ঢাকা: নবম জাতীয় সংসদের সদস্য না থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রেই ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। গত পাঁচ বছরে বাগেরহাট ও গাজীপুরে ৭০ একর জমি কিনেছেন তিনি। হানিফ ব্যবসা করেন ১৯৮৬ সাল থেকেই। তবে গত পাঁচ বছরে জমিতে এই বিনিয়োগ নিয়ে কথা হচ্ছে বেশ। এই সময়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনটি নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।
ক্ষমতায় থেকে পাঁচ বছরে বিপুল সম্পদ করেছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীরও। সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকাকালে নিয়েছেন ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কনটেইনারবাহী জাহাজের লাইসেন্স। নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী তার মোট সম্পদ ১৬ কোটি ৪১ লাখ টাকার বেশি। পাঁচ বছর আগে যেখানে তার নিজের টাকা ছিল মাত্র পাঁচ লাখ, সেখানে এবার নিজের ও স্ত্রীর টাকাই আছে পাঁচ কোটিরও বেশি।
ক্ষমতায় থেকে অস্বাভাবিক সম্পদ করা সাতজনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এতে নেই আলোচিত এই দু’জনের দাম।
দুদক জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় থাকা সম্পদ নিয়ে গণমাধ্যমে ৭০টি প্রতিবেদন আমলে নিয়েছে তারা। তবে এসব প্রতিবেদনে ৫০ জনের নাম এলেও সাতজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। গত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিক সম্পদ হওয়া অন্য মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের বিষয়েও দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুদকের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, যাদের নাম এসেছে অনুসন্ধান তাদের সবার বিরুদ্ধেই চালানো উচিত।
দুদকের এই কার্যক্রমের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এই তদন্ত নিয়ে আমার তেমন কোনো আশা নেই। তারা দলের মধ্যে এখন কোণঠাসা অবস্থায় আছে তাই তাদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান চলাচ্ছে।’
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, হলফনামায় যাদের অস্বাভাবিক সম্পদের উল্লেখ করা হয়েছে, মূলত তাদের হিসাব অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এর বাইরে তাদের নামে আরও কোনো সম্পদ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
যে সাতজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করতে গত ২২ জানুয়ারি সাত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তারা হলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক, কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি এবং সাতক্ষীরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে ছয়জন উপপরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালককে দায়িত্ব দিয়েছে দুদক। রুহুল হকের বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন মির্জা জাহিদুল আলম। এ ছাড়া আবদুল মান্নান খানের বিষয়ে নাসির উদ্দিন, মাহবুবুর রহমানের বিষয়ে খায়রুল হুদা, আসলামুল হকের বিষয়ে মেজবাহ উদ্দিন, আবদুর রহমান বদির বিষয়ে আহসান আলী, এনামুল হকের বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন যতীন কুমার রায়। তারা সবাই উপপরিচালক। আর আবদুল জব্বারের সম্পদের অনুসন্ধান করবে সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান।
আবদুর রহমান বদি রোববার দুর্নীতি দমন কমিশনে এসে তার বক্তব্য দিয়ে গেছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি দুদকে আসবেন মাহবুবুর রহমান, রুহুল হক আসবেন এর পরদিন।
আটঘাট বেঁধেই নেমেছে দুদক : জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর আগে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে দুদক। অভিযুক্তদের গত পাঁচ বছরের কর্মকা- নিয়ে দালিলিক বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করে রাখছে দুর্নীতিবিরোধী সরকারি সংস্থাটি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি এনামুল হক এবং আবদুল মান্নান খানের সম্পদের তথ্য সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নথিপত্র তলব করেছে দুদক। আবদুর রহমান বদির ‘অবৈধ সম্পদ’ অনুসন্ধানে ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজারের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার হলফনামা ও আয়কর বিবরণী জব্দ করেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মাহবুবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব (পিএস) শামীম আল সোহাবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), বাংলাদেশ পোস্ট অফিস (জিপিও), ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই/সিএসই), বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের কাছে এনামুল হক ও আবদুল মান্নান এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক আলফালাহ এবং ফনিক্স ইন্টারন্যাশনালের কাছে এমপি এনামুল হকের সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নানের সম্পদের তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সমবায় পরিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে।
