logo ০৪ মে ২০২৫
সমস্যা কেবল ডিসিসির নির্বাচনে!
বিলকিছ ইরানী, ঢাকাটাইমস
৩০ জানুয়ারি, ২০১৪ ২২:২২:১০
image


ঢাকা: জাতীয় সংসদের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে দুই প্রধান জোটের বিরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে একতরফা। বিএনপির নেতৃত্বে ১৮-দলীয় জোট নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করলেও সংবিধান থেকে একচুলও সরতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর গত ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে বিরোধী জোট। এ নির্বাচনের আমেজ শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হচ্ছে উপজেলা নির্বাচন। মেয়াদ শেষ হতে কয়েক দিন বাকি থাকতে এই নির্বাচন করতে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধ থাকলেও সব কয়টি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে সময়মতো। হচ্ছে না কেবল ঢাকা সিটি করপোরেশনে। ১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট চালু হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটে নির্বাচন হয়েছে চার দফা। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে দুবার। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে প্রথম নির্বাচনের পর দ্বিতীয় নির্বাচন নিয়েও জটিলতা হয়। ১৯৯৯ সালে মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন হয় আরও তিন বছর পর ২০০২ সালে। উল্লেখ্য, ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে ঢাকা ছাড়া খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরেও হয়নি এই নির্বাচন। ২০০২ সালে একতরফা ভোটে নির্বাচিত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে করপোরেশন মেয়াদ শেষেও কাজ করে আরও চার বছর।

২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ডিসিসি ভেঙে দুটি সিটি করপোরেশন করার পর পদ হারান মেয়র খোকা এবং অন্য কাউন্সিলররা। কথা ছিল, ৯০ দিনের মধ্যে এই দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হবে। কিন্তু সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও নির্বাচন হয়নি। পরে আইন সংশোধন করে আরও ছয় মাস সময় বাড়ায় সরকার। সেই মেয়াদেও হয়নি নির্বাচন। এর মধ্যে ২০১২ সালের ২৪ মে তফসিল ঘোষণার পরও আদালতের নির্দেশে আটকে যায় নির্বাচন। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ মে আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলেও সীমানাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে আটকে যায় নির্বাচন। যদিও নির্বাচন কমিশন গত ঈদুল ফিতরের পর নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিল।

নির্বাচন না হওয়ায় এখন দুটি সিটি করপোরেশনই পরিচালনা হচ্ছে প্রশাসকের মাধ্যমে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে নাগরিকরা। আর নানা অভিযোগ বা দাবি নিয়ে কোথায় যেতে হবে তা জানা না থাকায় সমস্যায় পড়ছে ভুক্তভোগীরা।

গত এক যুগেও রাজধানীর ভোটাররা করপোরেশন পরিচালনায় কেন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারছে না- এমন প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনে বারবার করেছেন সাংবাদিকরা। নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন, সরকারের ইচ্ছাই এখানে প্রধান। তারা বলছেন, যে জটিলতায় নির্বাচন আটকে যাচ্ছে সেখানে তাদের কোনো হাত নেই। কারণ, আইন অনুযায়ী করপোরেশনের সীমানা নির্ধারণ করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঢাকার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের সীমানা নিয়ে যে জটিলতা তাছে, সেটা দূর করতে মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এই সীমানাসংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে কেন উদ্যোগ নিচ্ছে না- সেই বিষয়টি কখনোই স্পষ্ট করেনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

সংবিধান অনুযায়ী দেশের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সরকার পরিচালিত হবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত শাসকদের দিয়ে। কিন্তু খোদ রাজধানীতে এ বিধানটি কেন পালন করা হচ্ছে না, তার কোনো সদুত্তর সরকার বা সরকারি দলের কোনো নেতা দিতে রাজি হননি।

মহাজোটর সরকারের আমলে দেশে মোট ৯টি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সাতটিতেই জিতেছেন বিএনপি নেতারা। দুটিতে আওয়ামী লীগ নেতারা জিতলেও তাদের কেউ দলের সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন না।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যে হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ২০১০ সালের ১৭ জুনের নির্বাচনে তিনবারের মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ লক্ষাধিক ভোটে হেরে যান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলমের কাছে।

