logo ০৪ মে ২০২৫
সবার জন্য নয় মাস্টার্স
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
২৮ জানুয়ারি, ২০১৪ ১১:৫৭:০৭
image


ঢাকা: ১৯৯৭ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালুর পরই সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল এই কোর্স স্নাতকোত্তরের (মাস্টার্স) সমমানের। অর্থাৎ চার বছরের স্নাতক করা থাকলে চাকরিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। সরকারি প্রজ্ঞাপনে সে বিষয়টি স্পষ্টও করা হয়েছে। তারপরও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করা থেকে বিরত থাকছে না শিক্ষার্থী। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ছিল তিন বছরের। এরপর এক বছরের মাস্টার্স ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি। যারা দুই বছরের পাস-ডিগ্রি কোর্স করে মাস্টার্স করতে চাইত, তাদের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে হতো দুই বছর। এখন অবশ্য ডিগ্রি করে মাস্টার্স করার প্রবণতা কমেছে। আর ডিগ্রি (পাস কোর্স) এখন দুই বছরের বদলে তিন বছর হয়েছে।



 





চার বছরের স্নাতক কোর্স চালুর পেছনে সেশনজট কমানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের খরচ কমানোও ছিল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষায় সরকারের খরচ কমিয়ে আনাও ছিল অন্যতম লক্ষ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে সরকারের খরচ হয় ৮৪ হাজার টাকা।



 





বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, মাস্টার্স পর্যায়ে খরচ কমিয়ে আনতে পারলে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব। আর এই চিন্তুা থেকে মাস্টার্স কোর্স সীমিত করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।



 





ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৩২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে প্রতি বছর তিন লাখ শিক্ষার্থী মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে এই কোর্সে ভর্তি হয় আরও প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। ইউজিসির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সুযোগ সুবিধা না এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও মাস্টার্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার মাস্টার্সে সব শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় হলগুলোতে আবাসিক সংকটও তৈরি হয়। আর আবাসিক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো পড়াশোনা করতে পারে না।



 





বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্সের মান নিয়ে আছে গুরুতর অভিযোগ। টিউটোরিয়াল, ইনকোর্স, অ্যাসাইনমেন্ট লেখা, গবেষণাপত্র দেখানো এমনটি মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। ইউজিসি থেকে যেসব পাঠ্যক্রম অনুমোদন করানো হয় তার সব পড়ানো হয় না বলেও অভিযোগ আছে। অনেকের বিরুদ্ধে আবার ইভিনিং মাস্টার্স কোর্সের নামে আছে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ।



 





বাংলাদেশে চিকিৎসা এবং প্রকৌশল শিক্ষায় স্নাতক পাস করেই কর্মজীবনে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা। তবে যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চান, তারা উচ্চতর ডিগ্রি নেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেই চাকরি জীবনে ঢুকে শিক্ষার্থীরা।



 





মাস্টার্স কোর্স এক বছরের হলেও সম্মান শেষে ভর্তি, আর পরীক্ষা শেষে ফল প্রকাশ-সব মিলিয়ে দুই বছর লেগে যায়। ইউজিসি মনে করছে, অনার্স শেষে চাকরি জীবনে ঢুকলে দুই বছরে শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে এগিয়ে থাকবে। আর কোনো পেশায় পেশাগত কোর্স করার দরকার থাকলে সেই পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্স চাকরি করা অবস্থাতেই করে নিতে পারবে। সরকারি চাকরিজীবীরা এভাবেই প্রয়োজনীয় বিষয়ে পড়াশোনা করে থাকে।



 





পশ্চিমা বিশ্বে মাস্টার্স কোর্স সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত না। চার বছরের স্নাতক পড়েই শেষ হয় তাদের শিক্ষাজীবন। যারা শিক্ষকতার পেশায় যেতে চান বা গবেষণা করতে চান স্নাতকোত্তর কোর্স পড়তে পারেন কেবল তারাই। আর এই কোর্সে ভর্তির আগে শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যুক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হয়। বাংলাদেশেও একই পদ্ধতি চালু করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। গত কয়েক বছর ধরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মানের ওপর পর্যবেক্ষণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে এমন সুপারিশ করেছে তারা।

