ঢাকা: ‘নির্বাচনে’ জয় পাওয়া গেছে, তাই শেখ হাসিনা এবং তার দল-আওয়ামী লীগ বেশ খুশি। তারও চেয়ে বেশি খুশি সেই সব দল এবং দলের নেতারা-যারা স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মতো এমপি পদটি পেয়ে গেছেন। একজন কপর্দকহীন ব্যক্তি লটারিতে কোটি টাকা পেয়ে গেলে তার অবস্থা কি হয়, তা দেখার সুযোগ কখনো পাইনি। তবে এসব আচমকা এমপিদের চোখমুখের ঔজ্জ্বল্য দেখে এখন কিছুটা ধারণা করতে পারি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে যাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো, তারা এখন কেবল সংসদ সদস্যই নন, মন্ত্রী হওয়ারও স্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ নিজেকে মনে করতে শুরু করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন হিসাবে। তারা যে এরকম কিছু একটা মনে করছেন, সেটা হাবভাবে প্রকাশও করছেন লাজলজ্জাহীনভাবে।
এই লটারি পাওয়া রাজনীতিকদের কাছে যদি সদ্য সমাপ্ত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, তারা হয়ত অনেক কিছু বলতে পারবেন। তারা যে বানিয়ে বানিয়ে বলবেন, তা কিন্তু নয়। হয়ত সত্যটাই বলবেন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্বাচনের কল্যাণে, নির্বাচনের রূপকার শেখ হাসিনার কল্যাণে, তারা আসলেই অনেক কিছু পেয়েছেন। ‘পেয়েছেন’ শব্দটা সম্ভবত ঠিক হলো না। বলা উচিতÑ পেয়েছেন, পাচ্ছেন এবং পেতে থাকবেন। কিন্তু কি পেল দেশের মানুষ?
মাঝেমধ্যে আমার কাছে শেখ হাসিনাকে দার্শনিক প্লেটোর মতো মনে হয়। বিশেষ করে গণতন্ত্রের বিষয়ে এই দু’জনের অসম্ভব মিল। প্লেটো গণতন্ত্রকে বিবেচনা করতেন ‘মূর্খের শাসন’ হিসাবে। তার মতে, অশিক্ষিত মানুষ, যার রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই নাই, সে কি করে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে-শাসনক্ষমতায় কার বসা উচিত আর কার অনুচিত? গণতন্ত্র সম্পর্কেই বা এই মূর্খ জনগণ কি বোঝে? প্লেটোর জন্ম যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ৪২৭ বছর আগে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীসের বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। তখন হয়ত ওই দর্শনটাই আধুনিক ছিল। তবে, এত বছর পর সেই একই দর্শনের প্রয়োগ যখন আমাদের এই ভূখ-ে দেখতে পাই, তখন আমরা আনন্দিত হব নাকি লজ্জিত হবÑ ঠিক বুঝতে পারি না।
আমরা এখন গণতন্ত্রকে নতুনভাবে শিখছি। নিয়ম হচ্ছে, একটা জাতীয় নির্বাচনে মোট আসনের ৫০ শতাংশের বেশি যেদিকে থাকবে, তারাই সরকার গঠন করবে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠের চরিত্রই আসলে সরকারের চরিত্র। মাত্রই যে নির্বাচন আমরা দেখলাম, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে জিততে হলে ভোটারদের কাছে যেতে হয়, নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, পরবর্তী পাঁচ বছর কি করবেন না করবেন তার অঙ্গীকার করতে হয়Ñ এসবই সাধারণ নিয়ম। দুনিয়ার সব দেশেই এরকম হয়ে থাকে। নির্বাচিত হওয়ার পর, ভোটার অর্থাৎ সাধারণ মানুষ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। জানতে চায়, আগের বার যাদেরকে ভোট দিয়েছিল, তারা কতটুকু কাজ করতে পেরেছে, তারা কতটুকু যোগ্য ছিল। পরীক্ষাটা হয় পাঁচ বছর পর পর। কিন্তু আমাদের এখানে এবার অর্ধেকের বেশির ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো পরীক্ষা হয়নি। তাদেরকে পরীক্ষায় বসতেই হয়নি। তারা এমনি এমনি লেটার মার্কস নিয়ে পাস করে গেছেন। আর বাকিদের জন্য যে পরীক্ষা ছিল, সেটা সম্পর্কেও যত কম আলোচনা হবে, ততই ভালো। কারণ, যত কিছুই হোক তারা এখন সাংবিধানিকভাবেই দেশের বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি।
