logo ০৪ মে ২০২৫
আলু সংরক্ষণে নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১০:২৬:০৫
image


ঢাকা:শনির দশা যেন পিছু ছাড়ছে না কৃষকের। কখনো ধান নিয়ে, কখনো দুধ নিয়ে আবার কখনো বা পাট নিয়ে কৃষককে বিপাকে পড়তে হয়। কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া বা তাদের নিয়ে ভাবারও যেন কেউ নেই। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনাও গড়ে ওঠেনি। সর্বশেষ মহাসড়কে বস্তা বস্তা আলু ঢেলে দিয়ে কৃষকের অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন আমরা দেখতে পেয়েছি মিডিয়ার কল্যাণে। তাছাড়া আলু নিয়ে সমস্যা নতুন নয়, এর আগে ১/১১-তে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও আলু নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়েছিল।

ওই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর সেই আলু নিয়ে কৃষকের কান্না গোটা জাতিকে ফের ভাবিয়ে তুলেছে। অথচ আলু উৎপাদনে সরকারি পর্যায় থেকে কৃষকদের নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আলুর ফলন হয়েছে। কিন্তু আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ এ ব্যাপারে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে কৃষকদের আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা সদরে শহীদ মিনার মোড়ে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কে ৪০-৫০ বস্তা আলু ঢেলে দিয়ে কৃষকরা তাদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ জানায়।

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, প্রচ- কুয়াশা, হরতাল-অবরোধসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য লাভের আশায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে আলুর ফলনের পর এখন উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে চাষিরা এখন মহাসঙ্কটে পড়েছেন। খরচ না ওঠায় আলু চাষের জন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় দেখছেন না তারা। এ নিয়ে তাদের এখন নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রতি কেজি আলু মানভেদে দেড় টাকা থেকে তিন টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাঠপর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচই হয় ছয় থেকে সাত টাকা। সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাড়ানোর পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি থেকে শুরু করে আলুর বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আলু বিক্রি করে কৃষকরা না পারছেন উৎপাদন খরচ তুলতে, না পারছেন ঋণ পরিশোধ করতে। আবার যারা চুক্তিতে জমি নিয়ে চাষাবাদ করেছেন তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পাওনাদারের ভয়ে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সারা দেশে এক কোটি ২০ লাখ কৃষকের প্রায় ৯০ লাখই আলু চাষে যুক্ত। দাম কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন এসব কৃষক।

আলু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার একটি অংশ। তরকারি, নাশতা, চিপসসহ নানা ধরনের খাবার তৈরি হয় আলু দিয়ে। অথচ এই আলু সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা নেই দেশে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণে যে পরিমাণ জায়গা আছে তা খুবই সামান্য। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত করে যে পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করে তা পরিমাণে খুবই কম।  

কৃষিবিদরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই আলুর ব্যাপক চাষ হয়। কিন্তু আলু সংরক্ষণে বাংলাদেশের মতো এ দুর্বল ব্যবস্থা আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ আছে।

কৃষিবিদ সিদরাত আবদুল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আলু অতি সহজলভ্য ও সস্তা একটি সবজি। প্রায় সব তরকারিতেই আলুর ব্যাপক ব্যবহার হয়। কিন্তু এর বাইরেও আলুর বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের আলুর চিপস, ফ্রেন্সফ্রাই, আলুর ময়দা ইত্যাদি। কিন্তু সবজি ছাড়া আলুর অন্য ব্যবহারগুলো এখনও অতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তাই উৎপাদন বেশি হলেও আলুর পর্যাপ্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এছাড়া হিমাগারে আলুর সংরক্ষণ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। যে কারণে আলু দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করা যায় না। পাশাপাশি অন্য খাদ্যদ্রব্যের মতো বিদেশে আলু রফতানি করা গেলে চাষিরা এই ফসলের প্রতি উৎসাহ হারাবেন না।’

হিমায়িত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ফ্রেন্সফ্রাই, ম্যাশড পটেটো ও চিপসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অভিজাত হোটেল ও চাইনিজ রেস্তরাঁগুলোতে এই খাবারের চাহিদা বেশি। আলু শুকিয়ে সংরক্ষণ করার প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। বর্তমান শতাব্দীতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের খাদ্য তালিকায় শুকনো আলু উল্লেখযোগ স্থান দখল করে নিয়েছে। জার্মানি, রাশিয়া, পোল্যান্ড, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডসহ পাশ্চাত্যে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথচ আমাদের দেশে আলুর বহুমুখী ব্যবহারে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করা গেল না আজও।

আলু একটি পচনশীল সবজি, তাই একে স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণের প্রচলন রয়েছে নানা দেশে। নানা পদ্ধতিতে আলুকে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে, আলুকে সরাসরি ব্যবহারের উপযোগী করে টিনে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থাও রয়েছে এবং এই পদ্ধতিকে আলুর কেন্ড প্রোডাক্টস বলা হয়। এই পদ্ধতিতে দুই শতাংশ ঘনত্বের ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে আলুকে বাড়তি ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডমুক্ত করা হয়, এতে আলু পচনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এরপর আলুকে টিনে পুরে ১.৫ শতাংশ লবণ পানি দিয়ে টিন ভর্তি করে সংরক্ষণ ও বায়ুশূন্য করার পরে টিন বন্ধ করা হয়। আলুকে ১১৩০ সেন্টিগ্রেড তাপে ৪০ মিনিট প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় এবং পর মুহূর্তেই টিনগুলোকে ৩৭০ সেন্টিগ্রেড তাপযুক্ত পানিতে ঠা-া করা হয়। তবে হিমাগার ছাড়া আলু বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে ক’টি হিমাগার আছে তাতে আমাদের উৎপাদিত আলুর ২০-৩০ শতাংশ স্থান সংকুলান হয়। বাকিটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তাই আলু সংরক্ষণের পাশাপাশি আলু রফতানির প্রতিও জোর দেয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং সফলতার সঙ্গে আলুজাত খাদ্যদ্রব্য রফতানি শুরু করেছে। বাংলাদেশও ইতিমধ্যে রাশিয়ায় আলু রফতানির উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্যাপকভাবে আলু চাষের সুযোগ সৃষ্টিসহ রফতানির ব্যবস্থা করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৮৫ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আলু উৎপাদন হয়েছে ৮৬ লাখ টনেরও বেশি। গত বছর চার লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে ৮৬ লাখ তিন হাজার মেট্রিক টন আলুর উৎপাদন হয়েছিল।

বাংলাদেশ হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মেজর (অব.) জসীম উদ্দিন বলেন, এমনিতেই দেশে উৎপাদনের তুলনায় হিমাগারগুলোর ধারণক্ষমতা অর্ধেক। কৃষকদের আলুর ন্যায্য দাম দিতে এই মুহূর্তে বাজার থেকে ফাস্টফুড ও চিপস কোম্পানিগুলোকে দিয়ে সরকারকে আলু কেনার পরামর্শ দেন তিনি। এ ছাড়া আলু রফতানির বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।