ঢাকা: এক যুগেরও বেশি সময় এক হয়ে থাকার পর খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়ার ইঙ্গিত দিলেন কি-না, সে প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোট করার পরের দুটি নির্বাচনে বিএনপির সিদ্ধান্তকে অনেকটাই প্রভাবিত করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর দলটি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশ ক’টি বিদেশি পত্রিকায় দেখা সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, জাতায়াতের সঙ্গে তাদের জোট চিরস্থায়ী নয়, এটা কৌশলগত। এই জোট কবে ভাঙবে তা সময়মতো জানানো হবে বলেও জানান খালেদা জিয়া।
নজিরবিহীন সহিংসতার পরও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে এবং নতুন সরকারও গঠন হয়েছে। বিরোধী জোট এই অবস্থায়ও অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দু’পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অবশ্য বলেছেন, তিনি এখনও সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চান। আর সরকার বলছে, আলোচনায় তাদের আপত্তি নেই। তবে এ জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে।
বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার দাবি অবশ্য আওয়ামী লীগের নতুন নয়। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর থেকেই এই দাবি তোলে আওয়ামী লীগ। জামায়াতের চাপেই বিএনপি উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে বলেই মনে করে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের এই দাবি এতদিন গুরুত্ব না দিলেও এখন না ভেবে পারছে না। এরই মধ্যে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকলে আর না থাকলে লাভ-লোকসান নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছেন বিএনপি নেতারা।
৫ জানুয়ারি ভোটের দিনও বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, বিএনপি কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না রাখবে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্দেশনা দিতে পারে না। বিএনপি স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেবেÑ এটা স্পষ্টতই জানিয়ে দেন খালেদা জিয়া।
ভোটের পর অন্য দুটি বিদেশি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া তার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসেন। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট স্থায়ী নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এ পত্রিকার দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার যে শর্ত দিয়েছিলেন, সে বিষয়টি বিএনপি বিবেচনা করতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিএনপি কবে জামায়াত ছাড়বেÑ নিউইয়র্ক টাইমসের এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘যখন সময় আসবে, তখন দেখা যাবে’। ভয়েজ অব আমেরিকাকে দেয়া আরেক সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আঁতাত কৌশলগত।
খালেদা জিয়া কি তবে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের আগাম ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন? Ñজানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুব রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ম্যাডাম জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে যে কথা বলেছেন, তা আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট চালিয়ে যাওয়া খুব একটা সুবিধার না আমাদের জন্য’।
বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে কেবল বাংলাদেশ না, কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও। স্বাধীনতা বিরোধিতা ছাড়াও জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও আছে। এসব নিয়েও বিএনপিকে চাপে থাকতে হয়েছে গত কয়েক বছরে। এসব বিবেচনাও আছে বিএনপি নেতা এবং বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে।
জামায়াত এখন বিএনপির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কি-না, জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রস্তাব পাসের পর প্রমাণ হয়েছে জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা আছে। সময় এলে তাদেরকে গুডবাই বলে দেয়া উচিত। কারণ তাদের আদর্শ আর আমাদের আদর্শ এক না’।
জামায়াতের সঙ্গে জোট করে বিএনপির লাভ লোকসানের হিসাব করাটা অবশ্য সহজ নয়। জামায়াতের ভোট এখন দেশে পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। জোটে থাকলে এই ভোট বিএনপির বাক্সে যায়। কিন্তু জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের কারণে বিএনপির ভাবমূর্তি সঙ্কটও আছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা করে বিএনপি। বেশ কিছু আসনে জামায়াতকে সহযোগিতার বিপরীতে জামায়াতের ভোট আছে, এমন আসনগুলোতে জামায়াতের সমর্থন নিশ্চিত করে বিএনপি। এই গোপন সমঝোতার ফল পেয়েছিল দুটি দলই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে বিএনপি। ১৮টি আসনের পাশাপাশি ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে তাক লাগিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হয়ে অস্ত্র ধরা দলটি। বিএনপি নির্বাচনে জিতলেও প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসন না পাওয়ায় জামায়াতের সমর্থন পেয়েই সরকার গঠন করে বিএনপি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান ১৯৯১ সালের নির্বাচন নিয়ে লেখা এক বইয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন।