তাই, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যকে দেশ শাসনের যোগ্যতা অর্জন করতে জনগণের মতামত নিতে হয়নি, তাই ধরেই নেয়া যায় জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। বরং, তাদের দায়বদ্ধতা থাকবে সেই মহামানবীর প্রতি, যিনি তাদের ভোটের বাজারের কপর্দকশূন্যদের ভোট ছাড়া অধিকর্তা বানিয়ে দিয়েছেন। একই কথা বলা যায়, নাটুকে নির্বাচনের মাধ্যমে যারা বৈতরণী পার হতে পেরে কিছুটা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছেন, তাদের জন্যও। আর শেখ হাসিনা কি চাচ্ছেন? তিনি গণতন্ত্রকে ‘মূর্খ মানুষ’র কবল থেকে বাইরে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। নিয়ে আসতে চাইছেনÑ ‘জ্ঞানী’ মানুষের কাছে। প্রমাণ করতে চাইছেনÑ তিনি যা বোঝেন, তিনি যা করেন, সেটাই গণতন্ত্র। তিনি যেটা অপছন্দ করেনÑ সেটা কেবল অগণতান্ত্রিকই নয়, একই সঙ্গে তা দেশদ্রোহিতা। আর এই দেশদ্রোহী ব্যক্তির বয়স যদি ৪৩ এর বেশি হয়, তাহলে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধী’ও হতে পারেন।
নির্বাচনের বলতে গেলে পরপরই, ১০ জানুয়ারি, আওয়ামী লীগ ঘটা করে পালন করল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, অথবা যারা সেখানে দেয়া শেখ হাসিনার ভাষণটি টেলিভিশনে দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আত্মবিশ্বাসের প্রবলতা। কেবল তার কথাতেই নয়, তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও ফুটে উঠেছে তার দৃঢ়তা, ঠিক যেন যুদ্ধ জয়ের অভিব্যক্তি। নির্বাচনে জয়কে যুদ্ধজয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতাটা যারা জানেন, তারা অবশ্য একে অন্যভাবে দেখতেই পারেন। তারপরও শেখ হাসিনার কথাবার্তায় প্রধান বিরোধী দলের নেতা (আইনি মারপ্যাঁচে তিনি ইতিমধ্যেই কি ‘সাবেক’ হয়ে গেছেন?) খালেদা জিয়া সম্পর্কে যে রকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ফুটে উঠছিল, সেটাকে কিন্তু তত বেশি অবাস্তব আর বলা যাচ্ছে না। মাস কয়েক আগেও যারা ভাবছিলেন, দেশজুড়ে বিএনপির পক্ষে গণজোয়ারের সব ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে, তাদের এখন নতুন করে হিসাব কষতে হচ্ছে। হঠাৎ করেই যেন দেশজুড়ে বিএনপি নেই হয়ে গেছে।
এই যে বিএনপিকে অদৃশ্য করে দিতে পারা, এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসাবে শেখ হাসিনা আত্মতৃপ্তি অনুভব করতেই পারেন। এমনকি যদি তিনি কিছুটা উল্লাসও করেন, তবুও সেটা আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে খুব একটা বিসদৃশ হবে না। যার কিছুটা প্রকাশ হয়ত ১০ জানুয়ারির জনসভায় দেখাও গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ এতেই কি সবকিছু পাওয়া হয়ে গেল? শেখ হাসিনা তো কেবল আওয়ামী লীগের সভাপতিই নন, কেবল তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যাই নন। একই সঙ্গে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেরও প্রধানমন্ত্রী, পরেরও প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ, সরকারকে এবং দেশকে তারই চালাতে হবে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিভাবে চালাবেন তিনি?
যে বিএনপিকে দুর্বল হিসাবে প্রমাণ করতে পেরে তিনি আত্মতৃপ্তি অনুভব করছেন, সেই বিএনপির কারণেই কি গত দু’মাস ধরে দেশে একটা অচলাবস্থা বিরাজ করছে না? বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একের পর এক খোঁড়া অজুহাতে জেলে ঢুকালেও হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার জন্য কেউ না কেউ কি থেকেই যাচ্ছে না? ভিডিও বার্তাকে ‘লাদেন স্টাইল’ বলে অবজ্ঞা করলেও, এর মাধ্যমেই কি আন্তঃজেলায় যান পরিবহন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না? বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনিÑ একথা বলে উল্লাস প্রকাশ করলেও, এটাই কি বাস্তবতা নয় যে, ঠিক এ কারণেই নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির সংখ্যা ছিল রীতিমতো লজ্জাজনক?
