের কোথাও সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এসবই আওয়ামী প্রোপাগা-া, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

(ঢাকাটাইমস/০৫ফেব্রুয়ারি/এইচএফ/এআর/ ঘ.)