ঢাকা: নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গত ২৭ নভেম্বর পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দেশের ৫৯০টি স্থানে সহিংসতার দায় স্বীকার করে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। এর কদিন পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলের এক জনসভায় জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ্ মোহাম্মদ তাহের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পণ্যবাহী গাড়িতে একের পর এক আগুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে বলেন, এটা নমুনা মাত্র। দাবি মানা না হলে সারাদেশে একই রকম সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া হবে।
আন্দোলনের সময় সহিংসতা করে এভাবে গর্ব করলেও এখন সেটিই কাল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটির জন্য। জোটে থেকেও বিএনপি এখন আন্দোলনের সময় সহিংসতার কোনো দায় নিচ্ছে না। অথচ জামায়াতের এই সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় তখন জোটের শরিক বিএনপি সায় ছিল শতভাগ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জামায়াত-শিবির কর্মীদের সর্বাত্মক সহযোগিতাও করেছে বিএনপির কর্মীরা। কিন্তু এ করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার পর সহিংসতার দায় জামায়াতের দিকে ঠেলে দিয়েছে বিএনপি। এই অবস্থায় জোটের ভেতরে বাইরে বিপাকে পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি।
আন্দোলনের নামে গত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে ১৮ দলের কর্মসূচিতে গাড়িতে আগুন দিয়ে ৩০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা, ৫০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হওয়া, পণ্যবাহী ট্রাক পুড়িয়ে দেয়া, বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার গাছ কেটে সড়কে অবরোধ দেয়া, সড়ক কেটে যান চলাচল ব্যহত করার ঘটনা কেবল দেশে না, সমালোচনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির দাবির প্রতি সহমর্মিতা জানালেও এই সন্ত্রাস নিয়ে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া বিব্রতকর হয়েছে বিএনপির জন্য।
পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ-আইডিএল নামে প্রকাশ্যে আসেন জামায়াত নেতারা। অসুস্থ মাকে দেখার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফেরেন গোলাম আযম। তবে ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও আর দেশ থেকে যাননি গোলাম আযম। বরং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম এই দোসর পেছন থেকে চালাতে থাকেন দল। এরশাদ সরকারের আমলে সারাদেশে বিস্তৃত হয় জামায়াতের কর্মকা-। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নাগরিকত্ব পান গোলাম আযম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি আন্দোলনে নামে তারাও।
এরপর ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা দলটির দুই আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ক্ষুব্ধ করে মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের।
তবে পাঁচ বছর কোনো কিছুই গায়ে মাখেনি জামায়াত। ২০০৭ সালে আবার যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি উঠলেও তাকে তেমন পাত্তা দেয়নি দলটি। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, দুই নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুস সুবহান, তিন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিচার শুরু করে। বিচার শুরু হয় দলটির গুরু গোলাম আযমেরও।
নেতাদের গ্রেপ্তারের পরও তাদের নিয়ে প্রথমে খুব একটা চিন্তা করেন জামায়াত। দলটির বিশ্বাস ছিল জোটে বিএনপির সমর্থন, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন যোগসাজসের কারণে সরকার এই বিচার চালিয়ে যেতে পারবে না। তাছাড়া আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নতি স্বীকার করিয়ে ১৮ দল নির্বাচনে যেতে পারলে ভোটে সুবিধা পাবে। আর ১৮ দল ক্ষমতায় ফিরলে নেতাদের বাঁচানো সহজ হবে।
কিন্তু সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর দলটিকে এক বিরাট ধাক্কা দেয়। এই রায় কার্যকরের আগে দলের কর্মীদের জামায়াত নেতারা বলতেন সরকার আসলে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু সে বিশ্বাস ভেঙে যায় কর্মীদের। ১২ ডিসেম্বর ফাঁসির পরদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়ে এর জবাব দেয় জামায়াত। কিন্তু সেটাও কাল হয়েছে দলটির জন্য। দেশে বিদেশে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে পরিচয় পেয়েছে দলটি।
ভোট ঠেকাতে সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতের নেতা-কর্মীরা একের পর এক হামলা চালিয়েছে। ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে তারা পুলিশের উপরও। কেবল সাতক্ষীরাতেই গত দুই মাসে ১৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে দলটি। কিন্তু এসব সন্ত্রাসের পর সরকার যৌথ বাহিনীর অভিযান চালিয়ে তাদের দমন করে। জামায়াত যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুললেও দলটির চালানো সন্ত্রাসের কারণেই এসব বক্তব্য প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে মনে করেন বিএনপিরই একাধিক নেতা।
এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতিরোধের মধ্যেও ৫ জানুয়ারির ভোট শেষে নতুন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ভোটের পর যশোর, দিনাজপুর, লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। তাদের হুমকির পরও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ায় এই হামলা চালানো হয়। এটাও হিতে বিপরীত হয়েছে জামায়াতের জন্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা প্রায় প্রতিটি শক্তিই এই ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুনানিতে স্পষ্টতই এই হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে।
এই অবস্থায় বিএনপির কর্মী-সমর্থক এমনকি নেতারাও এখন জামায়াতকে নিয়ে প্রকাশ্যে তাদের বিরক্তি জানাচ্ছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আমরা বাচি’। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও জামায়াত-শিবিরের প্রতি স্পষ্ট অসন্তোষ জানাচ্ছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়ার পেছনেও জামায়াতের অবস্থানকেই দায়ী করছেন বিএনপির কোনো কোনো নেতা। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াত নির্বাচনে যাওয়ার অযোগ্য ছিল। আর জামায়াত যেতে না পারায় বিএনপি সে নির্বাচন বর্জন করে বলে অভিযোগ করে আসছে সরকার। বিএনপির কোনো কোনো নেতাও এই কথাটি অবিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ জোটবদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বিএনপির নীতি নির্ধারণে জামায়াতের প্রভাব তারা কাছে থেকে দেখেছেন।
শুক্রবার ইউরোপিয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে নিয়ে তোলা এক প্রস্তাবে বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজত ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সহিংসতায় জড়িত দলকে নিষিদ্ধের কথাও বলা হয়েছে এতে। সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। এর আগে ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় এক বৈঠকে বিএনপিকে সহিংসতা ছাড়ার পরামর্শ দেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। এতগুলো ঘটনাকে আর অগ্রাহ্য করতে পারছে না বিএনপি। গত সোমবার ১৮ দলের বৈঠকে সহিংসতা ছাড়তে জামায়াতকে কড়া নির্দেশ দেন জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াতের সখ্য নতুন কিছু না। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে গোপন সমঝোতা করে নির্বাচন করে বিএনপি-জামায়াত। এর ফল পায় দুটি দলটি। জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে ভোটে সহযোগিতা করে জামায়াতের উল্লেখযোগ্য ভোট আছে এমন আসনে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করে বিএনপি। এর ফল পায় তারা নির্বাচনে। সব পূর্বানুমান মিথ্যা প্রমাণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসন না পাওয়ার পর জামায়াতের সমর্থনেই সরকার গঠন করে বিএনপি।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতে দুরত্ব হলেও ২০০১ সালে জোটবদ্ধ হয় দল দুটি। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে জোট করা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচিত হয়েছে বিএনপি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ভরাডুবির পর জামায়াতকেই দায়ী করে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এবারও নির্বাচনের পর বিএনপির তৃণমূলে জামায়াতকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, জামায়াতকে এই মুহূর্তে জোট থেকে বের করে দেয়া উচিৎ। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তান পার্লামেন্টের প্রস্তাব কেবল জামায়াত না, বিএনপির জন্যও বিব্রতকর হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য বিএনপি কি এখনই জামায়াত ছাড়বে কি না, সে প্রশ্নের জবাব সেই সাবেক এই সেনা প্রধানের কাছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের মিত্রতা কোনো স্থায়ী সম্পর্ক নয়। ইউরোপিয় ইউনিয়ন তাদের অবস্থানের কথা বলেছে। তবে আমরা আমাদের মতো করে জামায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
তবে বিএনপি নেতাদের এই প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ জামায়াত নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়া আমরা কিছুই করিনি। এখন চাপে পড়ে বিএনপি আমাদের ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা কোনোভাবেই আমরা মেনে নেবো না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের নেতা অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, এ সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতকে নিয়ে জোট করেছিল বিএনপি। তবে এখন বিভিন্নভাবে জামায়াতের কারণে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। এ থেকে উত্তরণ করতে হলে বিএনপিকে জোট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/২০জানুয়ারি/এএফ/জেডএ.)