২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট করেই নির্বাচন যায় বিএনপি। স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে এই জোট গঠন নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনায় পড়লেও বিএনপির ক্ষমতায় ফিরতে তা কার্যকর প্রমাণ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়েই ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট। কিন্ত ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য আবার জামায়াতকে দায়ী করে বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। নির্বাচনে হারার পর ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির বেশিরভাগের প্রতিবেদনেই এই কারণটি উল্লেখপূর্বক জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের সুপারিশ করা হয়েছিল।
আন্দোলনে জামায়াতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা বিএনপির জন্য কাল হয়েছে বলে মনে করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ। এই মতকে সত্য মনে করেন কি না, জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপির তরুণ যে নেতৃত্ব তারা মাঠে সক্রিয় না বলে আন্দোলন গতি পাচ্ছে না। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে গেছে। এই অবস্থায় তারা কিছু করতে পারছে না।’
গত ২৫ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণনা শুরুর আগে থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার ঘোষিত কর্মসূচি সফল করতে বিএনপি নেতাকর্মীরা যত না ছিল তারচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল জামায়াতের নেতাকর্মীরা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের সহিংস আন্দোলন নিয়ে সমালোচনা হয়েছে দেশজুড়ে।
তবে এই আন্দোলন চলাকালে ভোটের আগে আগে হঠাৎ দুই দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। ১৮ দল নেতা খালেদা জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকামুখী অভিযাত্রা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেস’ কর্মসূচি নিলেও কর্মসূচিকে ঘিরে তেমন কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি জামায়াত কর্মীদের মধ্যে। বরং বিএনপির কর্মীরা রাস্তায় না নামলে জামায়াতও নামবে নাÑ দলের এমন অবস্থানের কথা গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেন জামায়াত নেতারা। আর সেদিন ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে না পারার পর খালেদা জিয়া পরদিন কর্মসূচি পালনের ডাক দিলেও দেশের কোথাও জামায়াত কর্মীরা বলতে গেলে কিছুই করেনি। ৫ জানুয়ারি ভোট ঠেকাতেÑ ভোটের আগে পরেও বিএনপি এবং জামায়াতের একজোট চেষ্টা চোখে পড়েনি। মূলত জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায়ই হয়েছে সহিংসতা।
আবার জামায়াতের সহিংসতা ঠেকাতে নীলফামারী আর গাইবান্ধায় একজোট হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি।
আওয়ামী লীগের অভিযোগ, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত অংশ নিতে না পারার কারণেই বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। বিএনপি নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও নানা সময় বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণে জামায়াতের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষে ছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু জামায়াতের জামায়াত সে সময় বিএনপিকে বারবার নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক বৈঠকে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে একহাত নেনও খালেদা জিয়া। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে একাট্টা অবস্থান নেয় জামায়াত। নির্বাচনের আগে দলটির মজলিসে শুরার এক বৈঠকে বিএনপি না এলেও ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। পরে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। সে নির্বাচনে ভরাডুবির পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ ছিল।
২০০১ সালে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় খালেদা জিয়া, গোলাম আযম, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আজিজুল হক (ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান) এক মঞ্চে উঠে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর একযুগে ঘটেছে নানা ঘটনা। জোট গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই চারদলীয় ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে যান এরশাদ। তবে এরশাদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি নামে দল করে ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে যায় জাতীয় পার্টির একাংশ। এরপর জোট থেকে সরে যান আজিজুল হকও। তবে ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙে একাংশ নিয়ে জোটে থেকে যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী।
(ঢাকাটাইমস/ ১৪ জানুয়ারি/ এআর/ ঘ.)