logo ০৫ আগস্ট ২০২৫
জামায়াত-হেফাজতের “আল-কায়েদা” কানেকশন!
আল ফারুক, ঢাকাটাইমস
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ২০:৪৫:১২
image


ঢাকা: এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর পর অবশেষে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে  আলোচনায় বসেছে তালেবান। এই শান্তি আলোচনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর হয়ে যে তিনজন অংশ নিচ্ছেন তাদের একজন জামায়াতে ইসলামীর নেতা ইব্রাহিম খান। এই মধ্যস্থতায় জামায়াত নেতার অংশগ্রহণ তালেবানদের সঙ্গে জামায়াতের যোগসূত্রের প্রমাণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

পাকিস্তানে তালেবানের সঙ্গে জামায়াতের এই সম্পর্ক প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক আরেক জঙ্গি সংগঠন আয়মান আল জাওয়াহিরির অডিওবার্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে তোলপাড়। বার্তাটিতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে জেহাদে নামার ডাক দিয়েছেন আল-কায়েদা নেতা।

গত শনিবার ইউটিউব, ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে জাওয়াহিরির বক্তব্যটি নজরে আসে। আল-কায়েদার প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত আস শাহাব মিডিয়া ফাউন্ডেশন গত নভেম্বরে বার্তাটি তৈরি করে। আস শাহাবের ওয়েবসাইটে এটি অবশ্য নেই। জিহাদোলজি ডটনেট নামে একটি ওয়েবসাইটে আছে ভিডিওবার্তাটি।

বার্তাটিতে সরাসরি নাম উল্লেখ না করলেও এই জঙ্গি নেতা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে দুই আলোচিত দল ও সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের পক্ষেই কথা বলেছেন। বার্তায় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ‘কতিপয় বিপথগামী নাস্তিক্যবাদী’র আন্দোলন বলে মন্তব্য করেন তিনি। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে ইসলামপন্থিদের সাজা দেয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন জাওয়াহিরি।

হেফাজত ও জামায়াতকে জড়িয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে আল-কায়েদা নেতার এমন বক্তব্যে খুব একটা অবাক হননি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবির। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এই সম্পর্ক এর আগে গোপন রাখার চেষ্টা করলেও তা পারেনি তারা। অবশেষে জাওয়াহিরি তা প্রকাশই করে দিলেন।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত ও হেফাজত এ দেশে আল-কায়েদার শেকড়। আর আল-কায়েদা এ দেশে তাদের কার্যক্রম চালায় এদের দিয়েই। এখন জামায়াত ও হেফাজত বিপদে পড়েছে, এই অবস্থায় তাদের উদ্ধার করতে নেমে পড়েছে আল-কায়েদা।’ জঙ্গিদের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে সরকারকে এখনই জামায়াত-হেফাজতের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি জামায়াত-হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্কও নানা সময় উঠে এসেছে। তবে এবার জাওয়াহিরির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

লেনিন বলেন,  ‘আল-কায়েদা, তালেবান, হেফাজত, জামায়াতের মতো শক্তি যত চেষ্টাই করুক না কেন, আমাদের দেশে তাদের কখনো প্রতিষ্ঠা পেতে দেয়া হবে না।’

জাওয়াহিরির এই বক্তব্যে বিব্রত হয়েছেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব এবং খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব জাফরুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘জাওয়াহিরি কেন এই বার্তা দিলেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন, তবে আল-কায়েদা বা তালেবানের সঙ্গে আমাদের দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই।’

জাফরুল্লাহ খান অস্বীকার করলেও তালেবান ও আল-কায়েদার হয়ে লড়াই করতে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার যোদ্ধার আফগানিস্তান ও পাকিস্তান যাওয়ার তথ্য আছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। ২০০১ সালে শিকল ও তলোয়ার হাতে ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোটের সমাবেশ যোগ দেন ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজত নেতা জাফরুল্লাহ্ খান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অতিউৎসাহী কেউ কেউ আফগানিস্তানে গিয়ে হয়তো যুদ্ধ করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে জিহাদ করার মতো কেউ নেই। সেই অবস্থাও নেই।’

