ঢাকা: সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করতে সরকারের অনুমতি লাগবেÑ এমন বিধান রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের সময় এর বিরোধিতা করেছিল বিভিন্ন সংস্থা। বিরোধিতা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকও। তাদের আশঙ্কা ছিল এমন বিধান থাকলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিকার করা কঠিন হবে।
এই বিধানটা করার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনও বলেছিল এসব বিধান সংবিধানের বিরোধী। হাইকোর্টও ৩০ জানুয়ারি দুদক আইনের সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে জানিয়েছে, কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করতে কোনো অনুমতির দরকার নেই। গত ১০ নভেম্বর সংসদে দুদক আইনের সংশোধনী পাসের দুই মাসের মধ্যেই এর কুফল টের পায় দুদক। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শেষ করেছে কমিশন। কিন্তু আদালতে অভিযোগপত্র দিতে পারছে না সংস্থাটি। কারণ, সরকারের কোন দফতর থেকে অনুমতি নিতে হবে, তা জানা ছিল না দুদকের। তবে হাইকোর্ট দুদক আইনের সংশোধনী বাতিল করায় এখন আর এই অভিযোগপত্র জমা দিতে কোনো সমস্যা হবে না দুদকের। দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান এই সময়কে জানান, কমিশনের বৈঠকে ওই সব অভিযোগপত্র অনুমোদন দিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। বড় বড় সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রতিকার অবশ্য হয়েছে খুব কম। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত মামলা করা যেত না সরকারি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে ব্যুরো ভেঙে ২০০৪ সালে কমিশন গঠন করার পর এই বিধান তুলে দেয়া হয়। তবে এই বিধানের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি কমে যায়। নানাক্ষেত্রে হয়রানির আশঙ্কায় সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্প ঝুলে যায়। এ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের চাপের মুখে আইন সংশোধন করে সরকার।
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ ক’জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা আছে। এগুলোর তদন্ত চলছে। অনুসন্ধান পর্যায়েও আছে বেশ কিছু অভিযোগ। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসব তদন্ত প্রক্রিয়া অনেকটা গতিহীন হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে ১৭টি মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুদক। এসব মামলায় আসামি আছেন ৪৬ জন। এদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী আছেন ১৫ জন।
যোগাযোগ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইনের সংশোধনী আনায় দুদক যে দুর্বল হবে সেটা আমরা আগেই বলেছিলাম। এমন বিধান থাকলে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করতে পারেন যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সরকার তাদের রক্ষা করবে। বরং এমন আইনের কারণে দুর্নীতি বেড়ে যেতে পারে। এতে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ বেড়ে যেতে পারে এবং তাতে প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আরও বাড়তে পারে।
ইফতেখারুজ্জামানের এই আশঙ্কার সঙ্গে দ্বিমত নেই দুর্নীতি দমন কমিশনেরও। সংসদে দুদক আইনের সংশোধনী পাসের পর দুদক চেয়ারম্যান প্রকাশ্যেই তার হতাশার কথা জানিয়েছিলেন। এই আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মনে করেন তিনি। সংশোধনীটি বাতিল করতে সরকারকে অনুরোধও করেছে দুদক। তবে সরকার বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশন কোনোভাবে দুর্বল হবে না। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প সময়মতো এগিয়ে নিতেই এমন বিধান করা হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মকর্তা যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন সে চিন্তা থেকেই দুদক আইনের সংশোধনীতে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৩ সালে দুদকের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ আসে ১০ হাজার ৩৪টি। এর মধ্যে এক হাজার ২১৩টি যাচাই বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। প্রাথমিক তদন্তের পর ৩১১টি অভিযোগের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় দুদক। গত এক বছরে ৩৫০টি মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুদক। এই সময়ের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় ৫১৭টি। ২০১৩ সালে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১৭৭টি। এতে সাজা হয়েছে ৭৫টি।
(ঢাকাটাইমস/০৪ফেব্রুয়ারি/এমবি/ এআর/ ঘ.)