তাদের নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, গৃহনির্মাণ সংস্থা রিহ্যাব, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থায় চিঠি দিয়েছে দুদক। অভিযুক্তরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন কি না তাও যাচাই করা হবে বলে জানিয়েছে দুদক।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিষয়ে জানতে ১৬টি জেলায় ১৭টি নোটিশ দিয়েছে দুদক। মাহবুবুর রহমানের সম্পদ সম্পর্কে জানতে সংশ্লিষ্ট দফতরে সাতটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি চিঠির উত্তর দিয়েছে দুদককে। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেছে মাহবুবুর রহমান ও তার পরিবারের কোনো সম্পদের তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে জানতে পারলে তারা পরে জানাবে।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, সাতজনের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য সাতজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘অনুসন্ধানে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেলে মামলা হবে এবং পরে হবে তদন্ত। এর মধ্যে কোনো চাপ না আসলে দুদক সফলভাবে কাজ করতে পারবে বলে আমার কাছে মনে হয়।’
কার কত সম্পদ বৃদ্ধি : নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা অনুসারে, পাঁচ বছরে আ ফ ম রুহুল হকের সম্পদ বেড়েছে চার গুণ। ২০০৮ সালে তিনি এবং তার স্ত্রীর মোট অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল চার কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০১৩ সালে সম্পদের পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এককভাবে তার স্ত্রী ইলা হকের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে ৮ গুণ। আগে তার নামে অস্থাবর সম্পত্তি ছিল মোট ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের। এখন তা আট কোটি ৩৯ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হিসাবে ভুল ছিল বলে পরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন রুহুল হক।
আবদুল মান্নান খান : ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হলফনামায় তার আয় ছিল ২৬ লাখ ২৫ হাজার, নির্ভরশীলদের কোনো আয় ছিল না। পাঁচ বছর পর তিনি ও তার স্ত্রী বা অন্য নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
আবদুল মান্নান খানের আয়ের বড় উৎস মৎস্য ও প্রবাসী আয় এক কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। একই খাতে তিনি নির্ভরশীলদের আয় দেখিয়েছেন এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
মাহবুবুর রহমান : মাহবুবুর রহমান পাঁচ বছরে ২০ একর জমি থেকে দুই হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক হয়েছেন। পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছাড়া কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ না থাকা স্ত্রীর নামে এখন এক কোটি ২৬ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে। নিজের ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ১১২ টাকার স্থাবর সম্পদ পাঁচ বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭২ টাকায়।
আবদুর রহমান বদি : ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তার বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ ২১ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে তিনি আয় করেছেন ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০ টাকা। হলফনামা অনুসারে বদির এখন বার্ষিক আয় সাত কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮০৮ টাকা।
আসলামুল হক : ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দেয়া হলফনামায় আসলামুল হক বলেছেন, তিনি ও তার স্ত্রী মাকসুদা হক ৪ একর ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমির মালিক। এসব জমির দাম দেখিয়েছেন ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা।
আর দশম সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় আসলামুল হক জমি দেখিয়েছেন ১৪৫ দশমিক ৬৭ একর। আর বাড়তি এই ১৪০ একর জমির দাম দেখিয়েছেন এক কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে আসলামুল পরে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই জমি বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে সরকার থেকে বরাদ্দ নেয়া।
এনামুল হক : রাজশাহীর এই সংসদ সদস্যের আয় পাঁচ বছরে কমে যাওয়ার দাবি করেছেন তিনি। তবে এই সময়ে বেড়েছে স্ত্রীর সম্পদ। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর থাকা দুই কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। যার মধ্যে এবার নিজের হাতে নগদ রয়েছে ১০ লাখ টাকা ও স্ত্রীর হাতে পাঁচ লাখ টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে আছে আট লাখ ৫৮ হাজার ৯১ টাকা ও স্ত্রীর নামে এক লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা।
(ঢাকাটাইমস/ ১৮ ফেব্রুয়ারি/ এমএম/ এআর/ ঘ.)