২৩ হাজার শিক্ষার্থীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো আবাসন সুবিধা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে কলেজ থাকাকালে আশির দশকেও ১২টি ছাত্রাবাস ছিল জগন্নাথের। স্থানীয়দের সঙ্গে কলেজের ছাত্রদের বিরোধের পথ ধরে ১৯৮৫ সালে। এরপর ২৯ বছরেও সেই বেদখল হল উদ্ধার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে ছাত্র সংখ্যার দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়টি কোনো আবাসন সুবিধা দিতে পারছে না শিক্ষার্থীদের।
২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরই এই বেদখল হলগুলো উদ্ধারে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন এখন পড়লো নয় বছরে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দেন-দরবার করেছে বহুবার। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি তেমন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী বিলুপ্ত কলেজের সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তখন বেদখল হওয়া ১২ হলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১১ সালে হাবিবুর রহমান হল উদ্ধার হলেও বাকিগুলো রয়ে গেছে দখলদারদের অধীনে। তবে উদ্ধার করা হলটিও বসবাসের উপযোগী হয়নি।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হয়ে যাওয়া হল উদ্ধারে সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল এবং অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছে তারা। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের সব সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু আমরা নিজেরা হল উদ্ধার করতে পারি না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সরকারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন আশ্বাস তারা শুনেছেন বহুবার। এবার আন্দোলন করেই অধিকার আদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহায়েল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হল উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি। যে কোনো মূল্যে আমাদের অধিকার আমরা ছিনিয়ে আনব।’
প্রশাসনিক উদ্যোগ : ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা হলে নীতিনির্ধারণী মহলের টনক নড়ে। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসের মধ্যে ১২টি হল ও বেদখল অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধারে সুপারিশ করতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ২০০৯ সালের মার্চে ৫টি হল (আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল) বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেয়ার সুপারিশ করে কমিটি।
একই বছরের ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঁচটি হলের দীর্ঘমেয়াদি লিজের আবেদন করে। ৯ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক আইনগত সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলো লিজের বদলে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা ও আইনি জটিলতায় হল উদ্ধার কার্যক্রম থমকে আছে।
বেদখল হওয়া হল : আরমানিটোলা বটতলার ৬, এসি রায় রোডের আবদুর রহমান হলে বাস করছে পুলিশ সদস্যরা। অন্য আরেকটি বেসরকারি সংস্থা হলটি দখলের চেষ্টা করছে। ১৯৯৬ সালে সংস্থাটি মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করে তারা। কিন্তু মামলা পরিচালনায় ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহারের অভিযোগে সংস্থাটির সভাপতি কেএম আকবরের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শাহবাগ থানায় মামলা হয়।
এই ভবনটির মূল মালিক ছিলেন চিন্ময়ী দেবী। ১৯৬৫ সালে যা অর্পিত সম্পত্তি হয়। পরে তৎকালীন কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে থাকা শুরু করে। পরে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যের পরিবারের লোকজন বসবাস শুরু করে। তবে মূল ফটকে এখনো হলের সাইনবোর্ড আছে।
শহীদ আনোয়ার শফিক হল : আরমানিটোলা মাহুতটুলীর ১ শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠার হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে আছে। পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করে টিন, হার্ডওয়ার ও আসবাবপত্রের গুদাম তৈরি করেছে তারা।
তিব্বত হল : পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯নং জিএল পার্থ লেনের হলটি আছে একজন সংসদ সদস্যের দখলে। তবে তিনি জায়গাটি তার নিজস্ব বলে দাবি করেছেন। ’৯০ দশকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে স্থানীয়রা হলটির দোতলায় আগুন দিলে তৎকালীন অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘তিব্বত হল’ লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও শিক্ষার্থীরা আর হলটিতে ফিরে যেতে পারেনি।
সাইদুর রহমান হল ও রউফ মজুমদার হল : স্থানীয় দুই বিদ্যুৎসাহীর দান করা হল দুটির কোনো অস্তিত্বই নেই এখন। মৌখিকভাবে দান করা সম্পত্তিটি জনৈক আইনজীবী ইব্রাহিম জাল দলিল করে বিক্রি করে দেন। ১৫, ১৭ ও ২০ যদুনাথ বসাক লেন, টিপু সুলতান রোডের সাইদুর রহমান হলে হার্ডওয়ারের দোকান তৈরি হয়েছে। পাশের রউফ মজুমদার হল জাল দলিলের মাধ্যমে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বিক্রি করে দিয়েছে।
শহীদ আজমল হোসেন হল : পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭নং রমাকান্ত নন্দী লেনের হলটিতে বসবাস করত পুলিশ সদস্যদের পরিবার। কিছু অংশে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সমিতি। ১৯৯৬ সালে একাংশ দখল করেন স্থানীয় মোশারফ হোসেন খান। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত ‘বেগম রোকেয়া (শহীদ পরিবার)’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জায়গাটি দখল করা হয়। হলটির অবকাঠামো এখনো অক্ষত রয়েছে।
বজলুর রহমান হল : বংশালের ২৬, মালিটোলার হলটিতে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চবিদ্যালয় বানানো হয়েছে। কিছু অংশ স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করেছে।
বাণী ভবন : এক নং ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনের ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১০ কাঠার বাণী ভবনের কিছু অংশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারী বসবাস করলেও দুই-তৃতীয়াংশ বেদখল রয়েছে। হলটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় পাবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।
নজরুল ইসলাম হল : গোপীমোহন বসাক লেনের ৫/১,২,৩,৪ ও ৬নং টিপু সুলতান রোডের হলটির ২০ কাঠা জায়গায় গড়ে উঠেছে জামেয়া শরীয়াবাগ জান্নাত মাদরাসা ও এতিমখানা। সাবেক কমিশনার আওলাদ হোসেন দিলীপ এর তত্ত্বাবধান করছেন। হলটির একাংশ দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন বিটিভির সাবেক ক্যামেরাম্যান গোলামুন্নবী। তার আত্মীয়রা সেখানে অবস্থান করছে।
শহীদ শাহাবুদ্দিন হল : তাঁতীবাজার ৮২, ঝুলনবাড়ী লেনের হলটি দুই যুগেরও বেশি সময় পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন।
কর্মচারী আবাস : তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসস্থল ২৬, পাটুয়াটুলীর কর্মচারী আবাসে ৬ তলাবিশিষ্ট ক্রাউন মার্কেট তৈরি হয়েছে। জনৈক ওবায়দুল্লাহও এর মালিকানা দাবি করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য নতুন হল নির্মাণ : বেদখল হওয়া হল উদ্ধারে অগ্রগতি না হলেও জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের জন্য এক হাজার আসনের একটি হল তৈরির চিন্তা করছে সরকার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-একনেকে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। একশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পে ৪০ কোটি টাকায় ছাত্রীদের জন্য একটি দশতলা হল নির্মাণের কথা বলা আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হল নির্মাণে প্রাথমিক সব কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসেই এই হল নির্মাণে আমরা দরপত্র আহ্বান করব।’