শাপলা চত্বরে কথিত গণহত্যার অভিযোগ জাওয়াহিরির

বার্তার শুরুতেই ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতকর্মীদের উৎখাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের ছবি দেখানো হয়। এতে জাওয়াহিরি দাবি করেন, ‘বাংলাদেশের রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের অপরাধ ছিল একটাই, ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সঙ্গে কতিপয় নাস্তিক্যবাদীর যোগসাজশের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমেছিল।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদ- দিলে ফাঁসির দাবিতে সারা দেশে শুরু হয় আন্দোলন, যা পরে গণজাগরণ হিসেবে পরিচিতি পায়। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত। তখনই গণজাগরণের আন্দোলনকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধোঁয়া তুলে মাঠে নামে হেফাজত। এভাবে জামায়াতকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে হেফাজত।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে রাজধানীতে ৬ এপ্রিল বড় ধরনের সমাবেশ করে হেফাজত। পরে তারা ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে। এই ১৩ দফা মানলে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিচয় পুরোপুরি পাল্টে দিতে হতো। ছেলেমেয়েদের সহশিক্ষা বাতিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মতো দাবিও করতে থাকেন হেফাজত নেতারা।  এসব দাবিতে ৫ মে রাজধানী অবরোধ শেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজত। সমাবেশ চলাকালে পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, মতিঝিল এবং আশপাশের এলাকায় তা-ব চালায় হেফাজতকর্মীরা। এসব সহিংসতায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের অংশগ্রহণের অভিযোগও উঠে তখন। পরে ওই রাতে শাপলা চত্বরে অভিযান চালিয়ে সবাইকে উৎখাত করে নিরাপত্তা বাহিনী।

সকালে অভিযান শেষ হওয়ার পরই শাপলা চত্বরে অভিযানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ তোলে হেফাজত এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। অভিযানে হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করে মরদেহ গুমের অভিযোগ তোলে হেফাজত। তাদের তালিকা দেয়ার কথা বললেও একজনেরও নাম দিতে পারেনি তারা। পরে অধিকার নামে একটি সংগঠন ৬২ জনের তালিকা দিলেও পুলিশের তদন্তে এই তালিকার কয়েকজনে জীবিত পাওয়া যায়, বেশ কয়েকজনের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। বাকি নিহতদের কেউ শাপলা চত্বরে মারা যায়নি। পুরানা পল্টনে দিনের বেলা সংঘর্ষ, পরদিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সংঘর্ষ এমনকি গাজীপুর ও বাগেরহাটে সংঘর্ষে নিহতদের নামও পাওয়া যায় এই তালিকায়।  

কিন্তু হেফাজত ও জামায়াত নেতাদের মতো জাওয়াহিরিও এখন শাপলা চত্বরের অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহতের দাবি তুললেন।

জানতে চাইলে হেফাজত নেতা জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘৫ মে শাপলা চত্বরে বহু লোক মারা গেছে সেটা নিশ্চিত। তবে আমরা তালিকা করতে পারিনি কারণ যারা মারা গেছে তাদের মা-বাবা তাদের কথা বলতে রাজি হচ্ছে না।’ জাওয়াহিরি কেন এই অভিযোগ তুলবেন- জানতে চাইলে জাফরুল্লাহ্ খান বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারব না।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়েও আপত্তি

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার জামায়াত এবং আল-কায়েদাপ্রধানের বক্তব্যও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে তা মোকাবিলার কৌশল নিয়েছে জামায়াত। তাদের অভিযোগ, ইসলামের পক্ষে যারা এই দেশে কাজ করছে তাদের সরিয়ে দিতেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার করছে সরকার। একই অভিযোগ তুললেন আল-কায়েদাপ্রধানও।

জামায়াত নেতাদের নাম উল্লেখ না করে আসামিদের আলেম আখ্যা দেন জাওয়াহিরি। তিনি বলেন, ‘শত শত আলেমকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। তাদের জেলে আটক রাখা হয়েছে। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। কোনো অপরাধ না থাকার পরও তাদের মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন কারাদ-ের মতো কঠোর শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ইসলামবিরোধীদের বিরোধিতা করাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ।’

জামায়াত ও আল-কায়েদার বক্তব্য এভাবে মিলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, তালেবান আর আল-কায়েদা মিত্র। পাকিস্তানে তালেবানের প্রতিনিধিত্ব করছে জামায়াত। তাই বাংলাদেশে জামায়াতের পক্ষে নেমেছে আল-কায়েদা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, ‘জাওয়াহিরির বার্তাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে আল-কায়েদা মনে করছে বাংলাদেশে জামায়াত ও হেফাজত ইসলামের রক্ষক। তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে কি না তা আমি বলতে পারব না, কিন্তু বার্তাটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।’

মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়েও কটাক্ষ করেন জাওয়াহিরি। তার ভাষায় মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করতে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা জামায়াতের বক্তব্যও ছিল একই রকম।

এসব বিষয়ে জামায়াতের বক্তব্য জানার সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলন চলাকালে গোপন স্থান থেকে দল চালাচ্ছেন নেতারা। ফোনও বন্ধ রেখেছেন নেতারা।

(ঢাকাটাইমস/১৭ ফেব্রুয়ারি / এলএফ/ এআর/  ঘ.)