একথা মনে করার কোনোই কারণ নেই যে, হতোদ্যম হয়ে বিএনপি, জামায়াত এখন হাল ছেড়ে দেবে। তাদেরও অস্তিত্বের প্রশ্ন। অবরোধ, হরতালের মধ্যেও এখন ঢাকা শহরে মাঝেমধ্যে রীতিমতো যানজট দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখে সরকার পক্ষের আমোদিত হওয়ার খুব বেশি একটা সুযোগ আছে বলে মনে করি না। দেশের সিংহভাগ র্যাব পুলিশকে রাজধানীতে এনে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসিয়ে দিয়ে, সাময়িক সময়ের জন্য এক ধরনের নিরাপদ আবহ তৈরি করা যায়। কিন্তু একে স্থায়ী রূপ দেয়া কঠিন। আবার একইভাবে রাজধানীর বাইরের জেলা, উপজেলাগুলোকে অরক্ষিত রেখে পণ্য পরিবহনকে স্বাভাবিক করার প্রত্যাশাও যে নিতান্ত অবাস্তবÑ সেটাও বুঝতে কষ্ট হয় না। রফতানিপণ্য বন্দরে পাঠাতে না পেরে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে রয়েছেন যারা, হাজার অনুরোধ করলেও এই অনিশ্চয়তার মধ্যে রাস্তায় তারা মালামাল ভর্তি কন্টেইনার নামাবেন বলে মনে হয় না। এভাবে স্থবির অর্থনীতির মধ্যে কতদিন চলতে পারবে দেশ?
মাস দু’য়েক আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন গতি পাচ্ছিল, তখন সময় ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক পরীক্ষার। মানুষের মধ্যে তখন দেখা গেছে হতাশা আর হাহাকার। উপায়ন্তর না দেখে এ সময় ছুটির দিনগুলোতে অনেক জায়গায় পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা নেয়া আর নিয়মিত ক্লাস হওয়া কিন্তু এক বিষয় নয়। বছর শুরু হয়ে গেছে, নতুন বছরে নতুন ক্লাসে যদি ছাত্র-ছাত্রীরা না যেতে পারে, সেটাকে সরকারের প্রচারণা অনুযায়ী সবাই বিরোধী দলের দায় হিসাবেই বিবেচনা করবেÑ এমন আশা করাও ঠিক হবে না। শেষ বিচারে দায় কিন্তু সরকারের ওপরেই বর্তাবে।
শঙ্কা দেখা দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিয়েও। অর্থনৈতিক কর্মকা- যদি স্থবির হয়ে যায়, মানুষের আয় কমে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে সঙ্কটে পড়ে গেছে। যারা মাসের এক তারিখে বেতন দিতেন, তারা সেটাকে মাসের দ্বিতীয় তৃতীয় সপ্তাহে নিয়ে গেছেন। অনিয়মিতদের অবস্থা অনিশ্চয়তায় পৌঁছে গেছে। রফতানি বন্ধ হওয়ায় অনেক গার্মেন্টসেই হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। মাস শেষে যে লোকগুলো ৫-৬ হাজার টাকা বেতন পেত, তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেলেও ক্ষুধা তো আর থেমে থাকবে না। আর আমাদের শ্রম জগতে এদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। এরা একবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে, সেই ক্ষোভের আগুন কিন্তু সবার গায়েই লাগবে। তখন ‘আমি না, ও দায়ী’Ñ এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন ঘরে থাকা কোরান শরিফও কিন্তু পুড়ে যায়।
নতুন সরকারই বা কতটুকু কি করতে পারবে? সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনাই বা কতটুকু গুরুত্ব পাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা জনগণের কাছে? গায়ের জোরে আর যা-ই হোক, দেশ যে চালানো যায় না, তা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। অতি তৈলবাজ কেউ কেউ হয়ত ভাবতে পারেনÑ না, এবার ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, ইতিহাসের নর্দমাতেই জায়গা হয় এদের।
সম্ভবত, বিষয়গুলো সরকারি দলের নেতারাও বুঝতে পেরে থাকবেন। আর সে কারণেই, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বলছেন তারা একাদশ সংসদের কথা। বলছেন, সমস্যা নিরসনে আলোচনার কথা। আমরা প্রত্যাশা করি, এবার আলোচনা হবে। আপসহীন নেত্রীর গোয়ার্তুমি এবার কিছুটা কমবে। অথবা বিপরীত দিকে, কমবে সরকারি দলের অহংবোধ। আলোচনায় বসতে পূর্বশর্ত আরোপ করবেন না কেউই। আলোচনায় বসে ঠিক করে নেবেন শর্তগুলো। আলোচনায় বসবেন ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে। সর্বোপরি আলোচনায় বসার আগে, মনে থাকবে জনকল্যাণের বিষয়টি।
দেশ এখন পেছন দিকে চলছে। এই ব্যাকগিয়ারে চলা থামাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজ বাঁচাতে, সমাজের মানুষ বাঁচাতে বর্তমান অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। আর এ জন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আর সেটা যত দ্রুত হবে, ততই দেশের মঙ্গল। নয়ত যে ব্যাকগিয়ারে চলছে দেশ, তার বেগই কেবল বাড়বে।
ইমেইল: [email protected]
এই সময়ের সৌজন্যে