logo ০৫ মে ২০২৫
আ.লীগ-জামায়াতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, সন্দেহ বিএনপির
কামাল শাহরিয়ার, ঢাকাটাইমস
১৮ জানুয়ারি, ২০১৪ ১২:৪১:৩১
image

ঢাকা: সহিংস আচরণের অভিযোগে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের কথা আওয়ামী লীগ বললেও  বিভিন্ন স্থানে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতার কারণে বিএনপিতে সন্দেহ বাড়ছে। বিএনপি জামায়াত ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ আবার জামায়াতকে কাছে টেনে নিবে কি না এই ভয়ও বিএনপিতে রয়েছে। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদেরকে বক্তব্যে এই সন্দেহ উঠে এসেছে।


বিএনপির মধ্যে  জামায়াত নিয়ে দুইটি ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিটি বলছে জামায়াতের গায়ে সহিংসতার  ট্যাগ লেগে গেছে, তাই জামায়াতকে ছেড়েই বিএনপির সামনে অগ্রসর হতে হবে। অন্যদিকে আরেকটি গ্রুপ বলছে, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতা পুরোনে। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ যে তাকে কাছে টেনে নিবে না এর কোনো গ্যারান্টি নেই। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হলে বিএনপির সমানে একমাত্র বাধা এখন জামায়াত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়লেই বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার।


সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সরকারের এ মনোভাব জানিয়ে দিয়েছেন। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজে বিবিসি এবং নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাতকারে জামায়াত ছাড়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তবে এর কয়েকদিন পর বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে কোনো কথা না বলায় বিএনপির মধ্যে জামায়াত ছাড়া নিয়ে দুই ধারার বিষয়টি আঁচ করা যাচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা স্পষ্টই বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বেশি ঘনিষ্ঠতা।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির বড় একটি অংশ জামায়াত ইসলামীকে জোট থেকে বের করে দেয়ার পক্ষে। এজন্য তারা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বারবার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তেই জামায়াতকে ছাড়তে চাচ্ছেন না বেগম জিয়া। বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে দিলেই আ.লীগ তাদেরকে (জামায়াত)জোটে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নামাবে- এমন আশঙ্কা করছেন খোদ খালেদা নিজেই। দলের শীর্ষ নেতা এবং ঘনিষ্ঠদের এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।


বিশেষ করে,পাঁচ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফের হাত ধরে আ.লীগে যোগ দেয় কুষ্টিয়া জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা। এরপর সাতক্ষীরায় জামায়াত নেতার বাড়িতে ভুড়িভোজে অংশ নেয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। সেখানে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আ.লীগ নেতারা কোলাকুলিও করেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র খবর প্রকাশ পেয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় জামায়াতের কর্মীদের জামিন করিয়েছেন মামলার বাদী যুবলীগ নেতা নিজেই। তিনি বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির হয়ে আসামিদের জামিনের জন্য সুপারিশ করে। তার সুপারিশেই আসামিদের জামিন দিয়েছেন আদালত।


এসব ঘটনার কারণেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির সন্দেহ প্রবল হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষমহল মনে করছে, তারা জামায়াতকে ছেড়ে দিলেই আবার তাদেরকে (জামায়াত) দলে ভেড়াবে আ.লীগ। সম্প্রতি জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিলে জোটনেত্রী তাদেরকে এ আশঙ্কার কথা জানান। একারণেই আপাতত জামায়াতকে জোট থেকে বের করতে চায় না বিএনপি।


গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ‘সংলাপ চাইলে জামায়াতকে ছাড়তে হবে’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন শর্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‌‘আ.লীগই সবসময় জামায়াতকে সাথে রেখেছে। আপনারা জানেন, ৮৬ সালের নির্বাচনে আমাদের সব দলের চুক্তি হয়েছিল কেউ নির্বাচনে যাবো না। কিন্তু আ.লীগ সেই চুক্তি ভঙ্গ করে জামায়াতকে সাথে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয়। এছাড়া এই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেটার জন্য জামায়াত-জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আন্দোলন করেছিল আ.লীগই। সেজন্য জামায়াতের সঙ্গে আ.লীগেরই ঘনিষ্ঠতা বেশি।’


অন্যদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারনী মহল মনে করছে, সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও তারা সে পদক্ষেপ নেবে না। জামায়াতকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ‘নিষিদ্ধ’ করার ভয় দেখানো হচ্ছে।  তাদের দাবি, সংলাপের জন্য জামায়াত বাধা হলে সরকারতো এ দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা তা করছে না। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ‘ঘায়েল’ করার জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে এমনটা করা হচ্ছে।


একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীমও একথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার তো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে না। তারা বিএনপিকে হেয় করার জন্যই অযথা এ প্রসঙ্গটি টেনে আনছে। সংলাপে জামায়াত কোনো বাঁধা হতে পারে না। এটা একটা অপকৌশল। এসব না করে জামায়াত নিষিদ্ধ করলেই তো পারে।’


