logo ০৪ মে ২০২৫
এবার জামায়াতের বিচারের পালা
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০৯:৩২
image


ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে গত ১২ ডিসেম্বর। আরেক নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলা আপিল বিভাগে আছে শেষ পর্যায়। দুই নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানেরও ফাঁসির রায় হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আরও চার নেতার বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে। এ অবস্থায় দল চালানোই কঠিন হয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতের।

এখানেই শেষ হচ্ছে না জামায়াতের। নেতাদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন দুষ্কর্মের জন্য বিচার শুরু হচ্ছে দলটির। এরই মধ্যে তদন্ত প্রায় শেষ করে এনেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। মার্চের মধ্যেই এই প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার আশা করছে তারা। আর মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন পর্যন্ত যে কয়টি মামলার রায় হয়েছে তার সব ক’টিতেই জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছে ট্রাইব্যুনাল। আর ট্রাইব্যুনালে পর্যবেক্ষণের পর আপিল বিভাগে জামায়াত নিষিদ্ধ চেয়ে আপিল করেছে সরকার। এ অবস্থায় জামায়াতের বিচার শুরু নিয়ে উদ্বিগ্ন দলটির নেতাকর্মীরা। সন্ত্রাসের দায়ে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার ইতিহাস অবশ্য নতুন না। পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরিতে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছিল একদফা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা শুরু করলেও জামায়াত ইসলামী নিজ দেশের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পক্ষ নেয় দখলদারদের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে রেডিওতে ভাষণ দেয় সেই সময়ের জামায়াতের আমির গোলাম আযম। এরপর সমমনা দলগুলো ও জামায়াতকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এক বৈঠক করে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা করে। মুক্তিবাহিনীকে সায়েস্তা করতে গঠন করে রাজাকার আলবদর বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠে জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন এই আলবদর বাহিনীর সদস্য।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি হত্যায় সহযোগিতার দায়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা হয় দলটিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ (্আইডল) নামে সক্রিয় হয় জামায়াত। তবে নিজ নামেই আত্মপ্রকাশ করে দলটি।

দল হিসেবে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে গত ১৮ আগস্ট। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও একইভাবে মামলা হবে। তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাবে রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিলেই শুরু হবে বিচার।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধÑ এই চারটি দিককে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে সংস্থাটি একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উদঘাটনের জন্য সেই সময়কার পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তক সংগ্রহ করে পড়ছে। এছাড়া জামায়াত নেতাদের লেখা বই পুস্তুকও পড়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এছাড়া দেশ-বিদেশে যেখানেই জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে তথ্য রয়েছে সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। জামায়াত সম্পর্কে জানেন এমন লোকদের সাক্ষ্যও নিচ্ছে তদন্ত সংস্থা।

জানতে চাইলে  তদন্ত সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা আবদুল হান্নান খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘১৯৫১ সালে পাকিস্তানে আহমদিয়া সম্প্রদায় বিরোধী দাঙ্গা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ৮৯ পর্যন্ত নানা ঘটনা উঠে আসবে এই তদন্তে। বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদির দর্শন ও আদর্শ।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, জামায়াতে ইসলামী একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’। সংগঠনটির রাজনীতি প্রতারণাপূর্ণ। এখনও বাংলাদেশে জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা। এখনও দলটি তাদের স্বাধীনতাবিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি। এখনও তারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত। সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো ব্যক্তিকে না বসানো এবং সরকারি পদ থেকে ওইসব ব্যক্তিদের সরিয়ে দেয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করে ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল আরও বলে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের নেতারা ছিল নৃশংস ও বীভৎস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াত পাকিস্তানি সেনাদের সহায়ক বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। জামায়াতের সদস্যরাই রাজাকার, আলবদর, আলশামস, আল মুজাহিদ বাহিনী ও শান্তি কমিটির মতো সশস্ত্র আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর উন্মত্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জামায়াতের কারণে তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করে ট্রাইব্যুনাল। এই সক্রিয় স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনও পরিবর্তন করেনি। এ ব্যাপারে তারা কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেছে বলে জাতির কাছে কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং এই অপরাধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার, ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকতে পারে কি না, এটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিবেচনা করতে হবে। একটি অপরাধী সংগঠনকে যদি রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়, তা হলে বাংলাদেশের অখ-তা হুমকির সম্মুখীন হবে, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা আগে ব্যক্তিদের বিচার করছি। এরপর দলের বিচার করা হবে। আশা করা যাচ্ছে সব ঠিক থাকলে আগামী মার্চ মাস থেকে জামায়াত-শিবিরের বিচারকাজ শুরু করা যাবে। পরবর্তী সময়ে পাক হানাদার বাহিনী যারা আমাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের বিচারের কাজ হাতে নেয়া হবে। সে লক্ষ্যে আমরা তদন্ত শুরু করেছি।’

১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী।

গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে গত ১৮ ফেব্রুযারি সংবিধান সংশোধন করে ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনে সরকার। এ সময় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন বা দলের বিচারের বিধান জুড়ে দেয়া হয়। এর আগে যে বিধান ছিল সে অনুযায়ী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার সুযোগ ছিল না। গত ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ফলে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগও বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। বিষয়টি বর্তমানে আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত রয়েছে।  

বাংলাদেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল ১৯৭১ সালে নয়। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ জোটের আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস হয়েছে। ভোট ঠেকাতে যাত্রীবোঝাই যানবাহনে আগুন, সরকারি সম্পত্তিতে হামলা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব হামলার ঘটনায় জামায়াতকে দায়ী করেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা। আর এসব সহিংসতার জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং দাতা দেশগুলো।

আর আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের দায় অস্বীকার করেনি জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। বরং গত ২৭ নভেম্বর এক বিবৃতিতে দেশের ৫৯০টি জায়গায় সহিংসতার কথা জানায় ছাত্র শিবির। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকু-ে একের পর এক গাড়িতে আগুন দেয়ার দায় স্বীকার করেছেন জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।  ২২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে তিনি বলেন সীতাকু-ের ঘটনা নমুনা মাত্র। তাদের দাবি না মানলে তাদের এই আগুন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে।

জামায়াতের সন্ত্রাসের  কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত বিএনপির সহ-সভাপতি শাজাহান ওমর প্রকাশ্যে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আমরা বাঁচি।’ এর আগে তিনটি বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট চিরস্থায়ী নয়। এই জোট কবে ভাঙবে তা সময় আসলেই জানা যাবে।’

অবশ্য ভোটের রাজনীতির কারণে নানামুখী চাপ থাকা সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বরং উপজেলা নির্বাচনে জোটগতভাবেই আওয়ামী লীগকে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত। খালেদা জিয়া বলেছেন, তারা কার সঙ্গে জোট করবেন এটা তাদের একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত। অন্য কোনো দল বা কারো কথায় কান দেবেন না তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১১ ফেব্রুয়ারি/ এইচএফ/ এআর/ ঘ.)