ঢাকা: সম্প্র্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরের অভয়নগরে তার বক্তৃতায় বলেছেন, গোলাপি রে গোলাপি, তুই তো ট্রেন মিস করলি।’ ব্যাপারটায় বেশ রসবোধ আছে। গোলাপি সিরিজের বেশ কয়টি সিনেমা আছে বাংলায়। গোলাপি এখন ট্রেনে, গোলাপি এখন লন্ডনে ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী যে বেশ খোঁজখবর রাখেন তা বোঝা গেল। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই বাক্য কাকে উদ্দেশ করে সেটা সবাই অনুমান করতে পারে। পরিস্থিতি এখন এমন যে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে এই কথা না বললেও চলত শেখ হাসিনার। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ‘গোলাপি’ উচ্চারণের পেছনে আছে খালেদা জিয়ার ‘গোপালি’ উচ্চারণ। কিছুদিন আগে সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তার বাসায় দায়িত্বরত মহিলা পুলিশকে গোপালি বলে তিরস্কার করেছিলেন। তখন অবশ্য কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। তখনই একটি ব্যাপারে আমার অনুমান অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে, আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘বাড়ি কই, গোপালি! গোপালগঞ্জের নাম আর থাকবে না।’ বিএনপির মতো এত বড় একটি দল যে দলের হয়ে তিনি দুইবার, একতরফা নির্বাচন ধরলে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই মাপের একজন মানুষের কথাকে উড়িয়ে দেয়ার কোনো উপায় নেই। তাহলে এই বক্তব্য কী মেসেজ দিচ্ছে আমাদের? তিনি মনে করছেন, তার প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনার বাড়ি গোপালগঞ্জ। তিনি মনে করছেন, প্রশাসনে যারা চাকরি করছেন বা গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন সবাই গোপালগঞ্জের। ঘটনার পারম্পর্য খুঁজতে গেলে দাঁড়াবে- তিনি মনে করছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ‘গোপালগঞ্জ’ শব্দটি, পরে এলাকাটি। তার এই বাক্য থেকে খোদ খালেদা জিয়ার মনকে আবিষ্কার করা সম্ভব। তিনি নিজেও কার্যত তাই। ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের বাড়ি ফেনী আর স্বামীর বাড়ি বগুড়ার লোকজনকেই তিনি হয়তো ক্ষমতার রন্ধ্রে রাখেন। তার অনেক নজির আমরা দেখেছি। তার ভাইবোন, সন্তানসন্ততি কিভাবে কত ভাবে মানি মেকিং করেছেন, তা সবার জানা।
তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারেও খোঁজ করলে শেখ হাসিনার আত্মীয় অথবা গোপালগঞ্জের অনেককেই পাওয়া যাবে। শুধু সরকারে নয়, হয়তো নানা প্রতিষ্ঠানেও অনেক লোকজন পাওয়া যাবে। দুই নেত্রীর এই উচ্চারণগুলো তাদের বোঝার জন্যই জরুরি ছিল সাধারণ মানুষের কাছে। যতই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হোক, আসলে আমাদের নেতা-নেত্রীরা কি এখনো আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদেরই অনুসারী? না হলে এ ধরনের কথা তারা বলেন কিভাবে? আমরা তো তাদের সারা দেশের নেতা-নেত্রী মনে করতাম। গোপালগঞ্জ, ফেনী, বগুড়াসহ সারা দেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার মানুষ সবাই তাদের কাছে সমান গুরুত্ব পাবে- এটাই তো দেশবাসীর কামনা। তাদের এই মানসিকতা আরো অনেক জায়গায় বিস্তৃত। যেমন সরকারি-বেসরকারি নানা জায়গায় চাকরি করতে গেলেও নিয়ত দেশের মানুষকে এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এলাকা বেসিসে কোম্পানিতে লোকজন নিয়োগ করা হয়। তাতে যেসব এলাকার মানুষ এখনো কল-কারখানা বা অফিস গড়ে তুলতে পারেনি সেসব এলাকার লোকজন সেসব অফিসে চাকরি পাবে না। এ ব্যাপারটা আমরা অস্বীকার করলেও, উড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু বাঙালি বা বাংলাদেশি হওয়া থেকে আমাদের বিরত রাখে। সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের প্রতিই মানুষের একটা হতাশা তৈরি হয়। আর এসব আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ যে বেশ ভালোভাবেই জারি আছে তা আসলে প্রকাশিত হয় নেতাদের এসব আচরণে।
শুধু এসবই নয়, আরো বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পরকে উদ্দেশ করে নেত্রীদ্বয় এমন এমন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, যা জনগণকে যথেষ্ট হাসির খোরাক জুগিয়েছে। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘আন্দোলনের বাতাসে একটি চুলও থাকবে না।’ তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন আমরা পরচুলা পরিনা। যারা পরচুলা পরে তাদেরই চুল উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’ কথা হচ্ছে, এই কথাগুলো ঠিক রাজনীতিসুলভ নয়। কোনো দেশের রাজনীতিবিদরা পরস্পরের উদ্দেশে এমন কথা বলে কি না আমার জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, পরস্পরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে তার জন্য তারা হাজির হচ্ছেন বিতর্কের টেবিলে। মিডিয়া ও হাজারো দর্শনার্থীর সামনে হয় সেই বিতর্ক।
