logo ০৪ মে ২০২৫
রাজনীতিবিদদের কারণে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:১৬:৫২
image


ঢাকা: নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি অনেকটা একই রকম। বিরোধী জোটের বর্জন আর প্রতিরোধের ডাকের মধ্য দিয়ে দুই দেশেই হয়েছে সংসদ নির্বাচন। কিন্তু আরেকটা দিক থেকে দুই দেশের চিত্র একেবারেই বিপরীত।

থাইল্যান্ডে নির্বাচনের আগে অথবা পরে বিদেশি কোনো দেশ বা তাদের প্রতিনিধি কোনো দৌড়ঝাঁপ বা কথাও বলেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একেবারেই উল্টো চিত্র। বিভিন্ন দেশ এবং তাদের রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন প্রকাশ্যেই।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। কারণ, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তবে সেটা যদি আন্তর্জাতিক কোনো ইস্যুতে হয় তবে সে ক্ষেত্রে কেউ চাইলে মতামত দিতে পারবেন।’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকার হস্তক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এটা ৭১ কিংবা ৭৫ নয়। আগে যেভাবে আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতো এখন আর সেই সুযোগ নেই।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, কোনো স্বাধীন দেশে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ সভ্যতার পরিপন্থী। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিদেশি দাতাদের ওপর নির্ভরশীল। তাই দাতাদেশগুলো এ দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। গরিবদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশের বেলায়ও তাই হয়েছে। তবে আমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে কোনো দেশ কথা বললে তা পুরোপুরি নাকচ করে দেয়া যাবে না।’

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের সমর্থনের বিষয়টি উল্লেখ করে শামসুজ্জামান দুদ বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল। আমেরিকা ছিল বিপক্ষে। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের অবস্থান গণতন্ত্রের বিপক্ষে, আর আমেরিকার অবস্থান গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের পক্ষে। তা না হলে ৮ শতাংশ ভোটারের নির্বাচনকে ভারত সমর্থন দিত না।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করা দরকার। সেটা যদি না করি তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবে না বলেই আমি মনে করি।’

রাজনীতি নিয়ে বিরোধের সুযোগে হস্তক্ষেপের চেষ্টা

অতীত ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যখনই বিরোধের ঘটনা ঘটেছে, তখনই তৎপর হয়েছে বিদেশিরা। ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচন নিয়ে জটিলতার মুখেও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা তৎপর ছিলেন বাংলাদেশে। এমনকি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে তাতেও সমর্থন দেয় একাধিক দেশ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের এই নাক গলানোর ক্ষেত্রে সরকারি দল সমালোচনা করলেও বিরোধী দলে থাকতে কোনো পক্ষই এ নিয়ে কথা বলেনি। বরং আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই বিদেশি হস্তক্ষেপ চেয়েছে প্রকাশ্যেই।

বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবার গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিতের অনুরোধ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয় যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে। সে সময় এক সমালোচনা হলে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ শেখ হাসিনার সেই আহ্বানের উদাহরণ টেনেছিলেন। পরে অবশ্য খালেদা জিয়া কোনো নিবন্ধ লেখার কথা অস্বীকার করেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাতৃপ্রতিম দেশ বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু তারা যে আচরণ করেন তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য না। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশিদের আচরণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলেই মনে করছেন তারা।

দায়ী রাজনীতিবিদরাই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. রমজুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমাদের রাজনীতিবিদরাই। কারণ নানা সময় দলগুলোই রাষ্ট্রদূতদের শরণাপন্ন হয়। সরকার কিংবা বিরোধী দল সবাই বিদেশিদের সঙ্গে খোশ মেজাজেই সম্পর্ক ধরে রাখে। কিন্তু যখনই বিদেশিদের কূটনৈতিক আচরণ তাদের বিপক্ষে যায় তখনই এ নিয়ে কথা বলে। এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে না এলে বিদেশিদের তৎপরতা বন্ধ হবে না।’

রাজনীতিতে বিদেশিদের এই হস্তক্ষেপ শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন এবং নির্বাচন বর্জনের ডাকের পর দলগুলো আলোচনায় বসতে পারেনি নিজেরা। পরে কমনওয়েলথের দূত স্যার নিনিয়ান বাংলাদেশে আসেন দুই দলের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে। কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

পরে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি। আন্দোলনের মুখে অবশ্য সে সরকার পদত্যাগ করে দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যেই। পরে ওই বছরের জুনেই হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০০১ সালে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিরোধ হয়নি, ফলে বিদেশিরাও এ নিয়ে তেমন কোনো দৌড়ঝাঁপ করেনি। কিন্তু ২০০৬ সালে আবার পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

বিচারপতি এম এ হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে না মানার ডাক নিয়ে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। টানা আন্দোলনের কারণে সারা দেশে তৈরি হয় উদ্বেগ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অতটা না হলেও আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিদেশিরা। বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হওয়া উচিত তা নিয়ে প্রকাশ্যে নানা বক্তব্য দেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে আবার তাদের মধ্যে মতবিরোধের বিষয়টিও উঠে আসে গণমাধ্যমে। কোনো দেশ বলে, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন চায় তারা, কোনো দেশ আবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের কথা বলে।

নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো দুই দফা ঢাকায় এসেছিলেন। প্রতিবারই তিনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ, নির্বাচন কমিশন, কূটনৈতিক এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।

বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালিয়েছেন তারানকো। কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে বলেছিলেন, তিনি দুই দলের মধ্যে সমঝোতার পথ হিসেবে আলোচনা শুরু করে দিয়ে গেছেন। এই আলোচনা চলবে এবং কম সময়ের মধ্যে তারা একটি সমাধানে পৌঁছবে। এর আগে ঢাকায় আসেন দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে।

কিন্তু শেষমেশ ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে ছাড়াই জাতীয় নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পরে ভারত, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো নির্বাচনের ব্যাপারে হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি। বরং যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে।  

বিদেশিদের এই হস্তক্ষেপকে ভালোভাবে দেখছে না সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের বিদেশি যেসব বন্ধু রয়েছেন, তারা আমাদের সঙ্গে পারস্পরিক লেনদেন ও সহযোগিতা করে ভালোমন্দ পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু করাটা শোভন নয়।’

(ঢাকাটাইমস/ ১৯ ফেব্রুয়ারি/এইচএফ/এআর/ ঘ.)