এরপর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে হেরে যান দলের সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান।

বর্তমান সরকারের আমলে গঠন করা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনেও হেরে যান সরকার দলের প্রার্থী। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে বিএনপির মনিরুল হক সাক্কুর কাছে হারেন আওয়ামী লীগের আফজাল খান। অবশ্য ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের নেতা শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু।

তবে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন চার সিটি নির্বাচনে। ২০০৮ সালে জিতলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে হেরে যান রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনায় আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়ররা। এরপর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুরে গত ৬ জুলাই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে আজমতউল্লা খানের হারে হতভম্ভ হয়ে যায় সরকারি দল। এরপর জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ডিসিসি নির্বাচনে ঝুঁকি নিতে চায়নি বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপি।  

জাতীয় নির্বাচনের পর এবার উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন জানিয়েছে, কয়েক ধাপে সব কয়টি উপজেলায় নির্বাচন শেষ করতে মে মাস পর্যন্ত সময় লাগবে। কাজেই এ সময়ের মধ্যে রাজধানীতে নির্বাচন হবে না, সেটাও প্রায় নিশ্চিত।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এত অনীহা কেন? নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এর পুরো দায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এখনও সীমানা নির্ধারণ করেনি তারা। এ জন্য আমরা স্থানীয় সরকারকে চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু সে চিঠির জবাবও দেয়নি তারা।’

আরেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, সীমানা নির্ধারণে এলাকাভিত্তিক সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) দাগ মেলাতে হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকায় এই দাগ মেলাতে পারছে না। তিনি বেলন, বিভিন্ন জমি মাপতে বা নকশা করতে গিয়ে এসএ  (স্টেট একুইজেশন সার্ভে), আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) ও সিটি দাগ দিতে হয়। বিভিন্ন জমিতে আরএস দাগ একাধিক আছে। এর কারণে সিএস দাগ মুছে গেছে। এখন সীমানা নির্ধারণে সিএস দাগের কোনো চিহ্নই নেই কোনো কোনো এলাকায়। এ কারণেই সীমানা নির্ধারণে জটিলতায় পড়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

এ অবস্থায় নির্বাচনী আইন পরিবর্তন না করলে ডিসিসি নির্বাচন দ্রুত করা যাবে- এমনটা মনে করছে না নির্বাচন কমিশন। তবে এ বিষয়ে এখনই সরকারকে কিছু বলবে না কমিশন।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, সময়মতো ডিসিসি নির্বাচন না করায় সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে আমরা আগেই অনেক কথা বলেছি। কিন্তু কেন নির্বাচন হচ্ছে না তা বুঝতে পারছি না।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতির প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘আমি এত দিন যতটা বোঝলাম তাতে মনে হয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কারণেই ডিসিসি নির্বাচন আটকে আছে। তারা এ নির্বাচনকে গুরুত্বই দিচ্ছে না তেমন।’ তিনি বলেন, সিএস দাগ বা অন্য কোনো জটিলতায় নির্বাচন দীর্ঘদিন আটকে থাকতে পারে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এ জটিলতা দূর করে দ্রুত নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভেঙে দুই ভাগ করার বিরোধিতা করলেও মহাজোট সরকারের আমলে ঢাকায় একাধিকবার নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বারবার অভিযোগ করেছে, সরকার দলের প্রার্থীরা ঢাকায় জিততে পারবে না- এই আশঙ্কার কারণে নির্বাচন দিতে চায়নি সরকার। বিশেষ করে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জেতার পর বিএনপি জোরালোভাবে ঢাকায় নির্বাচন চায়।

ঢাকায় নির্বাচন করতে মহাজোট সরকারের কোনো অনীহা আছে কি না- জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন করতে সরকার সব সময় আগ্রহী ছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে উদ্যোগ নিয়েও একাধিকবার এই নির্বাচন করা যায়নি। এখানে অন্য কোনো কারণ কখনোই ছিল না।’

(ঢাকাটাইমস/ ৩০ জানুয়ারি/বিআই/এআর)