তবে আমাদের দেশে এ ধরনের রাজনৈতিক কালচার তৈরি হওয়ার পেছনেও ইতিহাস আছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘূর্ণিচক্করে পড়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর অনিবার্য কারণে খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসতে হয়। হয়তো বিএনপির প্রয়োজনে অথবা সাংসারিক প্রয়োজনে। খালেদা জিয়ার না ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, না ছিল রাজনৈতিক শিক্ষা। গতানুগতিক রাজনীতিতে যে ‘গণতন্ত্র’ চালু আছে, যে গণতন্ত্রের রক্ষা ও উদ্ধারের কথা বলে রাজনীতিকে সরগরম করা হচ্ছে, তা আসলে পশ্চিমের নয়া-উদারবাদের স্লোগান। এ ছাড়া নানা সময়ে তার আচরণে, তার সরকারের আমলেও মনে হয়েছে রাজনীতিটাকে মানে বিএনপিকে তিনি নিজের রান্নাঘরই মনে করতেন। কিন্তু রাজনীতি তো আরো ব্যাপক, বিস্তৃত একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি যতটুকু বোঝেন তার মস্তিষ্কের যেই বৃত্ত তা দিয়েই কিন্তু বিএনপি চলে আসছে এত দিন। অনেকটা পারিবারিক ব্যবসায়ের মতো। যাতে পরে যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির।
ভাগ্য ভালো শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে এসব কথা কখনো বলেননি। তিনি খালেদা জিয়ার এসব বেফাঁস কথার উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র। তবে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও সত্য যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার পর তাকেও অনিবার্যভাবে রাজনীতিতে চলে আসতে হয়। কারণ প্রতিটি ঘটনাই পরবর্তী ঘটনার স্রষ্টা। তবে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা হচ্ছে তিনি ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছেন রাজনীতি করতে। একটা রাজনৈতিক পরিম-লে তিনি বেড়ে উঠেছেন। নিজেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। নানা দেশে রাজনীতিকদের হত্যাকাণ্ডের পর তাদের সন্তানরা রাজনীতিতে এসেছেন। সেটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দেখা যায় অহরহ। যেমন ভারতে ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব, রাজীব হত্যার পর রাহুল, পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর হত্যার পর বেনজির ভুট্টোসহ আরো অনেকে। কিন্তু স্বামী হত্যার পর সরাসরি স্ত্রীর রাজনৈতিক ময়দানে চলে আসার ঘটনা বিরল।
এমন এক অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে। ফলে বিভিন্ন এক্সপার্টের লিখে দেওয়া রাজনৈতিক ভাষ্যে যতই গণতন্ত্র, আধিপত্যবাদ ও গণমানুষের কথা বলুক না কেন কার্যত তিনি সেসব বোঝেন কি না সন্দেহ। তারই প্রমাণ পাই আমরা যখন তিনি একা হয়ে যান। একা অবস্থায় যখন তাকে বিবৃতি দিতে হয়। তখনই তিনি নিজে যা, যা তিনি জানেন, যা তিনি বিশ্বাস করেন তা বেরিয়ে আসে। তিনি যখন তার বাসায় দায়িত্বরত পুলিশকে রেগেমেগে গোপালি বলে গাল দেন, বলেন গোপালগঞ্জের নাম মুছে ফেলবেন তিনি। এটা কোনো রাজনীতিকের হিংসার প্রকাশ হতে পারে না। এটা নিতান্তই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের জন্য যুদ্ধ করা কোনো হিংসুক মানুষের কথা।
আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিবিদরা যদি শিক্ষিত না হন, প্রাপ্তমনস্ক না হন, খানিকটা দার্শনিকও না হন, তা হলে সেই জাতির কপালে যে ভয়াবহ দুঃখ লেখা আছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ শীর্ষ রাজনীতিকদের সিদ্ধান্তেই কিন্তু দেশ চলে। ক্ষমতাকালীন তাদের যেই ব্যক্তিক আচরণ তাই কিন্তু প্রবাহিত হয়ে যায় গোটা জাতির রক্তে। তাই প্রধানরা যদি কোনো ভুল করেন তাহলে সেই ভুল যে পুরো জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর কোনো শিক্ষিত মানুষ বিশেষ করে রাষ্ট্রপ্রধান লেভেলে কোনো আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হতে পারে না। যদি হয়েও থাকেন ইতিহাস তাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেই। কারণ একটি রাষ্ট্র সে দেশে প্রত্যেক মানুষেরই রাষ্ট্র। প্রত্যেক মানুষই সেই রাষ্ট্রের অধিবাসী। কিন্তু রাজনীতিপ্রধান যদি কোনে বিশেষ এলাকাকে চিহ্নিত করেন তার শত্রু হিসেবে, তা হলে বুঝতে হবে সেই জাতির কপালেই অনেক দুঃখ আছে। প্রাণী হিসেবে প্রথম ধাপেই তিনি বাস করেন, যাকে আমরা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ বলতে পারি।
(ঢাকাটাইমস/২৮ জানুয়ারি/জেএস/জেডএ.)