logo ০৪ মে ২০২৫
বাবর-নিজামীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আরও দুই মামলা
আল ফারুক, ঢাকাটাইমস
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১০:৩১:১৪
image


ঢাকা: ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভার দুই প্রতাপশালী সদস্য জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর। ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন জোট সরকারের দুই প্রভাবশালী গোয়েন্দা কর্মকর্তা রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও আবদুর রহিম। তবে অতীত কান্ডের জন্য এখনই শেষ হচ্ছে না তাদের দুর্দশার। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে এমন দুটি মামলার বিচার চলছে তাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে বাবর, রেজ্জাকুল ও রহিমের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চলছে, আর নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শুনানি শেষ হয়েছে।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার মামলার মতোই একুশে আগস্টেও গ্রেনেড হামলা মামলাতেও প্রথমে আসামি ছিলেন না বাবর। নিজে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে দুটো মামলাই ইচ্ছা করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে মূল আসামিদের বাঁচানোর অভিযোগ ওঠে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধিকতর তদন্তে দুটো ঘটনাতেই বাবরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

আর নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও পুরনো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন নিজামী দাঁড়ান দখলদারদের পক্ষে। এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের হত্যা করতে সংগঠিত করেন কুখ্যাত আল-বদর বাহিনী। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করেন আপ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর সেই অপরাধে নিজামীর বিচার শেষে মামলাটি আছে রায়ের অপেক্ষায়।

গ্রেনেড হামলা মামলা : বাংলাদেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় ঘটনার একটি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার ওপর এই হামলায় মারা যান ২৪ জন।

এই হামলার পর শুরু থেকেই সে সময়ের সরকারের বিরুদ্ধে হামলাকারীদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। জজ মিয়া নামে একজন হকারকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে হাজির করেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। আওয়ামী লীগ নিজেরা এই হামলা করেছে বলেও কথা রটানো হয় সে সময়।

তবে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসলে ধরা পড়ে জজ মিয়া নাটক। পুলিশ এই মামলায় স্বীকারোক্তি দিতে জজ মিয়ার পরিবারকে মাসোহারা দিতো বলেও বের হয়ে আসে। ২০০৮ এরপর পুনঃতদন্তে আসামি করা হয় বাবরসহ বেশ কয়েকজনকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হয় আবার তদন্ত।

২০০৮ সালের ১১ জুন জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তবে এই তদন্তে গ্রেনেডের উৎস ও হামলা পরিকল্পনার পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করা যায়নি। এরপর আবার তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্রে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর ও হারিছ চৌধুরীসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পুরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর ২০১২ সালর ১৯ মার্চ দুই মামলায় তাদেও বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

এই মামলায় ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৩ জনের সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, এই মামলার আসামিদের মধ্যে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে বোমা হামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিও আছে। এসব মামলার শুনানির জন্যও আসামিদের সব সময় পাওয়া যায়নি। তবে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার শেষ হওয়ায় তাদেরকে এখন নিয়মিত আদালতে হাজির করা যাবে। এতদিন সপ্তাহে দুই কার্যদিবস এই মামলার বিচার চললেও এখন থেকে তা চারদিন করার চিন্তা চলছে বলেও জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।  

জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি রেজাউর রহমান অবশ্য এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।  

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, ‘এটি একটি কলঙ্কিত মামলা। যত তাড়াতাড়ি এই মামলার বিচার হবে বাংলাদেশ তত দ্রুত কলঙ্কমুক্ত হবে।’ এই মামলায় দোষী প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বলে জানান তিনি।

নিজামীর রায় আটকে আছে জটিলতায় : মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের আমির নিজামীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হতে পারত যেকোনো দিন। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবির ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ায় সে রায় ঘোষণা আর হয়নি।

বিচারপতি ফজলে কবির অবসরে যাওয়ার আগেই এই রায় ঘোষণা করে যাবেনÑ এমন কথা শোনা গেলেও তা সত্য হয়নি।

জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয় দুই দফা। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় অবরোধের অজুহাত দেখিয়ে নিজামীর আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় অনুপস্থিত থাকার পর, ১৩ নভেম্বর মামলাটির শুনানি শেষ করে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল। এরপর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ চান নিজামীর আইনজীবরা। ১৭ নভেম্বর সে আবেদন মঞ্জুর করে ট্রাইব্যুনাল। শুনানি শেষে ২০ নভেম্বর আবারও মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখার কথা জানায় ট্রাইব্যুনাল।

বিজয়ের মাসে আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠনের মামলার রায় হতে পারেÑ এমন কথা জানিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি ফজলে কবীর অবসরে যাওয়ার পর এই রায় কখন এবং কীভাবে হবে তা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এবং নিজামীর আইনজীবীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মতবিরোধ।

এই রায় কবে হবে, তা নিয়ে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরাও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। এখনও ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পুনর্গঠন নিয়ে তিনটি বিকল্প শোনা যাচ্ছে। বিচারপিত ফজলে কবীর পুনঃনিয়োগ পেতে পারেন এমন সম্ভাবনার পাশাপাশি নতুন কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগের পর ট্রাইব্যুনাল-১ বিলুপ্ত করে সব মামলা ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তরের সম্ভাবনার কথাও বলছেন ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা। তবে এর কোনটা ঠিক হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে দেবো আমরা’।



নিজামীর বিচার হচ্ছে গুরুতর অভিযোগে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আছে হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ। ট্রাইব্যুনালের আইনে দোষী প্রমাণ হলে আসামির মৃত্যুদ- অথবা অন্য যে কোনো সাজার কথা বলা আছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, সাবেক জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদ এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অন্য দুই মামলায় বয়স বিবেচনায় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে ৯০ বছরের কারাদণ্ড এবং বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আজীবন কারাগারে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। আবার জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাণ্ড দিলেও পরে আপিল বিভাগ দণ্ড বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয় তাকে। গত ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটাই প্রথম দণ্ড কার্যকর।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী অবিলম্বে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে নিজামীর মামলার রায় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দেশবাসী অধীর আগ্রহে এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। আশা করব সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।’

(ঢাকাটাইমস/৬ ফেব্রুয়ারি/ এএফ/ জেডএ.)