ঢাকা: দেশের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪৮ শতাংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজে অধ্যয়নরত রয়েছে। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্নাতকদের গুণগত মান মোটেই আশানুরূপ নয়। অধিভূক্ত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা উদ্বেগজনক বলে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, দেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে একমাত্র অ্যাফিলিয়েটিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব কোন শিক্ষার্থী না থাকলেও এর অধীনে ২ হাজার সাতটি অধিভূক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজে ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫০জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দুই হাজারেরও বেশি কলেজ সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একটি দূরূহ কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট বর্তমানে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেশনজট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করে স্ব-স্ব বিভাগের কলেজগুলোর শিক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব ওইসব কেন্দ্রের উপর অর্পণ করার উদ্যোগকে কমিশন স্বাগত জানিয়েছে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কলেজগুলোর একাডেমিক মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করে ইউজিসি। এক্ষেত্রে শিক্ষক এবং গবেষণা-সংক্রান্ত জনবল নিয়োগ করে কেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে স্বায়তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা যেতে পারে।
উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থায় ইউজিসির উদ্বেগের কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ কলেজে একাদশ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কারিকুলাম প্রণয়ন এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া বেসরকারি কলেজগুলোর গভর্নিংবডিতেও শিক্ষক নিয়োগের জন্য নির্বাচনী কমিটিতে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব থাকলেও এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগ, এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে পোস্টিং অর্থাৎ বদলী সংক্রান্ত কর্মকা-ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভূমিকা নেই। এরফলে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সুপারিশ: প্রতিবেদনে দেশের কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত স্নাতকোত্তর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে সেখানে কেবলমাত্র এম.এস ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত থাকবে। অন্য ছয়টি বিভাগীয় শহরে একটি করে স্বায়ত্বশাসিত স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো অধিভূক্ত করা।
যে সব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক উভয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলোকে পৃথক দুইটি কলেজে রূপান্তরিত করতে বলা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগীয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত কেবলমাত্র কয়েকটি নির্বাচিত কলেজে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত রাখা; মাস্টার্স পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা; এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করার পদ্ধতি প্রবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে। অধিভূক্ত কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব বিভাগীয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করে এ সকল শিক্ষকের চাকুরীর বিধিমালা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনুরূপ করার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচর্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দুই হাজারের অধিক অধিভূক্ত কলেজ পরিচালনা সম্ভব নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙ্গে সাতটি বিভাগে স্বতন্ত্র অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণি একত্রে চললে সেখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত সম্ভব নয়। অধিভূক্ত কলেজগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্ধ-শিক্ষিত করে রাখা হচ্ছে।
শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নত নীতি গ্রহণ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা প্রদানে শিক্ষক নিয়োগে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কোনো মডেল নয়, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এভাবেই চলছে। তিনি বলেন, কয়েকটি নির্বাচিত কলেজে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত রাখা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সায়ত্ত্বশাসন নেই। এটা পুরো মাত্রায় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়; যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাতব্বরি অনেক বেশি।
উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে অ্যাফিলিয়েটিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়গুলোর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে নিজস্ব আয় থেকে। তারা ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে ডিগ্রি প্রদান পর্যন্ত সব কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত হারে ফি আদায় করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, আয় ১২৮ কোটি ৩৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং ব্যয় ১২৩ কোটি ৪৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডের রয়েছে, ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ ফান্ড থেকেও প্রতি অর্থবছরে বিপুল আয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক ব্যয়ের চেয়ে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে কমিশন অনুন্নয়ন খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় না।
(ঢাকাটাইমস/২৭জানুয়ারি/এমএম)