ঢাকা: সরকারি হিসাবে ঢাকায় বস্তির সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। ঢাকার এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষের ৩৫ শতাংশই থাকে এই বস্তিতে। কিন্তু এই ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের যেন কোনো অস্তিত্বই নেই রাষ্ট্রের কাছে। তাদের আবাস আর আর জীবনমান উন্নয়নে এখন পর্যন্ত বলার মতো কোনো প্রকল্প নেয়নি সরকার। উল্টো আদালতের আদেশ না মেনে পুনর্বাসন ছাড়াই যখন-তখন বস্তি ভেঙে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তেমন উচ্চবাচ্য করে না কখনো।
নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কর্মসংস্থানের কারণে গ্রামের দরিদ্রদের শহরে অভিবাসনের প্রবণতা আছে বাংলাদেশে। কিন্তু তাদের আবাসনের কোনো মানসম্মত ব্যবস্থা নেই কোথাও। প্রধানত সরকারি পতিত জমিতে ছাপরাঘর তুলে ভাড়া দেন এলাকার প্রভাবশালীরা। আর এভাবেই এখানে-সেখানে গড়ে উঠেছে বস্তি। এসব বস্তিতে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, শিক্ষা আর নিরাপত্তার অভাবের মধ্যেই কোনোমতো দিন পার করছে মানুষগুলো।
আইসিডিডিআরবি’র হিসাবে, ১৯৯১ সালে ঢাকায় বস্তি ছিল দুই হাজার ১৫৬টি, পাঁচ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার সাতটিতে; আর দুই হাজার পাঁচ সালে তা চার হাজার ৯৬৬-তে। আর গত দশ বছরে এই সংখ্যা কত বেড়েছে সেই পরিসংখ্যান এখন পাওয়া না গেলেও তা যে পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কারো। বস্তিগুলোতে মানুষ বাঁচে কীভাবে? বেঁচে থাকাই সেখানে বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনই যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয় তাদের।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভারতে বস্তিবাসীদের সমাজের মূল¯্রােতে নিয়ে আসতে বড় ধরনের প্রকল্প আছে। ফলে সেখানে এই অতিদরিদ্র নগরবাসীর জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে এমন কিছু নেই। সরকারকে বুঝতে হবে কেবল ঢাকায় ৪০ লাখ মানুষের কথা না ভেবে উন্নয়ন করলে সেটা আরেক বৈষম্য হবে।’
বস্তির ভাড়া ফ্ল্যাটের চেয়ে বেশি : বস্তিবাসী কত টাকা ভাড়া দিয়ে থাকে, সে বিষয়টি কখনো আলোচনায় আসে না গণমাধ্যমে। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাবে তারা যে পরিমাণ ভাড়া দেয় তা মধ্যবিত্ত এমনকি কখনো কখনো উচ্চ-মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়ার চেয়ে বেশি।
২০০৪-২০০৫ সালের জনসংখ্যা প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে আসে। এতে বলা হয়, বস্তিতে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ঢাকার বেশির ভাগ আবাসিক দালানের তুলনায় বেশি। এই হিসাব এখনো একই রকম রয়ে গেছে। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় দেড় হাজার বর্গফুটের একটি বাসা ভাড়া ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা। কিন্তু বস্তিতে ৮০ বর্গফুটের একটি ঘরের ভাড়া আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া হয় ৩০ থেকে ৩৭ টাকা। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকা পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন আর নিরাপত্তার কোনো সুবিধাই থাকে না বস্তিতে।
মানুষগুলো বাঁচে কী করে : শুক্রবার দুপুর ৩টা। মগবাজারের ওয়্যারলেস বস্তির চিত্র। একটি টিউবওয়েলে নারী আর পুরুষ গোসল করছে একসঙ্গে। লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে আরো বহু মানুষ।
পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে গোসল করতে সমস্যা হয় না- জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘আপনি কি কখনো আপনার মা-বোনকে পুরুষের সামনে গোসল করতে দেবেন? কিন্তু আমরা তো ভাই গরিব মানুষ। আর এখানে গোসল করলে কোথায় করব?’
একই বস্তির বাসিন্দা বৃদ্ধ আলী হোসেন বলেন, ‘কী করব? আমরা গরিব মানুষ। টাকা-পয়সা নাই, থাকলে কি আর এখানে থাকতাম আমরা?’
