logo ০৪ মে ২০২৫
উচ্চশিক্ষায় এ কী হাল!
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০৭:৫৯
image


ঢাকা: বাংলাদেশে ছাত্রের অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা কম প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতায় সময়মতো পরীক্ষা নেয়াও অনেক সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় নতুন একটি পরিসংখ্যান ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি)। দেশের ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০ হাজার ৭৪৪ জন শিক্ষক থাকলেও তাদের মধ্যে কর্মরত আছেন কেবল সাড়ে ছয় হাজার। এ অবস্থায় উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ইউজিসি।

ইউজিসির হিসাবে, ৫১০ জন শিক্ষক কোথায় আছের কেউ জানে না। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দুই হাজার ২০০ জন আছেন নানা ধরনের ছুটিতে। দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষক আছেন শিক্ষা ছুটিতে। এ ছাড়া আরো তিন হাজারের বেশি শিক্ষক দেশের ভেতরে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন চাকরি করছেন। এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন কাজ করছেন আরো সহস্রাধিক শিক্ষক। এর বাইরে ১৭৭ জন প্রেষণে বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

শিক্ষকদের জন খ-কালীন কাজ বেআইনি না হলেও এ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাজ করা, আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা না দেয়ার অভিযোগ পুরনো। কিন্তু কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় কারো বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।

শিক্ষকদের এই ছুটির প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউজিসি। শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন এবং সার্বিক আচরণের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা করছে তারা। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে সুপারিশমালাও পাঠিয়েছে ইউজিসি।

ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এ কে আজাদ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সাধারণত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যোগ্যতা অত্যন্ত উঁচুমানের হয়ে থাকে। বেশির ভাগ শিক্ষকই নিষ্ঠাবান এবং তাদের অবদান জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগও রয়েছে।’ তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে তাদের কাছে জাতি যা প্রত্যাশা করে তা থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকার প্রত্যাশা তিনিও করেন। ইউজিসির প্রতিবেদন সংসদে চলতি অধিবেশনে উঠবে বলেও আশা করেন এ কে আজাদ চৌধুরী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষকদের ছুটির বিষয় নিয়ে ইউজিসি উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, শিক্ষকরা জাতির মেরুদ-। তাদের আইন দিয়ে নিবৃত রাখা সম্ভব নয়। নৈতিক দিক থেকেই তাদের শক্তিশালী হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ইউজিসির প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়ম

ইউজিসি বলছে, শিক্ষকদের একটি বড় অংশ নিয়মিত ক্লাস নেন না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগেভাগে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেন না তারা। ব্যবহারিক ক্লাসেও নিয়মিত অনুপস্থিত থাকেন তারা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম এবং শিক্ষকের অফিস কক্ষ দুপুরের পর তালাবদ্ধ থাকে। শিক্ষকের সময়মতো পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ না করা এবং তার কারণে ফল প্রকাশে দেরি হয়।

শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের সবচেয়ে বড় অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন চাকরি নিয়ে। শিক্ষকদের একটি অংশ মূল চাকরির চেয়ে খ-কালীন চাকরিতে বেশি সময় দেন বলে অভিযোগ আছে। আর বেআইনিভাবে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিযোগও আছে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

ইউজিসি বলছে, বছরে ৫২ সপ্তাহের মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ সপ্তাহ ক্লাস হয়ে থাকে। বাকি সময় থাকে ছুটি। আর গবেষণা, প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা ইত্যাদি কাজের জন্য কত সময় একজন শিক্ষককে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে- এ সম্পর্কে কোনো বিধান নেই। যে কারণে শিক্ষকরা এই সুযোগ নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। এর বাইরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত সময় দিতে পারেন সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছেন কোনো কোনো শিক্ষক।

বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, তাদের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের মূল ভরসা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়িত হন। তাই বেশি টাকা দিয়েও অনেক সময় কাক্সিক্ষত সেবা পান না তারাও।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির সহসভাপতি আবুল কাসেম হায়দার জানান, ‘এমনিতেই শিক্ষকদের সংকট আগে থেকেই ছিল। এখন আবার নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হচ্ছে। তাই শিক্ষকদের চাহিদা বেড়েছে বেশি। কোনো কোনো শিক্ষক তাদের মানের কথা চিন্তা না করে টাকা কামানোকেই মূল হিসেবে দেখছেন। এতে আমরা যেমন সমস্যা আছি তেমনি শিক্ষকদের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি হচ্ছে।’

ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা, অননুমোদিত ছুটি ও অনুপস্থিতির ঘটনা নতুন নয়। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছানোর কারণে কয়েক বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা ছুটিসহ অন্যান্য ছুটিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, কোনো বিভাগের সর্বাধিক ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষক ছুটিতে যেতে পারবেন না। কিন্তু সরকারের এই আদেশের বিরোধিতায় নামে শিক্ষক সমিতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান চান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষকরা সাধারণত নিয়ম মেনেই ছুটি বা অন্যত্র কাজ করে থাকে। তবে কিছুসংখ্যক শিক্ষক আছেন যারা নিয়ম ভঙ্গ করেন। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। সে জন্য নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করার কিছু নেই।’

অনিয়মে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অন্যতম কারণ ভোটের রাজনীতি। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে দলে টানার কৌশলের কারণেই সব জেনেও কিছুই বলে না দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। ২০০৯ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের খাতা দেখার অবহেলা দূর করার লক্ষ্যে তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ উদ্যোগ নিলে প্রশাসনেরই অন্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অসহযোগিতা পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, এভাবেই একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন দিন স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারি প্রজ্ঞাপনও কাজে আসছে না।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের প্রকৌশল শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষা কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষক স্বল্পতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪৪ জন শিক্ষক থাকলেও কর্মরত আছেন ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ করেন খ-কালীন চাকরি। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী বুয়েট ছাড়াও দেশের অন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালগুলো ভুগছে শিক্ষক স্বল্পতায়।

আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টি শিক্ষকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে কর্মরত মাত্র ৩৬ জন। ১৯ জনের হদিস নেই। আরো একজন আছেন প্রেষণে অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ইউজিসির ওই রিপোর্টে দেখা যায়, এভাবে জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটের শাহজালাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছুটির হার বেশি। ছুটির মিছিলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা দীর্ঘ।

শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষাকে সব সময় উৎসাহিত করা হয়। এ জন্য সরকার বিশেষ বরাদ্দও দিয়ে আসছে। বিদেশে গমনকারী শিক্ষকরা বৈতনিক, অবৈতনিকসহ বিভিন্নভাবে সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। পাওনা ছুটির বাইরে কেউ ছুটি ভোগ করলে আইন অনুযায়ী তাকে সমপরিমাণ সময় চাকরি করার পর অব্যাহতি নিতে হবে। এ সময় গৃহীত সমুদয় অর্থও তাকে ফেরত দিতে হবে। যেহেতু নিয়মানুযায়ী শিক্ষকরা সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত শিক্ষা ছুটি নিতে পারেন এবং এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বেতন-ভাতা সবই পরিশোধ করে, তাই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা আইনের এই ফাঁককে কাজে লাগিয়ে ছুটিতে গিয়ে অনেকে বাইরে আয়-উপার্জন করে আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও টাকা উত্তোলন করেন। এরপর বিদেশে গমনকারীদের অনেকে স্থায়ীভাবে আবাস গেঁড়ে থাকেন সেখানে।

কিন্তু এই সুযোগে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সময়মতো দেশে ফেরেন না। আর তাদের দেরি হওয়ার বিষয়টি জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেন না কেউ কেউ।

জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা অধিকতর ডিগ্রি অর্জনে উৎসাহ দেয় ইউজিসি। কিন্তু অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে তাগিদ দেয়া হয়। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে অনেকেই পার পেয়ে যান। অনেকেই আবার বিদেশে গেলে আসতে চান না। সব মিলিয়ে বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। সেগুলো বাস্তবায়ন করলে হয়তো এ প্রবণতা কিছুটা কমবে।’

(ঢাকাটাইমস/১১ ফেব্রুয়ারি/ এমএম/এআর/ ঘ.)