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য উল্লেখ করে অসীম বলেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) নিজেই তো বলেছেন-‘জামায়াতকে তার দল কেনো নিষিদ্ধ করবে। এটা আদালতের বিষয়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে আরেকটি দলকে কিভাবে নিষিদ্ধ করি।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চায় না। কিন্তু বিএনপিকে দমাতেই এই ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসছে। সংলাপ করতে চাইলে জামায়াত কোনো প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না।’


প্রসঙ্গত, একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে জামায়াত। এরপর ৭২ সালে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ ফিরিয়ে দেন। সেসময় গোলাম আজম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর তার নেতৃত্বেই জামায়াত তাদের রাজনীতি শুরু করে অনেকটা বীরদর্পে।


জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের শাসনামলেও জামায়াত তাদের রাজনীতি চালিয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের এরশাদের প্রহসনের নির্বাচনে বিএনপিসহ সকাল রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়ার চুক্তি করলে জামায়াতকে নিয়ে ভোটে অংশ নেয় আ.লীগ। পরে ১৯৯১ সালের ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসে বিএনপি। তারা ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাতিল করে। সেসময়ে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবিতে জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ। এরপর ৯৬-র নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গে বেশ দহররম-মহররম দেখা যায় আওয়ামী লীগের।


একারণে সেবার ক্ষমতায় গিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আ.লীগ সরকার। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা দাবি জানানোর পরেো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি হাসিনা সরকার। কিন্তু এরকিছু দিনপরই ঘটে পালাবদল। জামায়াত জোটভুক্ত হয় বিএনপির। তাদের নিয়েই বিএনপি রূপ নেয় চারদলীয় জোটে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়েই লড়াই করে তারা। সেবার নির্বাচনে জেতার পর মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহীদকে মন্ত্রীত্ব দেয় বিএনপি সরকার। তাদের মন্ত্রীত্ব দেয়ার বেশ নিন্দিত হয়েছিল খালেদা জিয়া।


সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে না চাইলে শেষমেষ জামায়াতের কারণে অংশ নেয় দলটি। সে নির্বাচনে ভরাডুবি হয় চারদলীয় জোটের। নির্বাচনে হারার কারণ হিসেবে শুধু তৃণমূল নয় বিএনপির করা ১৪টি অনুসন্ধান টিম জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকাকেই দায়ী করে। একমিটিগুলো জামায়াত ছাড়ার জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু আন্দোলন কর্মসূচিতে বিএনপি পুরোপুরি জামায়াত-শিবির নির্ভর হয়ে পড়ায় গত পাচ বছরে সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিএনপি।


কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একযুগের বেশি সময় ধরে চলা জোটের অন্যতম শীর্ষ দল জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর জামায়াত বর্তমান সরকারের সঙ্গে একধরণের গোপন আতাঁত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির এমন সন্দেহ প্রমাণ হয়েছে গত ২৯ ডিসেম্বর। জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আহুত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে মাঠে নামেনি জামায়াত-শিবির। খালেদা অবরুদ্ধ থাকায়  তিনি পরের দিনো কর্মসূচি বহাল রাখেন কিন্তু সেদিন জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতাকর্মী মাঠে নামেনি।


এরপরই জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ আরো প্রবল হয় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারা এমনটাই মনে করছেন। তারা বলছেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামাতে আ.লীগের সাথে গোপন আতাত করেছে। এজন্যই তারা জোটের ডাকা কর্মসূচিতে মাঠে নামছে না। যদিও জামায়াত নেতারা বলছেন, ‌আন্দোলন-সংগ্রাম করবো আমারা। মারা যাবে আমাদের নেতাকর্মী। আর সুফল নেবে তারা (বিএনপি)। কিন্তু আমাদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখাবে না। তাহলে তাদের জন্য আমরা আন্দোলন করবো কেন?’


কিন্তু বিএনপি নেতারা দাবি করছে, জামায়াত তাদের জোটে থেকেই আ.লীগের সাথে যোগাযোগ রাখছে। তাদের দল যাতে নিষিদ্ধ না হয় সেজন্য আ.লীগের কাছে ধর্না দিচ্ছে। এজন্যই সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত এবং আ.লীগ একই টেবিলে বসা শুরু করছে। এমনকি কোলাকুলি এবং ভুরিভোজ করার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক শীর্ষ নেতা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‌‌‘জামায়াতের সঙ্গে আ.লীগের সম্পর্ক অনেক দিনের। বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্যই জামায়াত ইস্যুকে ব্যবহার করছে সরকার। সংলাপে বসার ক্ষেত্রে সরকার বারংবার জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিচ্ছে। সরকার বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্য এই অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে দিলেই আ.লীগ জামায়াতকে নিয়ে জোট বাধবে। আর এতে বিএনপি অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যাবে।’


(ঢাকাটাইমস/ ১৮ জানুয়ারি/ এসকে/এআর /ঘ.)