চার বছরের স্নাতক কোর্স চালুর পর প্রথম কয়েক বছর বিভ্রান্তি থাকলেও এখন এই কোর্স দিয়েই প্রথম শ্রেণীর সরকারি-বেসরকারি চাকরি করা যায়। তাই মাস্টার্সের ব্যাপারে এখন সিদ্ধান্তের সময় এসেছে বলে মনে করে মঞ্জুরি কমিশন। কমিশন মনে করে, ঢালাওভাবে সব শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি করানোয় এই পর্যায়ে শিক্ষায় যথাযথ মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হলে গবেষণাসহ বিভিন্ন জটিল বিষয়ে তাদেরকে শিক্ষকরা আরো বেশি সময় দিতে পারবে।



 





ইউজিসি চেয়ারম্যান একে আজাদ চৌধুরী ঢাকাটাইমসে বলেন, ‘অন্যরা এই ডিগ্রি (মাস্টার্স) না নিলে কোনো ক্ষতি নেই। এটা হলো অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। শিক্ষক এবং গবেষকদের জন্য কোর্সটি রাখা হলে সার্বিকভাবে তা যৌক্তিক হবে।’ ইউজিসির এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত নেই শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের। তবে বাস্তবতাবে বিবেচনায় না রাখলে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে মাস্টার্স কোর্স সবার জন্য দরকার নেই। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে এখনও অনেকে মাস্টার্সকে অগ্রাধিকার দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতাও আরোপ করে। চাকরিজীবীদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনÑ এসিআরেও এই সনদ ইতিবাচক প্রভাব রাখে। এ ক্ষেত্রে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোভাব পরিবর্তনেও সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’



 





স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর সুপারিশও দেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে স্নাতক ডিগ্রিটার মান এমনই যে সেখানে আর মাস্টার্স করার দরকার পড়ে না। কিন্তু আমার বিভাগে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে মাস্টার্সে এসেই, যদিও আগেই সেটা হওয়ার কথা ছিল।’ আবার সব বিষয়ে মাস্টার্স বন্ধ না করে কোনো কোনো বিভাগে তা চালু রাখার পক্ষে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তবে মঞ্জুরি কমিশনের এই পরিকল্পনা ছাত্ররা কতটা মেনে নেবে সে নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, মাস্টার্স ডিগ্রির বিষয়টি কেবল চাকরির ক্ষেত্রে না, এর সামাজিক মর্যাদার বিষয়টিও ফেল না নয়। আর এ কারণেও ছাত্ররা মাস্টার্স শেষ না করে শিক্ষা জীবন শেষ করতে চান না।



 





ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সবুজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এই সিদ্ধান্ত আমরা কোনোভাবেই মানব না। আমরা মাস্টার্স করবো কি-না, বিশ্ববিদ্যালয় সে সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। এমন পরিকল্পনা নিয়ে আগালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নামবে।’ তবে উল্টো মতও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মুবিন হোসেন বলেন, ‘বিষয়টা খারাপ হবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী না। এ অবস্থায় মাস্টার্স করা মানে শুধু শুধু দুই বছর বাড়তি পড়াশোনা করা। এর বদলে অনার্স শেষে চাকরির চেষ্টা করলে সেটা আমাদের জন্যই ভালো।



 





বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এই সিদ্ধান্ত বিতর্ক তৈরি করবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘কোন ছাত্র কতটুকু পড়বে সে সিদ্ধান্ত তার নিজের, মঞ্জুরি কমিশন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাছাড়া অনেক চাকরিতে মাস্টার্স চাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবার জন্য এই কোর্স বন্ধ করতে হলে আগে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বাধ্যবাধকতা আরোপ থেকে সরাতে হবে।’



 





জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, উইজিসির প্রস্তাব আলোচনার দাবি রাখে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে। তবে আমাদের বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার জন্য মাস্টার্স না করার সিদ্ধান্ত নিলে বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাধা আসবে। কিভাবে এই বিতর্কের সমাধান করা যায়- জানতে চাইলে এ শিক্ষাবিদ বলেন, সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যেও এই বোধ জাগাতে হবে যে, এই সিদ্ধান্ত তাদের কোনোভাবেই ক্ষতির কারণ হবে না। পাশাপাশি চাকরি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যেন কোনো রকম অসুবিধা না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।



 





(ঢাকাটাইমস/ ২৮ জানুয়ারি/ এমএম/এআর)