বস্তিটিতে সারা দিন কেবল লাইন আর লাইন। সকালে টয়লেটে যেতে লাইন, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গোসলের লাইন। বস্তিটিতে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জন্য পানির কল আছে মোটে পাঁচটি। আর এই পানির জন্যও বস্তিবাসীকে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। জনসংখ্যা প্রতিবেদন অনুযায়ী বস্তিবাসীরা পানির জন্য অন্য নগরবাসীদের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি টাকা খরচ করে।
এই বস্তিতে প্রতি ১০০ জন বাসিন্দার জন্য গড়ে একটি করেও টয়লেট নেই। রাতে টয়লেটে যাওয়া নারী আর শিশুদের জন্য আতঙ্কের। বাতির ভালো ব্যবস্থা নেই, নেই পানির সংযোগ, থাকে না ভালো দরজাও।
এখানকার বাসিন্দা মালেকা বানু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রাইতে ওই ঘরে ঢুকতেই ভয় করে। একজনরে নিয়া যাই, বাইরে দাঁড়ায়া থাকে।’
পয়ঃনিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থাও নেই কোনো বস্তিতে। ফলে মলমূত্র থেকে ছড়ায় নানা রোগ।
জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘২০১৫ সালের মধ্যেই ঢাকার সব বস্তিতেই বৈধ পানির ব্যবস্থা করব। এরই মধ্যে কড়াইল বস্তিতে বৈধ পানির ব্যবস্থা করছি।’
বস্তিতে বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও তার বেশির ভাগই অবৈধ। আর এ কারণে তা বিপজ্জনকও বটে। বস্তিতে আগুন লাগার অন্যতম কারণও এসব অবৈধ সংযোগ। নি¤œমানের কেব্্ল্ আর চোরাই লাইন থেকে প্রায়ই আগুনের সূত্রপাত হয়।
বস্তির মানুষদের জন্য বৈধ ও নিরাপদ বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ঢাকাটাইমসকে সরাসরি কোনো উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেননি। উল্টো তিনি বলেন, ‘আমরা সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছি এবং করব।’ তা হলে লাখ লাখ শহুরে দরিদ্র কি বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে চলে যাবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা যদি বৈধ উপায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে চায় তা হলে সবাই মিলে একটা মিটার ব্যবহার করতে পারবে। তবে সেটা বৈধ বস্তি হতে হবে।’
বৈধ গ্যাস সংযোগ নেই কোনো বস্তিতে। আর তাই রান্নার খরচও এই গরিব মানুষদের জন্য অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। আর ঘিঞ্জি পরিবেশে রান্না কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা গত ৮ ফেব্রুয়ারি মগবাজারের মধুবাগ বস্তির বাসিন্দারা টের পেয়েছে। রান্নার চুলা থেকে ছড়ানো আগুনে পুড়ে সব হারিয়ে গরিব মানুষগুলো আরো গরিব হয়েছে। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কোনো সংগঠন।
বস্তির শিশুর শিক্ষার অধিকার উপেক্ষিত : গ্রামের অতিদরিদ্রদের শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি নানা প্রকল্প থাকলেও নগর দরিদ্রদের শিক্ষায় নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংস্থা আর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কিছু কাজ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কম থাকায় বস্তির শিশুদের পড়াশোনা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাই তাদের একমাত্র ভরসা এনজিও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে এই শিক্ষা নেয়া যায় কেবল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
কথা হয় খিলগাঁও বস্তির ১০ বছরের শিশু রিয়াজের সঙ্গে। পড়াশোনা করেনি সে। তার মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন দিনভর। বাবাও সারা দিন শ্রম দেন এখানে-সেখানে। রিয়াজের দেখাশোনার কেউ নেই। কেন পড়ো না- জানতে চাইলে সে জবাব দেয়, ‘ইশকুলে গেলে মেলা খরচ। আমাগো টাকা নাই, বাবা-মাও কিছু কয় না।’ আরো কয়েকজন শিশু জানাল, এনজিওর ‘আপারা’ এলে তাদের কাছে পড়ে তারা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমাদের তিনটি সমস্যা আছে। একটি হলো প্রকল্পভিত্তিক। কিন্তু প্রকল্প শেষ হলে সেটা কতটা ফলপ্রসূ হলো তার খবরও রাখে না কেউ। আরেকটা হলো বস্তিবাসী ভাসমান জনগোষ্ঠীদের জন্য বিনিয়োগ কম। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই বস্তিগুলো আমাদের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্বীকৃত নয়। সরকার যখন তখন তাদের উচ্ছেদ করে। তাই এনজিওগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়।
নিরাপত্তা সমস্যা : চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই থাকতে হয় বস্তিবাসীকে। কষ্টের টাকায় কেনা নানা পণ্য অনেকটা বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দিয়েই রাখতে হয় ঘরে। ঘরের দরজা ভালো না, তাই তালা দিলেও কাজ হয় না তেমন একটা।
আবার বস্তিবাসীর অসহায়ত্ব আর দারিদ্র্যের সুযোগ নেয় অপরাধীরা। নানা সময় প্রলোভন আর ভয়-ভীতি দেখিয়ে নানা কাজ করতে বাধ্য করা হয় বস্তির কিশোর, এমন শিশুদের। মাদক কেনাবেচায় বস্তিবাসীদের ব্যবহারের অভিযোগ পুরনো। নানা সময় পুলিশি অভিযানে চুনোপুটিরা ধরা পড়লেও পেছনের মানুষগুলো ধরা পড়ে না কখনো। আর এতে করে বস্তিবাসীর প্রতি এক ধরনের অন্যায্য ধারণাও মানুষের গড়ে উঠেছে যাতে মনে হয় এই মানুষগুলো কেবল নানা অপরাধে জড়িত।
আতঙ্কের নাম উচ্ছেদ : উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে যে, পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশনা কখনো গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে। এক-দুই দিনের নোটিশে উচ্ছেদের পর আবাসন নিয়ে উচ্ছেদের একটি নিত্য হুমকি রয়েছে।
২০১০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে উচ্ছেদ করা হয় মহাখালীর সাটটোলা বস্তি ও টিঅ্যান্ডটি (কুড়িলের অংশ) বস্তি। এবং ২০১১ সালের মে মাসে উচ্ছেদ করা হয় বসিলা রোড হতে বুদ্ধিজীবী বেড়িবাঁধ পর্যন্ত বস্তি।
২০১৩ সালে মোহাম্মদপুরে রামচন্দ্র খালের ওপর বসবাসকারী হাজারো মানুষকে উচ্ছেদ করা হয় এক দিনের ব্যবধানে। সব উচ্ছেদের পর বস্তিবাসীরা কোথায় গিয়ে থাকবে, সে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে। কিন্তু আবাসন নিয়ে এই সমস্যা কখনো গুরুত্ব পায়নি কারো কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, সরকার উচ্ছেদের বিষয়ে আদালতের নির্দেশ মানছে না, এটা দুঃখজনক। তাদের আবাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করতে আসলে কমিশনে এসে অভিযোগ করলে উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।
(ঢাকাটাইমস/১৯ ফেব্রুয়ারি/টিএ/এআর/ ঘ.)